ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাইল বসেছে ১৭টি, ঈদের ছুটিতেও কাজ চলবে

পদ্মা সেতুর স্প্যান আনতে ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠান চীনে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২ জুলাই ২০১৬

পদ্মা সেতুর স্প্যান আনতে ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠান চীনে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতুর স্প্যান আনতে ক্লিয়ারিং এবং ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠান এখন চীনে। বুধবার এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা চট্টগ্রাম থেকে চীনে রওনা হয়েছেন। স্প্যান তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য চীনের বন্দরে নেয়া হচ্ছে। আর বিদেশ থেকে আসা সেতুর পণ্য খালাস করতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান সেতুর গুরুত্বপূর্ণ চালান যথাযথভাবে দেশে নিয়ে আসতে কাজ করছে। এদিকে পদ্মায় আরও তিনটি পাইল স্থাপন হয়েছে। এ নিয়ে স্থাপিত পাইলের সংখ্যা ১৭। শনিবার স্থাপন করার কথা রয়েছে ৩৬ নম্বর পিলারের বাকি পাইলটি। এছাড়া ৩৪ নম্বর পিলারের পাইল স্থাপনের জন্য মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। এবারের ঈদেও পদ্মা সেতুর কাজ চলমান থাকবে। ছুটি পাচ্ছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে তারা ছুটি কাটাতে পারছেন ৫ জুলাই থেকে। তিন দিন ছুটি শেষে অবশ্যই ৮ জুলাই কাজে যোগ দিতে হবে। বর্ষার পানি তেড়ে আসছে। পদ্মায় স্রোত তীব্র এবং বৃষ্টি-বাদল থাকলেও নির্মাণযজ্ঞ এগোচ্ছে। শুক্রবার পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ছিল প্রায় ২৭ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে সেতুর অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে বুধবার জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের বিষয়টিও প্রকল্পে ছোঁয়া লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে এবং ২০১৮ সাল নাগাদ এ সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব হবে।’ তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাহসী নেতৃত্ব ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলেই বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে স্থানীয় সাংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি দাবি তুলেন পদ্মা সেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার। এ দাবি প্রকল্প এলাকায়ও জোরালো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী জানান, প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সেতুতে কর্মরতদের মাঝে উৎসাহ বেড়েছে। এই প্রকৌশলী বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোটা বাঙালীর সম্মান। যার দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। তাই এখানে কর্মরতরা শতভাগ আন্তরিকতায় কাজ করছেন। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক নানা ধরনের কর্মকা-ও চলছে চারিদিকে। প্রকল্প এলাকায় পাইল তৈরিসহ নানা কাজ হচ্ছে বিশাল ওয়ার্কশপে। চীনে চলছে সেতুর স্প্যান তৈরির কাজ। বেয়ারিংয়ের কাজও হচ্ছে চীনে ও যুক্তরাষ্ট্রে। আর জার্মানিতে চলছে হ্যামারের কাজ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেয়ারিংও ব্যবহার করা হবে পদ্মা সেতুতে। প্রতিটি বেয়ারিংয়ের ওজন ১০ টনেরও বেশি। পদ্মা সেতুর জন্য মোট ৯৬টি বেয়ারিং ব্যবহার করা হবে। পিলারে এসব বেয়ারিং ব্যবহার করা হলে ৭ দশমিক ৫ মাত্রায় ভূমিকম্প হলেও কোন সমস্যা হবে না। মূল সেতু যে ৪২টি পিলারের ওপরে দাঁড়িয়ে তার অগ্রভাগে গড়ে দুটি করে বেয়ারিং ব্যবহার করা হবে। কিছু পিলারে কমবেশি ব্যবহার করা হবে প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে। ভূমিকম্প ছাড়াও চারিদিকের নানা মুভমেন্ট কাভার করবে এসব বেয়ারিং। পিলারের উপর স্টিলপ্লেট বসিয়ে দেয়া হবে। মোট ১ লাখ ২৯ হাজার টন স্টিলপ্লেট ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যে ৫৯ হাজার টন স্টিলপ্লেট প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে গেছে। চীনের সুপার স্ট্রাকচার বিশাল ইয়ার্ডে থ্রিডি এ্যাসেম্বিংয়ে প্লেট তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যত স্থায়িত্ব বিবেচনায় পদ্মা সেতুতে বিশ্বের সেরামানের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কাঁচামাল থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত গুণগতমানের দিকে দেয়া হচ্ছে বিশেষ নজর। সেতুতে ব্যবহারের আগে দেশে এবং বিদেশে কয়েক দফা পরীক্ষা করা হয় এসব উপকরণ। তারপরই দেয়া হয় ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন। সরকারী পরিকল্পনায় পদ্মা সেতুর স্থায়িত্বকাল ধরা হচ্ছে ১শ’ বছর। এর আগে নির্মিত মেঘনা, মেঘনা-গোমতী ও যমুনা সেতুর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এবার দেশের সবচেয়ে বড় এ মহাপরিকল্পনায় আগে থেকেই নেয়া হচ্ছে সতর্কতা। মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক এবং সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে ব্যবহারের জন্য প্রায় প্রতিদিনই পদ্মা সেতুর ইয়ার্ডে নিয়ে আসা হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরণ। