ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ॥ তুরস্ক ও মিসরে আমাদের বন্ধুরা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২ জুলাই ২০১৬

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ॥ তুরস্ক ও মিসরে আমাদের বন্ধুরা

(শেষাংশ) মিসরে জামায়াতে ইসলামীর বড় ভাই ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ২০১২ থেকে ২০১৩ সালে মাত্র এক বছর ক্ষমতায় থেকে দেশটিকে কী ভাবে জাহান্নামে পরিণত করেছিলেন তার সামান্য বিবরণ ‘দি আল্টিমেট জিহাদ’ ছবিতে আছে। বাংলাদেশে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে জামায়াত-বিএনপির জোট যা করতে পারেনি, মুসলিম ব্রাদারহুড তাই করেছিল মিসরে। বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো মিসরে বৃহত্তম সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় কপটিক খ্রীস্টান। এক বছরে তাদের জনসংখ্যা শতকরা ২০ ভাগ থেকে ৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মিসরের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। যে কারণে নতুন সরকার মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ করে এবং দলের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শক্ত হাতেই মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদ্রোহ দমন করেছেন জেনারেল সিসি। একদিনে সাড়ে পাঁচ শ’ জনের হত্যা নিয়ে এ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটসওয়ালারা যত না চিৎকার করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজন গণহত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। কায়রোয় আমার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বামপন্থী ‘তাগামা পার্টি’র শীর্ষনেতা অধ্যাপক রীফাত মোহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে, যিনি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও জঙ্গী মৌলবাদ সম্পর্কে পঞ্চাশের ওপর বই লিখেছেন। আফ্রো-এশীয় পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আপসো)-এর সদর দফতর কায়রোয়। ’৭১-এর গণহত্যার প্রতিবাদে এবং মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ‘আপসো’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। ‘আপসো’র সদর দফতরে আলোচনা হয়েছে সংগঠনের মহাসচিব নূরী আবদুল রাজ্জাকের সঙ্গে। আলোচনা হয়েছে নিহত প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘ইসলাহ এ্যান্ড তানমেয়া পার্টি’র সভাপতি আনোয়ার এল সাদাত এমপির সঙ্গে। কায়রোয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল মিসরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরব লীগের সাবেক মহাসচিব আমরো মুসার সঙ্গে, যে বৈঠকে মিসরে আমাদের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। এরা সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিও তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর নাম উল্লেখ করার সময় মোহসেন আমাকে বলেছিলেন, মিসরে তারা শুধু ‘ব্রাদারহুড’ বা ‘ইখওয়ানুল’ নামে ডাকেন এই দলকে, ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ বলে না। মোহসেনের মতে এর নাম হওয়া উচিত ‘টেররিজম ব্রাদারহুড’। জামায়াতের সঙ্গে ব্রাদারহুডের আঁতাত সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। মিসরে গিয়ে আরও জেনেছি মামলা ও গ্রেফতার থেকে বাঁচার জন্য এবং দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করার জন্য ব্রাদারহুড ও জামায়াতের নেতারা দলে দলে পাড়ি জমাচ্ছেন তুরস্কে। সেখানকার ক্ষমতাসীন দল সাদরে আশ্রয় দিচ্ছে দুই মুসলিমপ্রধান দেশের মৌলবাদী সহযোদ্ধাদের। ২০১৩ সালে মিসরে ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট মুরসির পতনের পর তুরস্কের এরদোগান বলেছিলেন, ‘মুরসি আমার প্রেসিডেন্ট’। আমি তখন ইস্তানবুলে ছিলাম। এ নিয়ে সেখানকার একটি টেলিভিশন আমার মন্তব্য চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমরা তো জানি তুরস্ক একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এরদোগানের মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে তুরস্ক যেন মিসরের উপনিবেশ বা অঙ্গরাজ্য! তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান খলিফা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। জামায়াত ও ব্রাদারহুডের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জঙ্গী মৌলবাদীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন