ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

কবিতার মঞ্চে স্মৃতিচারণায় সৈয়দ হক

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৭ অক্টোবর ২০১৬

কবিতার মঞ্চে স্মৃতিচারণায় সৈয়দ হক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল কবি সৈয়দ শামসুল হক। সেই সৃষ্টির বৈভবে স্মরণ করা হলো সব্যসাচী লেখককে। বলা হলো তাঁর বর্ণাঢ্য সৃজনশীল জীবনের কথা। উচ্চারিত হলো তাঁর রচিত কবিতার পঙক্তিমালা। নবীন-প্রবীণ কবিরা তাঁকে নিবেদন করে পাঠ করলেন স্বরচিত কবিতা। আবৃত্তিশিল্পীর ভরাট কণ্ঠে পঠিত হলো তাঁর কবিতার শব্দমালা। স্মৃতিচারণায় উঠে এলো কবির সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের খ- খ- স্মৃতিকথা। তাঁকে ভালবাসা জানিয়ে সুরের আশ্রয়ে গাওয়া হলো গান। বৃহস্পতিবার বিকেলে কবিতার মঞ্চ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। লাইব্রেরি চত্বরের যে রেইন্ট্রি তলায় গত কয়েক দশক ধরে প্রতিবছর কবিতা উৎসবে অংশ নিয়েছেন সৈয়দ হক সেখানেই উন্মুক্ত মঞ্চে শুভাকাক্সক্ষীদের ভালবাসায় যেন ফিরে ফিরে এলেন সব্যসাচী। স্মরণের এ আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। জীবনসঙ্গীকে নিয়ে কথা বলেন কবির সহধর্মিণী কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। স্মৃতির অলিন্দে পিতা সৈয়দ শামসুল হকের কথা উঠে আসে মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক ও ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হকের সূত্র ধরে। স্মৃতিচারণে অংশ নেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, কবি স্থপতি রবিউল হুসাইন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কথাসাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, কবি রবীন্দ্র গোপ, ছড়াকার আসলাম সানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি, লেখক আহমেদ মাযহার, অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর গীত হয় কবিকে নিবেদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত। কণ্ঠশিল্পী লিলি ইসলাম গেয়ে শোনান ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’। আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, কখনোই ভাবিনি তিনি থাকবেন না, আমাকে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে হবে। তাঁর জীবনীশক্তি আমার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এ কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি লিখে গেছেন। নতুন একটা সিরিজ শুরু করেছিলেন ‘ভাবনার ডানা’ নামে। শেষ দিকে যখন আর লিখতে পারছিলেন না তখন আমাকে দিয়ে অনুলিখন করাতেন। এভাবেই শেষ সময়েও সৃষ্টিশীলতার ঘোরের মধ্যেই নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন। শেষ যোব্ধা নামে একটি নাটক লিখছিলেন। অনেক কবিতা, গল্প, লিখতে চেয়েছেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কুড়িগ্রাম গেলেন। সেখানে তিনি সমাহিত হতে চেয়ে সবকিছু ঠিক করে রেখে এলেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ গল্পটা লিখে আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। হাসপাতালের বেডে মাত্র ১৭ দিনে ‘হ্যামলেট’ অনুবাদ করেছেন। তাঁর এই সৃষ্টির বৈভবে আমি এখনো বুঝতে পারছি না তিনি আছেন নাকি নেই। মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক বলেন, আমার শোক দুই ভাগে। একটা হচ্ছে লেখকের জন্য, যিনি খুব বড় মাপের লেখক ছিলেন। আরেকটি দিক হচ্ছে বাবার প্রতি শোক। যে বাবা আমাকে জীবন চিনিয়েছেন, যাকে আমি আর কখনো দেখব না। এই কষ্ট আমি কাটাতে পারছি না। তিনি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, যে রাস্তায় কেউ যেতে চায় না, তুমি সেই রাস্তায় বুক উঁচিয়ে হেঁটে যাবে। ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক বলেন, ‘এ বড় দারুণ বাজি তারে কই বড় বাজিকর’- আমার বাবাই যেন সেই বড় বাজিকর। যার লেখা মানুষের মনে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাজিকরের মতো। যিনি বাংলা সাহিত্যের ভূগোল বদলে দিয়েছেন। তার জীবনটাই যেন এক মহাকাব্য। আজকের এ আয়োজন দেখে ভাল লাগছে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে সবুজ ব্যাকড্রপে কালো রংয়ে আবৃত বাবার ছবি মনটা ভাল করে দিয়েছে। জীবন বহমান। বাবা বেঁচে থাকবেন তার লেখায়। পরে তিনি সৈয়দ শামসুল হকের ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা ‘আই ডাই’ পাঠ করেন। রামেন্দু মজুমদার বলেন, আমরা আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম। সংশয়ে, বেদনায়, আনন্দে যাঁর কাছে যাওয়া যেত, আশার বাণী শোনা যেত সেই মানুষটিকে আর পাব না। তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো মানেই নতুন কিছু জানা, আনন্দ লাভ করা। হাল্কা চালের রসিকতার মধ্যেও অনেক গুরুত্ব বিষয়ের ইঙ্গিত থাকত। বড় মাপের লেখক ছিলেন সৈয়দ হক। রচনাশৈলী, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, নতুন নতুন শব্দ গঠন দিয়ে নিজস্ব গদ্য ভাষার জন্ম দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, সৃজনশীল সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে পুরোধা ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু এবং সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সাহিত্যের শিক্ষকও বটে। তাকে হারানো মানে জাতির অভিভাবককে হারানো। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সৈয়দ শামসুল হক বাংলা ভাষায় তার সমসাময়িককালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। দেশের যে কোন একটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস সৈয়দ শামসুল হকের নামে নামকরণ করার দাবি জানান তিনি। ওসমান গনি বলেন, দেশের যে ক্রান্তিকালে তিনি অভিভাবকের মতো এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রকাশকরা যখন আক্রান্ত তখন তিনি আমাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। সুভাষ সিংহ রায় বলেন, সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক যতদিন যাবে ততই তিনি বাঙালীর কাছে নতুন নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হবেন। সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন নবীন-প্রবীণ কবিরা। আমিনুর রহমান সুলতান পাঠ করেন ‘পাহাড় পাহাড়ি’, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী ও কবি বুলবুল মহলানবীশ পাঠ করেন ‘মঞ্চ থেকে দূরে’। এছাড়া স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান, রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন, দিলারা হাফিজ, জাহিদুল হক প্রমুখ। সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন শাহাদাত হোসেন নীপু। ১৫ বছরে বাংলাদেশ শিশু সংগঠন ঐক্যজোট ॥ পথ চলার ১৪ বছর পূর্ণ করে ১৫ বছরে পদার্পণ করল বাংলাদেশ শিশু সংগঠন ঐক্যজোট। এ উপলক্ষে এক আয়োজনে বিশ্ব শিশু দিবস ও সংগঠনটির ১৫তম বছরে নবনির্বাচিত কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি মিলনায়তনে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো হয় আয়োজন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিম-লীর সদস্য ঝুনা চৌধুরী, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ গিয়াস প্রমুখ। সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ শিশু সংগঠন ঐক্যজোটের সভাপতি শাহ আলম শিকদার জয়। আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় শিশু সংগঠন ঐক্যজোটের অন্তর্ভুক্ত ১৫টি সংগঠন। নাচের দল স্পন্দনের পরিবেশনায় উদ্বোধনী সঙ্গীতের সাথে নাচের মাধ্যমে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শব্দকলি। বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা পরিবেশন করে ‘মোমের পুতুল মোমের দেশেতে নেচে যায়’ গানের সাথে দলীয় নাচ। এরপর ছিল কল্পরেখার পরিবেশনায় দলীয় আবৃত্তি। এছাড়াও সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয় সাংস্কৃতিক সংগঠন আমরা কুঁড়ি, আমরা করব জয়, নূপুর একাডেমি, ভিন্নধারা শিশু-কিশোর মেলা, মানব সাহায্য সংস্থা, কিশোর থিয়েটার, মৈত্রী শিশুদল, সোনার বাংলা সাংস্কৃতিক ফোরাম, সন্ধান লিটল থিয়েটার, মৈত্রী চিলড্রেন থিয়েটার ট্রুপস ও মন্দিরা সাংস্কৃতিক পাঠশালা। এর আগে সংগঠনটির নবনির্বাচিত কমিটির অভিষেক হয়। চারুকলার দাদুকে নিয়ে তথ্যচিত্র ॥ শিল্পের টানেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের সড়কে। শিল্পের সমঝদার হওয়ায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাকে তৎকালীন সরকারী আর্ট কলেজে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনচেতা মানুষটি নিজেকে আবদ্ধ করেননি পরাধীনতার শৃঙ্খলে। বলা হলো ‘চারুকলার দাদু’ নামে পরিচিত মোমিন আলী মৃধার কথা। চারুকলার এই দাদুকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন মোল্লা সাগর। চলচ্চিত্রটিতে উঠে এসেছে দাদুর জীবনের বিভিন্ন সময়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুফিয়া কামাল কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে চলচ্চিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে অতিথি ছিলেন চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমান, মসিহউদ্দিন শাকের, চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। আরও উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্রের নির্মাতা মোল্লা সাগর। নিসার হোসেন বলেন, ১৯৭৬ সালে আমি চারুকলায় যোগ দেই। ঐ সময় দাদুকে পেয়েছি কিনা মনে নেই। তবে ১৯৭৯ সালে দাদুকে মডেল হিসেবে নিয়ে কাজ করেছি। আমার কাছে তিনি একজন আকর্ষণীয় শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ও আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ ছিলেন। প্রচলিত অর্থে যেভাবে আমরা ধর্মকে বিশ্বাস করি উনি সেভাবে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ধর্ম বলতে মানুষকেই বুঝতেন। তার মতে ধর্ম ছিল অন্তরের বিষয়। তিনি বুঝতেন সত্যের নামই ধর্ম, আর মিথ্যার নাম পাপ। মোল্লা সাগর জানান, ২০০১ সাল থেকে দাদুর ওপর প্রামাণ্যচিত্রটির দৃশ্যধারণ শুরু করেন তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত দাদুকে ক্যামেরায় ধারণ করেন তিনি। তাঁর ১০০ বছরের জীবন অভিজ্ঞতায় ভরা। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধসহ আরও অনেক কিছু। চারুকলায় মডেল হিসেবে ১৯৪৮ সালে তাঁকে ডেকে নেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসে মডেল হিসেবে এত ছবি আর কারও আঁকা হয়নি। ২০১২ সালে ১০৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
×