মুসলিম জাহানে দুটি বড় আনন্দ উৎসব গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয় যার একটির নাম ঈদ-উল-ফিতর আর অন্যটির নাম ঈদ-উল-আযহা। ঈদ-উল-ফিতর হচ্ছে সিয়াম ভাঙ্গার আনন্দ উৎসব, এর আরেক অর্থ হচ্ছে দানের আনন্দ-উৎসব। ঈদ-উল-আযহা অর্থ কোরবানির আনন্দ উৎসব।
কুরআন মজীদে একটি স্থানে কেবল ঈদ শব্দের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায় আর তাও হযরত ঈসা আলায়হিস সাল্লামের একটি দু’আ হিসেবে। ইরশাদ হয়েছে : মারইয়াম তনয়, ঈসা বলল : হে আল্লাহ আমাদের রব! আসমান হতে আমাদের জন্য খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন তা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য হবে ঈদ এবং আপনার নিকট হতে নিদর্শন। (সূরা মায়িদা; আয়াত ১১৪)।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মনওয়ারায় এলেন, এখানে এসে তিনি মসজিদুন নববী কেন্দ্রিক একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করলেন। ইতোমধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, জুমার সালাত কায়েম হয়েছে। মদীনায় এসে তিনি জানতে পারলেন মদীনার ইয়াহুদীরা আশুরায় সিয়াম পালন করে। তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ আশুরার সিয়াম পালন করেন। তিনি লক্ষ্য করলেন এখানকার অধিবাসীগণ বছরে দুটি আনন্দ উৎসব পালন করে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস রাদি আল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এসে দেখলেন যে, তাদের দুটো উৎসবের দিন রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : এই দুটো দিন কিসের জন্য? তারা বলল, এই দুই দিনে অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম, আমোদ-ফুর্তি করতাম। এই কথা শুনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ এই দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুটি দিন তোমাদের দিয়েছেন আর তা হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য ফেব্রুয়ারি মোতাবেক দ্বিতীয় হিজরীর মধ্য শাবানে আল্লাহ রমাদান মাসকে সিয়াম পালন করার জন্য নির্ধারণ করে দিলে সেই বছর প্রথম রমাদান মাসে সিয়াম পালিত হয়। এই রমাদানের ১৭ তারিখে বদরের যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলে এক অনন্য আনন্দের অনুভবে প্রথম ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হলো। এই ঈদ-উল-ফিতরের সালাত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইমামতিতে কয়েক হাজার সাহাবী ঈদের সালাত আদায় করলেন মসজিদুন নববী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩৬০ মিটার দূরে এক খোলা ময়দানে। ঈদ-উল-ফিতরের দুই রাক’আত সালাতের জামাআত অনুষ্ঠিত হয়। আর মক্কা মুকারমায় সর্বপ্রথম ঈদের জামাআত অনুষ্ঠিত হয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের ৯ দিন পর। ঈদ-উল-ফিতরের সঙ্গে বিজয়ের যেন এক মহা যোগসূত্র রয়েছে। রমাদান মাসের এক মাস সম্পূর্ণ দিবাভাগে দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে সুবিহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকারের পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে বিরত রেখে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তারই বিজয় অনুভব দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে ১ শওয়াল ঈদ-উল-ফিতরের দিনে। হাদিস শরীফে আছে যে, সশস্ত্র যুদ্ধ হচ্ছে ছোট যুদ্ধ আর নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে বড় যুদ্ধ বা জিহাদে আকবর।
যে মানুষ নফ্্সকে দমন করতে পারে, ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই কেবল প্রকৃত মানবতার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। ইনসানে কামিল বা কামিল মানুষ গুণে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে। রমাদান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই বিরাট সাফল্য অর্জন হতে পারে। যে কারণে রমাদানে সিয়াম পালনের মহা প্রশিক্ষণ লাভ করার পর ঈদ-উল-ফিতরের আগমন এক বিশেষ তাৎপর্যম-িত হয়। হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, লোভ নয়, অহমিকা নয়, কাম নয়, ক্রোধ নয়, সংযমী জীবন, সংযম ও সহিষ্ণু জীবনই প্রকৃত মনুষ্য জীবন। তাই সব মানুষ মিলে এক মহামিলনের বিশ্ব গড়ে তুলবার দৃঢ় প্রত্যয় জাগ্রত হয় ঈদ-উল-ফিতরে। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। ঈদ-উল-ফিতরে এই মূল্যবোধের বাস্তব স্ফুরণ ঘটে। ঈদ-উল-ফিতরকে ফিতরা দানের আনন্দ-উৎসবও বলা হয়। ঈদ-উল-ফিতরের সালাতে যাবার পূর্বের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে দরিদ্রজনদের মধ্যে বিধি মোতাবেক ফিতরা বণ্টন করা। ফিতরা দেয়াটা ওয়াজিব। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফিতরা সিয়ামকে কুকথা ও বাহুল্য বাক্য হতে পবিত্র করে এবং গরিব দুঃখী অসহায় মানুষের আহার্য যোগায়। তিনি আরও বলেছেন : ফিতরা যারা দেয় তোমাদের সেইসব ধনীকে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র করবেন এবং তোমাদের মধ্যে যারা দরিদ্রজনকে দান করে আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়ে অধিক দান করবেন। ঈদ পরিচ্ছন্ন আনন্দের দিন, আল্লাহর মহান দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করার দিন। এই দিনে যাতে গরিব-দুঃখীরা ধনীদের সঙ্গে আনন্দের সমান ভাগীদার হতে পারে সেজন্য গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার দিন। যাকাত পাবার অধিকারী যারা ফিতরা পাবার অধিকারী তারাই। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না এই অসম অবস্থার দেয়াল ইসলাম চূর্ণ করেছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে ভিক্ষুকের এবং বঞ্চিতদের। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)। রমাদানের এক মাস পালন করার মাধ্যমে সায়িম বা ধৈর্য, দয়া, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সংযম এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে সেই প্রশিক্ষণকে জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের দৃঢ় শপথে বলীয়ান হওয়ার পরিচ্ছন্ন আনন্দ উৎসব হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর। এই দিন আনন্দ করার এবং আনন্দ বিলাবার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত যুগ শ্রেষ্ঠ সূফী হযরত মওলানা শাহ সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন : প্রকৃত রোজাদারের জন্য পৃথিবীতে জান্নাতী সুখের নমুনা।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারীয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: