ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এ কোন্ অভিশাপ! এ দায় কার?

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১০ জুলাই ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ এ কোন্ অভিশাপ! এ দায় কার?

শুরুতেই বলব গুলশান হামলা নিয়ে গুজব বা মনগড়া কাহিনী বানাবেন না। সামাজিক মিডিয়ার বড় বিপদ তার ইচ্ছেমতো বলা বা লেখার অবাধ স্বাধীনতা। অন্তত এমন জটিল বিষয়ে আমরা যেন তার শিকার না হই। একবার ভেবে দেখুন কি নির্মম, নৃশংস এই হত্যাকা-। মারার আগে ধর্মের নামে যে মাতম বা তার অপব্যবহার তাকে কেন ধর্মের দোষ মনে করছি আমরা? এতো বিকৃত মস্তিষ্ক বিকৃত মনের কিছু অপরাধীর তা-ব। যারা দুনিয়াজুড়ে হত্যার খেলায় মারবার নেশায় মেতে উঠেছে। এরা যাদের মেরেছে তাদের ভেতর মুসলিম ছিল না? ছিল। ছাড় পায়নি। কারণ এদের মনমতো বিশ্বাসের জবাব দিতে পারেনি বলে। এরা কারা? সাধারণভাবে কিছু হলেই আমরা মাদ্রাসার দিকে আঙ্গুল তুলি। সংসারে পরিবারে সবচেয়ে কম মেধাবী বা গরিব ছেলেটিকে পাঠানো হয় সেখানে। কোন্ বিত্তবানের ছেলে যায় মাদ্রাসায়? এই দরিদ্র শিশু-কিশোর বা যুবকদের নিয়ে রাজনীতি, খেলাধুলা না করলে তারা সেই চার দেয়ালের বাইরে পা বাড়ায় না। যখন শাপলা চত্বরের ঘটনা হলো কি দেখলাম আমরা? বাতি নিভিয়ে দেয়ার পর তাদের ছোটাছুটি আর ভয়ার্ত পলায়ন। এমনও দেখা গেছে পুলিশকেই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সেসব কিশোর বা যুবক রাজনীতির শিকার বটে, কিন্তু জঙ্গী ছিল না। তারা কোন অস্ত্র বয়ে আনেনি। তাদের হাতে ছিল না অটোমেটিক রাইফেল বা বোমা। আজ আমরা কি দেখছি? জীবনভোগী বিত্তবান ধনীদের ছেলেরা এসেছিল মানুষ মারতে। যারা এ যাবত শনাক্ত হয়েছে তাদের বয়স ও পরিবার বিবেচনায় তারা কি এমন হিংস্র ও মৌলবাদী হবার কথা? কিন্তু তারাই করেছে এই বর্বরোচিত কাজ। খোলা দুনিয়ার বিশাল জগত যখন তাদের উদার দিগন্তে নেয়ার কথা তখন তারা প্রেম, ভালবাসা ও জীবনের চাইতে এমন এক বিষয়কে মুখ্য মনে করেছে যার পরিণতি মৃত্যু। এ কেমন চিন্তা? একবার ভেবে দেখুন এরা নিজেদের জীবনকে কতটা তুচ্ছ মনে করেছে। জীবনবোধের এমন অভাব আর পরিবর্তিত মানসিকতা কি পরিবারের চোখে একবারও ধরা পড়েনি? খবরে দেখলাম এদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি বেশ কিছুদিন নিখোঁজ ছিল। কেমন করে হয় তা? অভিভাবকরা কোথায় ছিলেন? আমাদের সময় তো এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় গিয়ে না ফিরলে বিকেল থেকে মাইকিং করে খোঁজা হতো। আমার নিজের বেলায় বিয়ের পরও দেরি করে বাড়ি ফিরলে মা দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির পাশের লাইটপোস্টের তলায়। তবে কি মা-বাবাদের সময় নেই আর? কম্পিউটার ফেসবুক মোবাইল পার্টি রোজগারের আকর্ষণে তারা সন্তানের খবরও রাখেন না? ছেলে কোথায় যাচ্ছে কার সঙ্গে মিশছে কি তার চাওয়া, মা জানবে না? বাবা খবর রাখবে না? নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ব্যবস্থা নেবেন না? বড়লোক বা উচ্চবিত্তদের ঘরে এখন সাপ কিলবিল করছে। তাদের জীবন ও জীবনবোধের ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে কঠিন মৌলবাদ। লেখাপড়ার নামে সার্টিফিকেট আর প্রাইভেটের চাপে দিশাহারা তারুণ্য কোথায় মুক্তি চাইছে, কি তার কামনা কি তার অপরাধবোধ ও দায় এর জবাব খুঁজতে হবে এখন। তা না হলে গুলশানের মতো হামলার হাত থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না। কারণ, এরা ইচ্ছাকৃত মগজ ধোলাইয়ের শিকার। অর্থবিত্ত নারী বা অন্য লোভে নয়, এদের বিকৃতির কারণ আরও গভীর কোন হতাশার। ভাবতেই পারছি না সেসব মানুষের কথা যারা একটু আগেও জানত না কি নির্মম মৃত্যু ওঁৎপেতে আছে। অপরাধহীন মানুষের গলা কেটে হত্যা যারা দেখল তারা জানে বেঁচে আছে বটে! আসলে কি তারা আর কোনদিন স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবে? একবার নিজেকে দিয়ে ভাবুন। আপনি দেখছেন আপনার সামনে গলা কেটে ছেড়ে দেয়া মানবসন্তান ছটফট করে মারা যাচ্ছে। এই বিভীষিকার নাম ধর্মযুদ্ধ? বাংলাদেশ এমনটি কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। মায়ার দেশ, অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ নামে পরিচিত আমাদের আকাশে আজ আবির নয়, রক্তের মেঘ। আমাদের সবুজ মাটিতে আজ ছোপ ছোপ লাল দাগ। আমাদের উঠোনে রক্তমাখা পায়ের চিহ্ন। আমাদের সবার আতেই কি দু’এক ফোঁটা রক্ত এসে দাগ দিয়ে যায়নি? আহারে সেই মধ্যবয়সী মায়াবী রমণীর মুখ। আহা সেই যুবকের স্বপ্নমাখা অবয়ব। মৃত বিদেশীরা একবার কি আর্তচিৎকারে নিজেদের ভাষায় ঈশ্বরকে ডেকেছিলেন তাঁদের বাঁচাতে? ঈশ্বর নিজেই হয়ত অসহায়ের মতো তাকিয়েছিলেন উন্মাদ হত্যাকারীর দিকে। ভাবছিলেন এই আমার অমৃতের সন্তান? এই সৃষ্টির সেরা জীব? এরপর শোলাকিয়া। ঈদের জামাতও অনিরাপদ। সব নাকি শিক্ষিত? সব নাকি এলিট। এ কোন্ সমাজ? এ কোন দেশ আমাদের? কোথায় মাতা-পিতা, কোথায় অভিভাবক? ধিক আমাদের। কে ফেরাবে এদের? রেডিও টিভি বা সরকার? কখনও তা হবে না। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মলিন বেদনার্ত মাথানিচু করার সংবাদ শিরোনাম। দেখে আমরাও লজ্জায় মরে যাই। মনে মনে কাঁদি আর বলি তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। আসুন গলা জড়িয়ে কাঁদি আমরা। কান্নায় ধুয়ে ফেলি রক্তের দাগ। [email protected]
×