ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

অস্তহীন সূর্য থেকে লিটল ইংল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৩ জুলাই ২০১৬

অস্তহীন সূর্য থেকে লিটল ইংল্যান্ড

২৩ জুন গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দিয়েছে। ভোটের ফল দেখে ইউরোপজুড়ে চলছে চরম উত্তাপ ও উত্তেজনা। উত্তেজনায় বিরক্তি প্রকাশ করে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আউট ইজ আউট’, এখন তারা যত তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই ভাল। কিভাবে কি হলো তা নির্ণয় এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি ঠেকাতে পশ্চিমা বিশ্বের প-িতকুল এখন জঁপমালায় বসছেন। বেশিরভাগ বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদের ধারণা ছিল, শেষ পর্যন্ত গণভোটের রায় ব্লকে থাকার পক্ষে আসবে। কিন্তু চিন্তার বিপরীতে ফল হওয়ায় উত্তেজনা ও কপালের ভাঁজ একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটা কাকতালীয় বিষয় অনেকে লক্ষ্য করেননি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভারতবর্ষে উদিত হয়েছিল ব্রিটিশরাজের নতুন সূর্য। সেই সূর্য অনেক আগে ডুবলেও তার শেষ রশ্মিটা বোধ হয় অস্তাচলে চলে গেল প্রায় আড়াই শ’ বছর পরে এসে আরেকটি ২৩ জুন তারিখে। কোন একটা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে এতবড় আন্তর্জাতিক আলোড়ন সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায়নি। গত প্রায় দুই-তিন মাস যাবত ব্রেক্সিট আছে ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে। মিডিয়ায় মেজর শেয়ার দখল করে রেখেছে ব্রেক্সিট। বাংলাদেশের সচেতন মানুষ এবং মিডিয়ায়ও তার প্রতিফল দেখা গেছে। এর সঙ্গত কারণও রয়েছে। এমন একটা সময় ছিল যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্তমিত হতো না। ব্রিটিশরাজের মর্যাদার প্রতীক বিশ্বের একমাত্র জাতীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক সর্বক্ষণ অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই উড্ডীন থাকত। এ জন্য ব্রিটেনকে বলা হয় গ্রেট ব্রিটেন। মরা গাঙ্গের মতো এখনও তার কিছু ছিটেফোঁটা চিহ্ন পাওয়া যায়। আমাদের বাড়ির কাছে ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়াসহ মূল ভূখ-ের বাইরে বিদেশে যুক্তরাজ্যের অধীনে এখনও ১৭টি টেরিটোরি বা অঞ্চল আছে, যার মধ্যে স্কটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, জিব্রালটার এবং আটলান্টিকের দ্বীপ বারমুডা, অ্যাসেনসন ও সেন্ট হেলেনা অন্যতম। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়ে সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে এবং বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য বজায় থাকে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। আজকের যে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ তা এক সময়ে এ রকম ছিল না। মধ্যযুগে সাম্রাজ্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ইউরোপের রাজতন্ত্রগুলোর মধ্যে ভয়ানক রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ হয়েছে। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ফ্রান্স দখল করতে চাইলে ১৩৩৮ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত এক শ’ বছরের অধিককাল দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলে। এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ। এর আগে রোমান সাম্রাজ্য এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহের সঙ্গেও ইংল্যান্ডের অনেক যুদ্ধ হয়। ১২৮৪ সালে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এক সঙ্গে যুক্ত হয়, যার আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ হয় ১৫৩৬ সালে ইউনিয়ন এ্যাক্টের মাধ্যমে। এরপর ১৭০৭ সালে যোগ দেয় স্কটল্যান্ড এবং ১৯২০ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ড। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সামান্য বর্ণনা তুলে ধরলাম এ কারণে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়তে দীর্ঘ সময় লেগেছে, রক্তক্ষয় হয়েছে, যুদ্ধবিগ্রহ কম হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একেকটি নক্ষত্রের পতন যখন শুরু হলো, তারপর শেষ সূর্য ডুবতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। গড়তে সময় লাগলেও ভাঙতে সময় লাগেনি। এই ভাঙ্গন এখন কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটাই দেখার বিষয়। যুক্তরাজ্য ছোট দেশ। উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও ইংল্যান্ড মিলে মোট আয়তন প্রায় আড়াই লাখ বর্গকিলোমিটারের মতো। বর্তমান জনসংখ্যা সাত কোটি বা কিছু বেশ। সারাবিশ্ব যখন তাদের অধীনে ছিল তখন লোকসংখ্যা ছিল এর অর্ধেক। ব্রিটেন পরে যত সমৃদ্ধ হয়েছে, প্রথম দিকে সেটা ছিল না। বিশ্বব্যাপী কয়েক শ’ বছরের শাসন ও শোষণ তাদের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছে। ব্রিটিশ জাতির মূল শক্তি ছিল ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম। ব্রিটিশদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি ট্র্যাডিশন ডাইহার্ড, অর্থাৎ ঐতিহ্যের মৃত্যু নেই। ঐতিহ্যের শক্তিই বড় শক্তি। কিন্তু গত ২৩ জুনের গণভোটের ফল দেখে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ জাতির ভয়ানক বিচ্যুতি ঘটেছে। ঐতিহ্য ও দেশপ্রেমের বদলে তাদের বিরাট অংশের মধ্যে উগ্রবাদ, চরমপন্থা ও বিদ্বেষ স্থান পেয়েছে। যার প্রমাণ মেলে ‘ব্রিটেন ফার্স্ট সেøাগানে’ এবং একজন উগ্রবাদীর হাতে উদারমনা এমপি জো ফক্সের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল পুরো ইউরোপ, বিশেষ করে ব্রিটেনের জন্য সারা বিশ্ব থেকে হাত গুটানোর টার্নিং পয়েন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়, যার চার কোটির অধীক ছিল বেসামরিক