ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আতঙ্কে অভিভাবকরা

নারায়ণগঞ্জে শিশু হত্যা বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২ জুলাই ২০১৬

নারায়ণগঞ্জে শিশু হত্যা বেড়েছে

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জে শিশু হত্যা বেড়েই চলেছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে ইদানিং নিষ্পাপ শিশুরা ঘাটতকদের টার্গেটের শিকার হয়ে নৃশংসভাবে জীবন দিচ্ছে। অভিভাবকরা আদরের ছোট্ট শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছে। মুক্তিপণ না পেয়ে ঘাতকরা শিশুদের হত্যা করছে। আবার বড়দের সঙ্গে শিশুরাও হত্যার শিকার হচ্ছে। আম গাছে ঢিল দেয়ার অপরাধেও এক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এতে অভিভাবক মহলে ছড়িয়ে পড়েছে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তারা সন্তানদের নিয়ে সারাক্ষণ থাকছে আতঙ্কে। সর্বশেষ ২২ জুন বন্দরের পশ্চিম কেওঢালা এলাকায় নাদিয়া নামে ৬ বছরের এক শিশুকে গলায় ফিতা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে দুই পাষ-। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, জেলা সদর, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, বন্দর ও সোনারগাঁও থানার বিভিন্ন স্থানে ইদানিং শিশু হত্যা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২২ জুন বন্দরের পশ্চিম কেওঢালা এলাকায় নাদিয়া নামে ৬ বছরের প্রথম শেণীর এক শিশু ছাত্রীকে গলায় ফিতা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে দুই পাষ-। অবশ্য এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত একই এলাকার আজিজুল ইসলাম ও আশিকুল ইসলাম নাদিয়া হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৫৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে তারা আদালতে জানায়, শিশুটিকে ধর্ষণের পর ঘটনাটি আড়াল করতেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। গত ১৮ জুন রূপগেঞ্জর নোয়াপাড়া এলাকায় তৌহিদ হোসেন (৭) নামে এক শিশুর লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। শিশুর পরিবারের অভিযোগ শিশুটিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আবার গত ২১ মে রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় সুমাইয়া (৮) নামে এক শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে মহিরুল ইসলাম (৩০) নামে একটি মসজিদের মুয়াজ্জিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১ মে আড়াইহাজারে আম গাছে ঢিল দেয়ার অপরাধে তানজিলা (৭) নামে এক শিশুকে মারধর করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সাদু মিয়া নামে এক পাষ-কে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁওয়ের টিপুরদী এলাকা থেকে আবির হোসেন নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই শিশুকে অজ্ঞাতনামা দু’ ব্যক্তি রিক্সাযোগে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছিল। পরে তারা রিক্সায় লাশটি ফেলে পালিয়ে যায়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর থানার চর সৈয়দপুর এলাকায় নিখোঁজের দু’ ঘণ্টা পর প্রণব বসু (৬) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই শিশুটি বাসা থেকে বের হয়ে দু’ ঘণ্টা পর লাশ হয়ে ফিরে। আবার গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের শহরের ২নং বাবুরাইলে পাঁচ খুনের ঘটনায় নৃশংসভাবে মা তাসলিমার সঙ্গে খুন হয় ১০ বছরের নিষ্পাপ শিশু শান্ত ও ৫ বছরের সুমাইয়া। মাহফুজ নামে এক পাষ- পুতা (শিল) দিয়ে ৫ খুনের সঙ্গে শিশু শান্ত ও সুমাইয়াকে নৃংশসভাবে হত্যা করে। গত ২৬ নবেম্বর আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের গিরদা গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী হযরত আলীর শিশু কন্যা স্থানীয় নজরুল ইসলাম বাবু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণীর ছাত্রী হাফছা আক্তার রূপা (৫) অপহৃত হয়। অপহরণকারীরা রূপার পরিবারের কাছে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে অপহরণকারীরা রূপাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরদিন ২৭ নবেম্বর রূপার লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ২৬ নবেম্বর বন্দর থানা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ বছরের শিশু আকিবের মরদেহ। তারও পেট কাটা ছিল। অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে রতন ও জাহাঙ্গীর নামের দুই মাদকাসক্ত যুবক আকিবকে হত্যা করে। গত ১৬ ডিসেম্বর আড়াইহাজার উপজেলার ইদবারদী গ্রামের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদের (১১) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১১ ডিসেম্বর ভোরে গ্রাম্য মক্তবে পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিয়াদ আর বাড়িতে ফিরেনি। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ৫ অক্টোবর আড়াইহাজার উপজেলার প্রভাকরদী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সোহাগ (১৪) বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ অক্টোবর সকাল থেকে উপজেলার প্রভাকরদী গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে সোহাগকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ৬ অক্টোবর সকালে শিশু সোহাগের স্কুলের কাছাকাছি একটি নির্জন পুকুর পাড়ে সোহাগের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পেয়ে লোকজন পুলিশে সংবাদ দিলে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। এভাবেই নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে শিশু হত্যা। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে অভিভাবকরা। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা আইরন নেছা জানান, নারায়ণগঞ্জে যে হারে শিশু হত্যা বেড়েছে তাতে আমার সন্তান যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে মেধাবী ছাত্র তানভীর মোঃ ত্বকী হত্যাসহ পুরো জেলায় এ পর্যন্ত কম করে হলেও ৩০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত একটি হত্যকা-েরও বিচার হয়নি। শিশু হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় দিন দিন শিশু হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, আমার মনে হয় শিশু হত্যার পিছনের রয়েছে সামাজিক অস্তিরতা ও অবক্ষয়। ইদানিং মোবাইল ফোনে ও ইন্টারনেটে অশ্লিল দৃশ্য দেখে প্রভাবিত হয়ে শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। শিশুরা আমাদের সকলের কাছে আদরের। আজকের শিশুরাই একদিন আমার মতো এসপি হবে, আপনার মতো সাংবাদিক হবে। তাই শিশুকে রক্ষা করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
×