ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরো ফুটবল ২০১৬, ফাইনালে মুখোমুখি দু’দল

পর্তুগালের ইতিহাস নাকি ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার?

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১০ জুলাই ২০১৬

পর্তুগালের ইতিহাস নাকি ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার?

মোঃ মামুন রশীদ ॥ কেউ কারও চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়ার দিক থেকে হিসাব করলে শক্তিমত্তায় সমবিন্দুতেই আছে ফ্রান্স আর পর্তুগাল। কিন্তু এরপরও ফ্রান্সকেই এগিয়ে রাখতে হবে ইউরোপ সেরার মুকুট জয়ের ক্ষেত্রে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হতো সবাই মনে করবেন তারা স্বাগতিক হওয়ার জন্যই এগিয়ে। কিন্তু এর চেয়েও বড় হিসাবটা হচ্ছে অতীত রেকর্ড। ১৯৭৫ সালের পর থেকে পর্তুগালের কাছে পরাজিত হয়নি ফরাসীরা। আর ফুটবলের ইতিহাসে বড় কোন টুর্নামেন্টের লড়াইয়ে ফ্রান্সকে হারাতেও পারেনি পর্তুগীজরা। এমনকি ইউরো ফুটবলেও আজ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। অপরদিকে ফ্রান্স হয়েছে দুইবার ইউরো চ্যাম্পিয়ন। অতীত আঁকড়ে বর্তমান কোনকিছু বিবেচনা করা যায় না, কিন্তু এই পরিসংখ্যানগুলো কিছুটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বৈকি। যদিও এবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগাল যেন নতুন এক ইতিহাস গড়ার একটি সুর তুলেই চলতি আসরে এগিয়ে চলেছে। ২০০৪ সালে একবারই ফাইনাল খেলে শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ ঘুঁচাতে হলে নতুন ইতিহাসই গড়তে হবে পর্তুগীজদের। আর ফরাসীরা ১৬ বছর পর মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে ঘরের মাটিতে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারের। বাংলাদেশ সময় আজ দিবাগত রাত ১টায় সেন্ট ডেনিসের স্টেড ডি ফ্রান্স স্টেডিয়ামে উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের শিরোপা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে ফ্রান্স-পর্তুগাল। আজ পর্যন্ত দু’দল কোন বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়নি। ইউরো কিংবা বিশ্বকাপ বড় এ দুটি আসরেও আগে ফাইনাল খেলার রেকর্ড মাত্র একবারই আছে পর্তুগালের। ২০০৪ সালের ইউরোতে ফাইনাল খেলেছিল তারা। গ্রুপ পর্বে গ্রীসের কাছে হেরে শুরু করা দলটি ফাইনালেও তাদের কাছেই পরাজিত হয়ে প্রথমবার কোন বড় টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। সেই দুঃখটা ভুলবার নয় কখনও। ১২ বছর আগের সেই ফাইনালটা খেলেছিলেন তরুণ রোনাল্ডো। এবার তার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে কান্না ভুলে যাওয়ার। অনেক পরিণত এবং দলের অপরিহার্য, নির্ভরযোগ্য ও প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস এ ফরোয়ার্ডের এবার সুযোগ পর্তুগীজদের ফুটবল ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের। তরুণ রোনাল্ডোর প্রথম কোন বড় আসরে অংশগ্রহণের বছর ২০০৪ সালেই যে সাফল্য পেয়েছিল পর্তুগাল সেটাই এখন পর্যন্ত তাদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এবার সেটাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ। অবশ্য, গ্রুপ পর্ব থেকে তেমন সুবিধাজনক হয়নি পর্তুগীজদের অভিযান। বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই তারা প্রি-কোয়ার্টারে ওঠে সেরা তৃতীয় দল হিসেবে। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে না হারলেও হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড কিংবা অস্ট্রিয়া কাউকে হারাতেও পারেনি পর্তুগীজরা। সবগুলো ম্যাচ ড্র করে এবং এবার ইউরোর কলেবর বৃদ্ধি ও নিয়মে পরিবর্তন হওয়ার সুবাদেই তারা গ্রুপ পর্বে উতরে যায় সেরা তৃতীয় দল হিসেবে। এরপর ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ১-০ গোলের জয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে, পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-১ ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে ৫-৩ গোলের জয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে রোনাল্ডোরা। সেমিতে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল পর্তুগীজদের জন্য। চলতি টুর্নামেন্টে নবাগত হিসেবে ওয়েলস দুর্দান্ত খেলছিল এবং তারা প্রথমার্ধে চেপেই ধরেছিল রোনাল্ডোদের। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে নিজের ক্যারিশমা দেখিয়েছেন সিআর সেভেন। নিজে গোল করেছেন এবং আরেকটি গোল করিয়েছেন। ফলে ওয়েলসকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কোন বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে পা রাখে পর্তুগাল। ১২ বছর আগে পাওয়া সুযোগ হারিয়ে ফেললেও এবার কোনভাবেই সেটা হাতছাড়া করতে চান না রোনাল্ডো। যদিও তিনি ফ্রান্সকেই ফেবারিট মানছেন। কিন্তু ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরাই চ্যাম্পিয়ন হবো। আমি ক্লাব পর্যায়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে সবকিছুই জিতেছি এবং পেয়েছি। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে এবার কিছু জিততে চাই।’ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অনেক দেনা-পাওনার হিসাব আছে পর্তুগীজদের। এর আগে ইউরোর দুটি ফাইনালে এই ফরাসীদের জন্যই উঠতে ব্যর্থ হয়েছে পর্তুগাল। ১৯৮৪ সালের সেমিফাইনালে ৩-২ গোলে এবং ২০০০ সালের সেমিতে অতিরিক্ত সময়ের খেলায় ২-১ গোলে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছে পর্তুগীজরা। আর বড় টুর্নামেন্টে ফরাসীদের হারাতে না পারার জমাট বাঁধা আক্ষেপেরও শোধ নিতে চায় তারা। পর্তুগীজরা বড় হুমকি। এবার স্বাগতিক হিসেবে শুরু থেকেই ফেবারিট ছিল ফ্রান্স। সে হিসেবে ফাইনালেও উঠে এসেছে তারা। ‘এ’ গ্রুপ থেকে শীর্ষস্থান দখল করেই ফাইনালে ওঠে তারা। রোমানিয়া ও আলবেনিয়ার বিরুদ্ধে কষ্টার্জিত জয় তুলে নিলেও সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবশ্য গোলশূন্য ড্র করে ফ্রান্স। তবে নকআউট পর্ব থেকে নিজেদের বদলে ফেলে দলটি। দিদিয়ের দেশম দারুণভাবে গুছিয়ে তোলেন শীর্ষদের। আয়ারল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয়ার পর কোয়ার্টারে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা আইসল্যান্ডকে ৫-২ গোলের বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে সেমিতে পা রাখে তারা। আর তখনই যেন ঘোষণা হয়ে যায় এবার ইউরোর মুকুট ফ্রান্সের বাইরে যাওয়া দুরূহ! সেটা শেষ চারে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াই থেকেই বোঝা গেছে। আধিপত্য ধরে রেখেই খেলেছিল গত বিশ্বকাপের শিরোপাধারীরা। কিন্তু গোল করতে পারেনি জার্মান শিবির। উল্টো চতুরতার সঙ্গে খেলে দুই অর্ধে দুটি গোল আদায় করে নেয় ফ্রান্স। ২-০ গোলের জয়ে পা রাখে ফাইনালে। ২০০০ সালের পর আবারও ইউরোর ফাইনালে উঠল তারা। আর ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার পর এই প্রথম বড় কোন আসরের শিরোপা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগটাও পেল ফরাসীরা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- ১৯৮৪ ও ২০০০ সালে মাত্র দুইবারই ইউরো ফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স এবং দু’বারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দলের অধিনায়ক হুগো লরিস প্রত্যয় জানিয়েছেন দলকে আরেকবার চ্যাম্পিয়ন করার। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমেই গত বছর প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শোক থেকে জাতি পালিয়ে বাঁচতে পারবে বলেও মনে করেন তিনি। সেটা হতেই পারে ফরাসীদের জন্য। কারণ, পর্তুগীজদের কাছে হারের রেকর্ড নেই গত ৪১ বছরে! আর সবমিলিয়ে ২৪ ম্যাচ খেলে ১৮ বারই পর্তুগালকে হারিয়েছে ফ্রান্স, হেরেছে মাত্র ৫টিতে। মাত্র একটি ম্যাচ হয়েছে ড্র। তাই সবকিছুই যেন বাতাসে আগাম ধ্বনি তুলেছে ‘ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন!’
×