এরদোগান। বাংলাদেশের জামায়াতের নেতারা পাকিস্তানের পাশাপাশি তুরস্কেও তাদের কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছেন। তুরস্কের বুদ্ধিজীবীদের আশঙ্কাÑ যেভাবে এরদোগান মিসর, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গী মৌলবাদীদের আশ্রয় ও মদদ দিচ্ছে অন্তিমে তা তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য ধ্বংস করবে। আঙ্কারায় যে দুটি সড়কের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের দূতাবাস নিজামীর ফাঁসির পর সেখানে একেপির অনুসারীরা সড়ক দুটির নতুন নামকরণ করেছিল ‘শহীদ রহমান নিজামী’ ও ‘শহীদ কাদের মোল্লা’র নামে। পাড়ার লোকেরা এর প্রতিবাদ করেছে। আমাদের দূতাবাসও করেছে। ফলে পৌর কর্তৃপক্ষ নামফলক দুটি সরিয়ে ফেলেছে। ইস্তানবুলের বন্ধুরা বলেছেন, গণহত্যাকারীদের ‘শহীদ’ বলা এরদোগানের পক্ষেই সম্ভব। একজন কূটনীতিক জানালেন, দুদিন আগে এরদোগান বিরাট ইফতার পার্টি দিয়েছিলেন। প্রচুর রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে। ইফতারের পর মাগরিবের নামাজের ব্যবস্থা না থাকায় মুসলিম কূটনীতিকরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এক বন্ধু মন্তব্য করেছেন, আতাতুর্কের লিগাসি থেকে এরদোগান বেরুতে পারছেন না। আতাতুর্ক ছিলেন ফরাসীদের মতো কট্টর সেক্যুলারিস্ট। মৌলবাদী একেপি ১৩ বছর তুরস্কে ক্ষমতায় থাকলেও কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতার উত্তরাধিকার ধ্বংস করতে পারেনি। মোস্তাফা কামাল এখনও জাতির পিতা (আতাতুর্ক) হিসেবে তুরস্কের সর্বত্র স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এরদোগানের আমলে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী রাজনৈতিক বা পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের ওপর দমন-পীড়ননীতি অব্যাহত থাকলেও রমজান মাসে ইস্তানবুলের সকল হোটেল-রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে পানভোজন চলছে। যারা রোজা রাখেন এসবের প্রতি তাদের কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। একই দৃশ্য দেখেছি কায়রোয়। রোজা নিয়ে তাদের কোন আতিশয্য নেই। রোজদাররা রোজা রাখছেন, ইফতারের সময় ঘটা করে ইফতার করছেন। ইস্তানবুলের বিভিন্ন পার্কে, বিশেষভাবে সুলতান আহমেদের প্রধান দর্শনীয় স্থান নীল মসজিদের (ব্লু মস্ক)-এর সামনের বিশাল বাগানে হাজার হাজার রোজাদার ঘাসে চাদর বা কার্পেট বিছিয়ে সপরিবারে ইফতার করছেন। ইফতারের পর রমজান মাসে অটোমানদের অসামান্য কীর্তি নীল মসজিদে লাইট এ্যান্ড সাউন্ডে ইসলামের ইতিহাসের দৃষ্টিনন্দন প্রদশর্নী শুধু স্থানীয়দের নয়, বিদেশী পর্যটকদেরও অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। কায়রোয় হিজাবপরা সমাজকর্মী নাহলা কামেল বলেছেন, ‘আমি রোজা রাখি, নামাজ পড়ি, বহুবার হজ করেছি কিন্তু ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশানো কখনও সমর্থন করি না। ব্রাদারহুডের সময় দেশটাকে তারা হাবিয়া দোজখ বানিয়েছিল। আমাদের দেশে শতকরা ২০ ভাগ খ্রীস্টান। তাদের ওপর আমরা কখনও আমাদের ধর্মীয় বিধান বা আচার-আচরণ চাপিয়ে দিতে পারি না। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়।’ তিনি কেন মাথায় হিজাব পরেন এর জবাবে নাহলা বলেছেন, আমরা তিন বোন। দুই বোন হিজাব পরে না, আমি পরি। আমার প্রকৌশলী পিতা বলেছেন, সৌদি আরবে থাকতে হলে হিজাব পরতে হবে। ছোটবেলা থেকে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার বোনরা মিসরে পড়াশোনা করেছে, তারা হিজাব পরে না। আমি হিজাব নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন কারণ দেখি না। নাহলা আরও বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াত নিষিদ্ধকরণে যত বিলম্ব করবে বিপদের আশঙ্কা তত বাড়বে। কায়রোয় ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য আনোয়ার এল সাদাত বলেছেন, তিনি তাদের স্পীকারের সঙ্গে কথা বলবেন। মিসরের একটি সংসদীয় দল বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী। তাকে বলেছি, বিষয়টি আমি আমাদের রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাব। মিসরের সরকার এবং নাগরিক সমাজ মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তুরস্কের সচেতন নাগরিক সমাজও লড়ছে। এই দুই দেশসহ বাংলাদেশের মৌলবাদীরা একজোট হয়ে তাদের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে তুরস্ক ও মিসরের পাশাপাশি পাকিস্তানের সমমনাদের সমঝোতা ও ঐক্য এখন সময়ের দাবি। ২৯ জুন ২০১৬
×