ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গি টার্গেটে দক্ষিণাঞ্চল

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১০ জুলাই ২০১৬

জঙ্গি টার্গেটে দক্ষিণাঞ্চল

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরা এবার নদী মাতৃক নিরাপদ এলাকা হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলাকে নতুন করে টার্গেট করেছে বলে ধারনা করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরিরের অন্যতম সদস্য ফাইজুল্লাহ ফাহিম গত ১৮ জুন মাদারীপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার আগে পুলিশকে জানিয়েছিলেন তাদের পরবর্তী টার্গেট বরিশাল। সূত্রমতে, ফাহিম মাদারীপুরের শিক্ষক (বরিশালের বাসিন্দা রিপন চক্রবর্তীকে) হত্যার পরিকল্পনা করেছিল বরিশালের এক আইনজীবীর চেম্বারে বসে। অদ্যাবধি সেই আইনজীবীকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। বরং উল্টো জঙ্গিরা ইতোমধ্যে দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা ও সাগরপারের জেলা বরগুনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়গুলোতে জঙ্গিরা হামলার হুমকী দিয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলার সংখ্যালঘুদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাওহীদের সদস্যরাও এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভোলা, বরগুনাসহ এ বিভাগের প্রতিটি গুরুতপূর্ণ এলাকার উপসানালয়ে জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। সূত্রমতে, গত ১৩ জুন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া শহরের সবুজনগর এলাকা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সক্রিয় সদস্য আকরামুজ্জামানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরআগে ২০১৬ সালের ১৫ জুন গুপ্তহত্যা প্রতিরোধে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে বরগুনা সদর উপজেলার হেউলিবুনিয়া এলাকা থেকে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার করা হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রহমানির ভাই আইউব আলী ও তার সহযোগী খলিলুর রহমানকে। এছাড়া উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাওহীদের দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার আমীরের বাড়ি জেলার গৌরনদী উপজেলার সাকোকাঠী গ্রামে হওয়ায় জঙ্গি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। এরইমধ্যে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভোলা সদরের বাপ্তা ইউনিয়নের মহাপ্রভুর মন্দিরে চিঠি পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। মন্দির কমিটির সদস্য নীহার কুমার মজুমদার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রণামী বাক্স খোলার পর একটি হাতে লেখা চিঠি পাওয়া যায়। এতে লেখা আছে, “সাবধান থেকে লাভ নেই। আপনাদের জবাই করে হত্যা করা হবে”। এ মন্দিরে পূজা-অর্চনার কাজ করেন পুরোহিত জগদানন্দ ব্রহ্মচারী। হুমকির চিঠি পাওয়ার পর তিনি মহাআতঙ্কে রয়েছেন। এ ব্যাপারে ভোলা মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবির বলেন, প্রতিটি মন্দিরে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া ভোলার আরও কয়েকটি মন্দিরে হাতে লেখা প্রায় একই কায়দায় চিঠি পাঠিয়ে হুমকী দেয়ার অভিযোগ পাওয়ার গেছে। ওইসব চিঠিতে লেখা রয়েছে, “৭৮৬, আল্লাহু আকবার। সাবধান থেকে কি করবি? প্রাণে বাঁচতে পারবি না তোরাও। তোরাও মরবি। জবাই করবো জবাই। থাকবো মোরা ইসলাম।” এতে আরো লেখা আছে, ‘স্ট্রাইক দ্য আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট, মৃত্যু আলহামদুলিল্লাহ’। এমন চিঠি পাওয়ার পর অনেক মন্দিরের কর্মকান্ড বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর এসেছে। এ ব্যাপারে ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, এলাকাবাসি সচেতন হলে কোন বির্তকিত সংগঠনই ভোলায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবেনা। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বত্র সজাগ রয়েছেন। অপরদিকে বরগুনা পৌর শহরের কড়ইতলা কালিবাড়ি এলাকায় রাধা গোবিন্দ মন্দিরে চিঠি দিয়ে হত্যার হুমকী দিয়েছে ‘পুরোহিত হত্যা সংগঠন’ নামের এক সংগঠন। অতিসম্প্রতি মন্দিরের ভিতরে চিঠিটি পরে থাকতে দেখেন পুরোহিত রাম প্রসাদ চক্রবর্তী সঞ্জয়। ওই চিঠিতে পুরোহিতকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পুরোহিত তোর মৃত্যু আমাদের হাতে। আমরা এখন কিলিং মিশনে আছি বরগুনা জেলায়। কাউকে কিছু বললে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তোর মৃত্যু হবে।’ চিঠি পাওয়ার পর প্রথমে হুমকিদাতাদের ভয়ে বিষয়টি চাঁপা রাখেন পুরোহিত। পরবর্তীতে স্থানীয়দের পরামর্শে তিনি এ ঘটনায় বরগুনা সদর থানা ও পুলিশ সুপার বিজয় বসাককে অবহিত করেন। পরে একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়। পুরোহিত রাম প্রসাদ চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, ‘চিঠি পাওয়ার পর থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে আমি চরম আতঙ্কে রয়েছি।’ এ ঘটনার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু মন্দির পরিদর্শন করে আতঙ্কিতদের নির্ভয়ে থাকতে বলেছেন। এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, এ ঘটনার পর থেকে প্রতিটি গুরুতপূর্ণ এলাকায় পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এরআগে গত শুক্রবার রাতে বরগুনার আমতলী এলাকার এক সংবাদকর্মী তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছেন, ‘আমাদের উপজেলা এবং জেলা লেভেলের সকল মন্দিরে চিঠি দিয়ে গেছে সেখানে যেনো পুজা দেয়া না হয়।’ এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, ‘এমন খবর আমিও শুনেছি। তবে অনেক মন্দিরে নয়। কালিবাড়ি মন্দিরসহ দু’টি মন্দিরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সব জায়গাতেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার ঘটনায় আটক ফাহিমের মৃত্যু পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন জানিয়েছিলেন, জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেড বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলা। গত বছরের আগস্টে ‘আনসার বিডি’ নামের একটি ফেসবুক পেইজে প্রকাশ করা এক প্রকাশনায় বরিশালের ছয় ব্যক্তিকে হুমকী দেয়া হয়েছিলো। হুমকীদাতারা সেখানে বলেছিলো, ‘মাশাআল্লা, আমরা সফলভাবে বরিশাল বিভাগে কার্যক্রম শুরু করেছি। এখানে ইসলামবিরোধী তিনজন কবি এবং তিনজন ব্লগার সংগঠক আছে। তারা ইসলামের শত্র“। আমাদের যা লক্ষ্য তা আমাদের করা উচিত।’ ওই সময়ে হুমকিপ্রাপ্তরা ছিলেন কবি হেনরী স্বপন, ভাস্কর্য শিল্পী চারু তুহিন, কবি সৈয়দ মেহেদী হাসান, গণজাগরণ মঞ্চ বরিশালের সংগঠক ও সাংবাদিক নেতা নজরুল বিশ্বাস, কবি তুহিন দাস ও ছাত্র ইউনিয়নের বরিশাল জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রীতম চৌধুরী। এ ঘটনায় বরিশাল কোতোয়ালী মডেল থানায় পৃথকভাবে ছয়টি জিডিও করা হয়েছিলো। এদিকে গুলশানে জঙ্গি হামলার পরপরই দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি গুরুতপূর্ন ধর্মীয় উপসানালয়গুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র এসি ফরহাদ সরদার জানান, নগরীর সকল প্রবেশদ্বারে চেকপোস্ট বসানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে যাত্রীদের দেহ তল্লাশি করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পোশাকে এবং সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির পিপিএম বলেন, শুধু জঙ্গি নয়; যেকোন হামলা মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
×