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টন সিমেন্ট, ৬ কোটি ২৪ লাখ ইট, ১২ লাখ কিউবিক মিটার পাথরকুচি, ১০ লাখ ১৩ হাজার কিউবিক মিটার বোল্ডার বা বড় পাথর এবং ১ লাখ ৯৩ হাজার কিউবিক মিটার নুড়িপাথর। তবে যেখান থেকেই উপকরণ সংগ্রহ করা হোক না কেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে মানের দিকে। প্রকৌশলীরা জানান, নিজস্ব ল্যাবরেটরি, বুয়েট, বিএসটিআইÑ এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে উপকরণগুলোর পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর যদি সেটা ভাল হয় তারপরই ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। উপকরণ পরীক্ষার পর যদি তথ্যের সঙ্গে না মিলে তাহলে সেটা আমরা গ্রহণ করি না। দুইবার পরীক্ষার পর যদি গুণগতমান না মিলে তাহলে সেটা কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। দেশীয় সিমেন্ট এবং দেশীয় বালি ব্যবহার করা হলেও পাথর যোগান দিতে হচ্ছে ভারত থেকে। আর নদী শাসনেও পরিবেশের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই ড্রেজিং এবং ড্রেজিংয়ের বালু রাখা বস্তা ফেলাসহ যাবতীয় কাজ পরিচালিত হচ্ছে। নদী শাসনের ক্ষেত্রেও নিয়মিত পানি পরীক্ষা করা হচ্ছে ঢাকার ল্যাবে। সেতুর জাজিরা প্রান্তের স্প্যান বসানো তথা সেতুর অবয়ব দৃশ্যমানে কাজ চলছে ধুমছে। স্প্যান আসার পরই যাতে পিলারের উপর বসিয়ে দেয়া যায়, সে লক্ষ্যেই কাজ এগিয়ে চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। জাজিরা প্রান্তের ৩৯, ৩৮ ও ৩৭ নম্বর পিলারে ৩টি করে পাইল স্থাপন করা হয়ে গেছে। ৩৬ নম্বর পিলারের আগেই স্থাপন হয়েছে দুটি পাইল। এখন হ্যামার ৩৬ নম্বর পিলারে অবস্থান করছে। এই পিলারে আরও একটি পাইল স্থাপন করা হবে। এরপরই পাইল ড্রাইভ হবে ৩৪ নম্বর পিলারে। টেস্ট পাইলের কাজও এগিয়ে চলছে। এদিকে আগামী ১৪, ১৫ ও ১৬ জুলাই প্যানেল অব এক্সপার্টদের সভা নিয়ে চলছে নানা প্রস্তুতি। এ সভার আগেই অনেক তথ্যাদি এবং ট্রেস্ট পাইলের রিপোর্ট সম্পন্ন করতে হবে। এ সভায় উপস্থাপন করতে হবে সেতুর চলমান কাজের নানা তথ্য-উপাত্ত। তাই সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সংশ্লিষ্ট অনেকে ঈদের ছুটি কাটছাঁট করছেন। প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন। তিন দিনব্যাপী এ সভায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১টি স্প্যান থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যান বড় হওয়ার কারণে রিইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এ সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২টি পিলার, যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে প্রায় ৬টি পাইল। এই সেতু বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেবে। পদ্মার ওপর এরকম সেতু অনেকের কল্পনারও বাইরে ছিল। কিন্তু এটি নির্মাণেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর অন্যতম পদ্মা। আর এই নদী দুই তীরকে সেতু দিয়ে বাঁধতেই চলছে সফল কর্মযজ্ঞ। পদ্মা এক অস্থির নদী। দুই তীরে ভাঙ্গাগড়া চলে প্রতিবছর। বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে স্রোতের বেগ এত বেশি থাকে যে, সেতুর নক্সা করার সময় প্রকৌশলীদের কাছে এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্র- দক্ষিণ এশিয়ার এ দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এ পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। উজান থেকে নেমে আসা এ স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে সেতুটিকে। সেই সঙ্গে নদীর দুই তীরে নদীশাসনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে এ দুই নদী। বলা যেতে পারেÑ এ দুই নদীর পলি জমেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অনেকখানি অঞ্চল। এ সেতুর নক্সা করার ক্ষেত্রে নদীবাহিত পলির বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। এখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকিও আছে। এসব নানা বিবেচনায় সেতুর ভিত্তির জন্য পাইলিং করতে হচ্ছে অনেক গভীরে। বিশ্বে কোন নদীর এতটা গভীরে গিয়ে সেতুর জন্য পাইলিংয়ের নজির খুব কম। প্রকৌশলীদের জন্য এটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ। এসব মোকাবেলা করেই এগোচ্ছে সেতুর কাজ। এদিকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকল্প এলাকায় নানা সময় পরিদর্শনে আসছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন। জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, সেতুতে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ প্রশাসন প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
×