ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আব্বাস কিয়ারোস্তামির মৃত্যুতে বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে শোক

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১০ জুলাই ২০১৬

আব্বাস কিয়ারোস্তামির মৃত্যুতে বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে শোক

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা, কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়া একমাত্র ইরানী নির্মাতা, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রশিল্পী আব্বাস কিয়ারোস্তামির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষরা। গত সোমবার প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানায় প্যারিসে বসবাসরত এই চলচ্চিত্রকার কিছুদিন ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুতে হলিউডের পরিচালক মার্টিন স্করসেস বলেন, তিনি ছিলেন বিশেষ মানুষ; শান্ত, সৌম্য, বিনয়ী, স্পষ্টভাষী ও শক্তিশালী পর্যবেক্ষক। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের লোক, আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা শিল্পী। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের, যারা চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারত। নিউইয়র্কের চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি গণমাধ্যম কিয়ারোস্তামির জন্য শোক জানিয়ে বলেছে, বিশ্ব খুব সম্ভবত তার সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে হারাল। ৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রযোজনায় জড়িত কিয়ারোস্তামি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ২০০৮ সালে ফ্রান্সে তার তোলা আলোকচিত্রের একটি প্রদর্শনী হয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রেও কিয়ারোস্তামিকে প্রভাবশালী হিসেবেই গণ্য করা হয়। কিংবদন্তি ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ লুক গদারও আব্বাস কিওরোস্তমির অনুরক্ত ছিলেন। গদার একসময় বলেছেন, চলচ্চিত্রের শুরু ডি.ডব্লিউ গ্রিফিথের হাত ধরে, শেষে থাকবেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। ‘টেস্ট অব চেরি’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দ্য’র পান কিয়ারোস্তামি। তিনিই কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়া একমাত্র ইরানী। তার ‘টেন’ চলচ্চিত্রও একই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ১৯৪০ সালে তেহরানে জন্ম নেয়া এ চলচ্চিত্রকার গত শতকের ৬০ দশকে ইরানিয়ান নিউ ওয়েভ (নবতরঙ্গ) চলচ্চিত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। চলচ্চিত্রে পার্সি কবিতার কথোপকথন ব্যবহারের জন্য ওই আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত হিসেবেও গণ্য করা হয়। ইরানের চলচ্চিত্রের শেকড় এবং আবেগকে বিশ্বের কাছে হাজির করারও অন্যতম কৃতিত্ব কিয়ারোস্তামির। গত শতকের ৬০-র দশকের ইরানের নিউ ওয়েভে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সাধারণ মানুষকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছিলেন, যেখানে দৈনন্দিন বাস্তবতা, ইরানের জীবনধারা আর ঐতিহ্যই মূল হিসেবে চিত্রিত হতো। ওই ধারাতেই জীবনভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন কিয়ারোস্তামি। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক হামিদ দাভাসি বলেন, তার দৃশ্যায়নে ফুটে উঠত ইরানের শেকড়ের বাস্তবতা, গ্রামের কথা; আবার তিনি একই সঙ্গে ওই জীবনধারাকেই সমগ্রের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারতেন; এটাই তার শিল্পের স্বকীয়তা ছিল। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ফাইন আর্টসের ছাত্র কিয়ারোস্তামি প্রথম দিকে ইরানী টেলিভিশনের জন্য বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর সমসাময়িক অন্য চলচ্চিত্রকাররা দেশান্তরিত হলেও কিয়ারোস্তামি ইরানে থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামিক বিপ্লবের দুই বছর আগে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত তার ‘দ্য রিপোর্ট’ চলচ্চিত্রটি বিপ্লবের পর নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও দমে যাননি তিনি। তৎকালীন বিপ্লবী সরকার চলচ্চিত্রকে ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মনে করলেও পরে ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ ক্ষতিগ্রস্ত না করে বানানো চলচ্চিত্রকে অনুমোদন দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর ১৯৮৭ সালে ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ অবলম্বনে কিয়ারোস্তামি নির্মাণ করেন ‘হয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম’। ইরানের আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মহসিন মাখমালবাফের চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তব কাহিনী নিয়ে কিয়ারোস্তামি ১৯৯০ সালে নির্মাণ করেন ‘ক্লোজ আপ’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; মুক্তি পাওয়ার পর এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর একে একে তিনি নির্মাণ করেন ‘লাইফ এ্যান্ড নাথিং মোর’ (১৯৯২), ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’ (১৯৯৪), ‘টেস্ট অব চেরি’ (১৯৯৭), ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আজ’ (১৯৯৯)। উগান্ডায় এইডসের বিস্তার নিয়ে তিনি ২০০১ সালে নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘এবিসি আফ্রিকা’; এখানেই কিয়ারোস্তামি প্রথম ব্যবহার করেন ডিজিটাল ক্যামেরা। পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির এই আধুনিকতার প্রশংসাও করেন তিনি। এরপরের বছর ভাড়ার ট্যাক্সিতে দুটো ছোট ক্যামেরা জুড়ে দিয়ে বানান ‘টেন’। কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রে শিশুদের চপলতা আর দরিদ্র ইরানীদের সাধারণ জীবন বেশি প্রাধান্য পেলেও তা কখনও ব্যাপক মাত্রার ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠেনি বলে সমালোচকদের ভাষ্য; যদিও জাফর পানাহির জন্য তার লেখা বেশকিছু চিত্রনাট্যের রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল বেশ তীক্ষè। এর একটি ‘ক্রিমসন গোল্ড’। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া এ চলচ্চিত্রে এক পিজা-ডেলিভারি যুবকের চোখ দিয়ে পানাহি ইরানের শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে তুলে ধরেন। বাইরে ব্যাপক প্রশংসিত হলেও ইরানে বেশ সমালোচিত এ চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ হয়। ২০০৫ সালে কিয়ারোস্তামি ব্রিটিশ পরিচালক কেন লোচ ও ইতালির ইরমাননো অলমোর সঙ্গে ‘টিকেট’ নামে তিন পর্বের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০০৮ সালে কিয়ারোস্তামি নির্মাণ করেন ‘শিরিন’, ২০১০ এ ‘সার্টিফায়েড কপি’। ২০১২ সালে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ মুক্তি পায়। কিয়ারোস্তামি পারভিন আমির-ঘোলিকে বিয়ে করলেও পরে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই দম্পতির আহমাদ এবং বাহমান নামে দুই ছেলে আছে বলে জানা গেছে।
×