লোক। তাই ইউরোপের নেতৃবৃন্দ ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আর সংঘাত নয়, ঐক্যকে বেছে নেয় উন্নয়ন ও স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্য নির্ধারণের মূলমন্ত্র হিসেবে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব, পূর্ব ইউরোপ সোভিয়েতের করতলে চলে যাওয়া, স্নায়ুযুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বৈশ্বিক বাস্তবতা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে একত্রিত হওয়ার পেছনে অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে কাজ করে। এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স-জার্মানির নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপের ছয় রাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইকোনমিক কমিশন নামে যাত্রা শুরু করে ১৯৫৭ সালে। ব্রিটেন যোগ দেয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৬১ সালে যোগদানের জন্য আবেদন করলেও তখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জেনারেল শার্ল দ্য গলের বিরোধিতায় তা পাস হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিয়ে জার্মানির দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন জেনারেল দ্য গল। তখন দ্য গল আর চার্চিলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, নীতিনির্ধারণে দু’জনের বনিবনা হতো না। তাই যুদ্ধের পরেও দ্য গল সে কথা ভোলেননি এবং যুক্তরাজ্যকে আস্থায় নিতে সংশয় পোষণ করতেন। অনেক পথ পেরিয়ে অর্থনৈতিক জোট থেকে ক্রমান্বয়ে ১৯৯৩ সালে এসে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের অবয়বে আত্মপ্রকাশ করে বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। তারপর থেকে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সবক্ষেত্রে তারা বিশ্ব অঙ্গনে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে। আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপের সম্মিলিত স্ট্র্যাটেজিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। বিশ্ব ব্যবস্থা ও পাওয়ার ব্লকের সমীকরণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশ্ব ব্যবস্থার একচ্ছত্র নেতৃত্বে চলে আসে আমেরিকা, সঙ্গে ইউরোপ। কিন্তু তাদের হিসাব বেশিদিন ঠিক থাকেনি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুতিনের নেতৃত্বে আবার ঘুরে দাঁড়ায় রাশিয়া। একই সঙ্গে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক উত্থান এবং রাশিয়া-চীনের একই অক্ষে অবস্থান গ্রহণের ফলে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপ ওভার রিএ্যাক্ট করে ফেলে। রাশিয়ার দ্বারপ্রান্তে ন্যাটো সামরিক জোটের বাহিনী মোতায়েনের লক্ষ্যে সদ্য সোভিয়েতের কবল থেকে মুক্ত হওয়া পূর্ব ইউরোপের সকল দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য করে নেয়। ন্যাটোর এই উদ্দেশ্যের বাস্তব প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে। পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও বাল্টিক দেশসমূহে বড় আকারের ন্যাটো বাহিনীর মোতায়েন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ইইউতে অন্তর্ভুক্তির ফলে পূর্ব ইউরোপের তরুণ প্রজন্মসহ কার্যক্ষম মানুষ উন্নত জীবন ও কাজের আশায় দলে দলে পশ্চিম ইউরোপে ঢুকে পড়ে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, বেশি উদার, কল্যাণকামী রাষ্ট্র হওয়ায় সঙ্গত কারণেই পূর্ব ইউরোপ থেকে বিশাল অভিবাসন ঘটে যুক্তরাজ্যে। ব্রেক্সিটের সমর্থনকারীগণ অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে এক প্রকার উগ্র জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং, ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। এর ফলে ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর একটা এলোমেলো প্রভাব প্রাথমিকভাবে পড়তে পারে। তবে সেটি কাটিয়ে উঠতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না। সকলেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লাগসই নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে নেবে। কিন্তু এর রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তৃতি অনেক বড় হতে পারে। এটা কতদূর গড়াবে তা এখনও প্রিডিকশন করা যাবে না। ব্রিটেন কিভাবে-কতদিনে আউট হয়, সেটি দেখার বিষয় আছে। ব্রেক্সিটের উদাহরণে ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা উৎসাহিত হবে। তারা আপাতত ইইউ ছাড়ার কথা না বললেও তাদের চাপে সেসব দেশের অভিবাসন নীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য স্থান থেকে উগ্র ইসলামিস্ট তৎপরতার কারণে স্বদেশ ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া প্রায় অর্ধকোটি ভাসমান শরণার্থীর পুনর্বাসন সঙ্কট আরও তীব্র হবে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সবদিকে। উগ্রবাদী ইসলামিস্ট জঙ্গী ঘীরে বিশ্বব্যাপী যে নিরাপত্তার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে ব্রেক্সিটের ফলে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরে শুরু হয়ে গেছে টালমাটাল অবস্থা। লন্ডনের মেয়র সাদেক খান ইতোমধ্যে ব্রিটেন থেকে লন্ডনকে বিচ্ছিন্ন করতে গণভোটের দাবি তুলেছেন। লাখ লাখ মানুষ সাদেক খানের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে দরখাস্তে সই করেছেন। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নে জোটভুক্ত থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এই দুই রাজ্য থেকে অচিরেই স্বাধীনতার দাবি আরও জোরদার হবে বলে সবাই মনে করছেন। তারপর সবে ধন নীলমণি ওয়েলস একদিন বের হওয়ার দাবি তুললে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তারপর লিটল ইংল্যান্ডই হবে ব্রিটিশরাজের একমাত্র অবলম্বন। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×