ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শয্যা ফাঁকা তবু ফিরছে রোগী, প্রশ্ন মমতাকেই

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৮ জুলাই ২০১৬

শয্যা ফাঁকা তবু ফিরছে রোগী, প্রশ্ন মমতাকেই

অনলাইন ডেস্ক ॥ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গরিব মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য। কিন্তু তাঁর রাজ্যেই সরকারি হাসপাতালগুলিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক শয্যা সংরক্ষিত থাকছে ভিভিআইপি-দের জন্য। চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন মুমূর্ষু মানুষ। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি করলে সরতে হচ্ছে হাসপাতালের সুপারকে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এই দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারি চিকিৎসকদের একটি অংশ চিঠি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিভিন্ন হাসপাতালে এত দিন শয্যা সংরক্ষণ নিয়ে গোলমাল চলছিল। পরে সেই সমস্যা স্বাস্থ্য দফতরেও জানানো হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় এ বার সোজা মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছে গেল চিকিৎসকদের চিঠি। সরকারি হাসপাতালে, বিশেষত মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অধিকর্তা, সুপার, ডেপুটি সুপার, সহকারী সুপাররা বেশ কিছু শয্যা সকালেই ‘বুক’ করে রাখেন ভিআইপি-দের সুপারিশের জন্য। কখনও সেগুলি কাজে লাগে, কখনও লাগে না। কিন্তু ওই আগাম বুকিংয়ের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হয় বহু মুমূর্ষু রোগীকে। হয়তো কোনও রোগী হাসপাতালে এসে শয্যা পেলেন না। তাঁদের বলা হল, ‘কিচ্ছু খালি নেই।’ অথচ চোখের সামনে তাঁরা দেখলেন, বেড-ট্রলি খালি পড়ে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ নিয়ে রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গোলমাল, এমনকী হাতাহাতিও বাধে। আসল কথা হল, সেই শয্যাগুলি কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ বুক করে রেখেছেন! সেই বুক করে রাখা শয্যায় যাঁরা ভর্তি হন, সব সময়ে তাঁরাও যে গুরুতর অসুস্থ, এমনটাও নয়। সম্প্রতি বেড বুকিং-এর প্রক্রিয়া বাতিল করার নোটিস দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রোষে পড়েছিলেন এসএসকেএমের তৎকালীন সুপার মানস সরকার। ভিআইপি-দের জন্য আগাম রাখা শয্যা যাতে প্রয়োজনে অন্য কোনও মুমূর্ষু রোগীকে তাৎক্ষণিক ভাবে দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে গত ২৩ জুন নোটিস জারি করেছিলেন তিনি। সেখানে নিজের স্বাক্ষরের পাশাপাশি অধিকর্তার তরফেও স্বাক্ষর করেন তিনি। পরের দিনই তাঁকে শো কজ করেন অধিকর্তা স্বয়ং। জানতে চান, অনুমতি না নিয়ে কেন ওই নোটিস জারি করা হল? আবার ওই ২৪ তারিখেই নীলরতন সরকার, বাঁকুড়া সম্মিলনী এবং মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের সুপারদের পাশাপাশি বদলি করা হয় মানসবাবুকেও। তাতেই চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, বেড বুকিং-এর বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতেই স্বাস্থ্য ভবনের এমন সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গোটা বিষয়টি জানিয়ে এর বিহিত চেয়েছেন তাঁরা। এসএসকেএমের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘এক সুপারকে প্রতিবাদ করে সরতে হল। অন্য সুপার এলেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাল না। এখন তো খোদ অধিকর্তার কাছ থেকেই ফোন আসে। আমরা তিতিবিরক্ত।’’ মেডিসিন বিভাগের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘হয়তো কোনও রোগীকে তখনই ভর্তি করা দরকার বলে আমরা লিখে দিচ্ছি, কিন্তু বেড না থাকার অজুহাতে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরাও দেখছি বেড খালি পড়ে রয়েছে, কখন কোন ভিআইপি-র ফোন বা চিঠি নিয়ে কেউ আসবেন, সেই অপেক্ষায়। দিনের পর দিন এটা মেনে নেওয়া যায় না। রোগীর বাড়ির লোকেরা এ সব জানেন না বলেই তাঁরা ডাক্তারদের উপরে চড়াও হন। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল ‘টার্গেট’।’’ অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। একই বক্তব্য অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলির ডাক্তারদেরও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের এক ডাক্তার বলেন, ‘‘আমরা রোগীদের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারছি না কর্তৃপক্ষের একাংশের জন্য। এটা খুবই যন্ত্রণার।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিকিৎসকদের বক্তব্য, জেনে বা না জেনে এমন বহু দুর্ঘটনার দায় তাঁদের উপরে এসে পড়ে। অথচ এর সঙ্গে তাঁরা কোনও ভাবেই যুক্ত নন। বিভিন্ন বিভাগের ইউনিটগুলির জন্য আলাদা করে শয্যা ভাগ করে রাখার জন্যও সমস্যা হয়। হয়তো ইউনিট ১-এ কোনও শয্যা নেই, রোগী ফিরে যাচ্ছে। আর ইউনিট ২-এ চার-পাঁচটি শয্যা খালি। ভাগাভাগি না থাকলে ওই শয্যাগুলিতে রোগীদের ঠাঁই দেওয়া যেত।’’ বেড বুক করে রাখার এই প্রবণতা অবিলম্বে সমস্ত হাসপাতালেই বন্ধ হোক— চাইছে সরকারি চিকিৎসক মহল। চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস এবং প্রোগ্রেসিভ ডক্টসর অ্যাসোসিয়েশন-এর নেতারা বলেন, ‘‘বেড বুকিং-এর ব্যাপারে সরকারি তরফে কোনও নির্দেশিকা আছে বলে শুনিনি। থাকার কথাও নয়। কারণ গোটা ব্যাপারটাই বেআইনি। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন হাসপাতালে বেড আটকে রাখার চেষ্টা হলে সেটা পুরোপুরি অনৈতিক।’’ স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠির প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন। তবে স্বাস্থ্য দফতরের অন্য এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ডাক্তারদের ক্ষোভ স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা স্পষ্টই জানাচ্ছি শয্যা সংরক্ষণের কোনও নির্দেশ সরকারি ভাবে কখনও দেওয়া হয়নি।’’ তা হলে দিনের পর দিন সংরক্ষণ হচ্ছে কোন অদৃশ্য নির্দেশে, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×