ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃণালিনী

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃণালিনী

গুণীজনরা বলেন যে, কোন পুরুষের সফলতার পেছনে থাকে কোন না কোন নারীর অবদান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্মৃিতকথায় লিখেছেন, বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির নির্বাচকম-লী অনেক খুঁজেও বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের এক কর্মচারীর মেয়ে ভবতারিণীকেই রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হিসেবে বেছে নিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বাইশ। আর ভবতারিণীর বয়স তখন মাত্র নয় বছর। অনুমানের উপর নির্ভর করে মৃণালিনীর জন্ম ১৮৭৪-এর ১ মার্চ ধরা হয়। রবীন্দ্রনাথকে ফুলতলায় গিয়ে বিয়ে করতে হয়নি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছায় কলকাতায় জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে ব্রাহ্মমতে বিয়ে করেন রবীন্দ্রনাথ ভবতারিণীকে। বিয়ের পর ‘ভবতারিণী’-কে ‘মৃণালিনী’ করে দেন রবীন্দ্রনাথ। কেউ কেউ বলেছেন নিজের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নাকি রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন এই নাম। অনেকে আবার ধরে নিয়েছেন কৈশোরে মনের গভীরে দাগ কাটা মরাঠি বান্ধবী আনা তড়খড়কে দেয়া তাঁর নাম ‘নলিনী’র ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ নববধূর নাম রেখেছিলেন মৃণালিনী। মৃণালিনী ছিলেন গভীর ব্যক্তিত্বময়ী, সুদর্শনা। বাসর ঘরে দরাজ গলায় মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন রবীন্দ্রনাথ : ‘আ মরি লাবণ্যময়ী/কে ও স্থির সৌদামিনী,/ পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/মার্জিত বদনখানি!/নেহারিয়া রূপ হায়,/আঁখি নাহি ফিরিতে চায়,/অপ্সরা কি বিদ্যাধারী/কে রূপসী নাহি জানি।’ লজ্জায় ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা হেট করে বসে রইলেন মৃণালিনী। অপরিণত বয়সে মৃণালিনীকে সংসার সামলানোর কাজে ব্যস্ত হতে হয়। মহর্ষি খুবই স্নেহ করতেন তাঁর ছোট পুত্রবধূটিকে। মৃণালিনীকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মহর্ষি তাঁকে ভর্তি করলেন কলকাতার লরেটো হাউসে। এক বছর লোরেটোতে পড়াশোনা করেন মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতে এরপর বাড়িতেই প-িত হেরম্বচন্দ্র বিদ্যারতেœর কাছে সংস্কৃত শেখার ব্যবস্থা হয় তাঁর। ভাশুর বীরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথের মাধ্যমেও ইংরেজী, বাংলা আর সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন মৃণালিনী। ছিলেন মার্ক টোয়েনের অনুরাগী। অল্প বয়সে যেমন বিয়ে হয়েছিল তেমনি অল্প বয়সে মাও হয়েছিলেন তিনি। ১৮৮৬ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম হলো বেলা অর্থাৎ মাধুরীলতার-মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান। গুরুজনদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল গভীর। উর্মিলাদেবী লিখেছেন, মহর্ষি পছন্দ করেন না এমন কোন কাজ করতে চাইতেন না মৃণালিনী। সাহিত্যচর্চা, অনুবাদ চর্চার পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির নাটকের দলেও সক্রিয় ছিলেন মৃণালিনী। ‘রাজা ও রানী’ নাটক প্রথমবার মঞ্চস্থ হলে নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। সাহিত্যে আগ্রহ থাকলেও চিঠি আর সামান্য কিছু অনুবাদের খসড়া ছাড়া মৃণালিনী প্রায় লিখে যাননি কিছুই। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী মৃণালিনীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন যে যাঁর স্বামী বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখক তাঁর আর নিজের লেখার কী প্রয়োজন! তার এ বক্তব্যের মাঝেই ফুটে ওঠে স্বামীর লেখালেখির প্রতি কতটা সমর্থন ছিল মৃণালিনীর। এমনকি বিয়ের পর নির্দিষ্ট কোথাও থিতু হতে পারেননি মৃণালিনী। কলকাতা, শিলাইদহ, সোলাপুর আর শান্তিনিকেতনে বারবার বাসা বদল করেছেন। আর দশটা বাঙালীবধূর মতোই মৃণালিনীও স্বামী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনকে রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন ভোজন রসিক, মৃণালিনী তেমনই ছিলেন রান্নাপটু। মৃণালিনীকে নিয়ে যে কয়েকটা স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে, তার মধ্যে বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে মৃণালিনীর রান্নার গল্প। স্ত্রীকে নিত্যনতুন রান্নার ফরমায়েশ করতেন রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহে মাঝে মাঝেই যেতেন কবির বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু আর নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। তাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন মৃণালিনী। একদিন রবীন্দ্রনাথকে একটা মিষ্টি তৈরি করে খাওয়ালেন মৃণালিনী। ওই মিষ্টির নাম বাঙাল ভাষায় ‘এলোঝেলো’ শুনে নাক সিঁটকোলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর তার নাম রাখলেন ‘পরিবন্ধ’। পোশাক আশাকের প্রতি মৃণালিনীর খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। একেবারেই সাদামাটা থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। খুব বেশি সাজগোজ পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ নিজেও। সম্ভবত তাই তাঁর সামনে গয়নাগাটি পরতেও লজ্জা পেতেন মৃণালিনী। তবে তাঁর ইচ্ছে হতো রবীন্দ্রনাথকে একটু সাজিয়ে দেবার। স্বামীর জন্য তাঁর জন্মদিনে একবার সাধ করে গড়িয়ে আনলেন সোনার বোতাম। রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ, পুরুষে কখনো সোনা পরে.. লজ্জার কথা!’ স্বামীর প্রতি তাঁর যে ভালবাসা এগুলো থেকেই প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতেন চিঠির মাধ্যমে ভাবের আদান প্রদান হতো। তবে মৃণালিনীকে চিঠি লিখতে উৎসাদ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। আর অধীর হয়ে অপেক্ষা করতেন তাঁর চিঠি পাবার জন্য। মৃণালিনী ছিলেন অভিমানী। সম্ভবত লিখতেন কম। মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি পাওয়া গেছে ছত্রিশটি। রবীন্দ্রনাথকে লেখা মৃণালিনীর দুটোর বেশি চিঠির খোঁজ পাওয়া যায় না। শিলাইদহ, কালিগ্রাম, কুষ্টিয়া, শান্তিনিকেতন, এলাহাবাদ, কলকাতা, শাহজাদপুর থেকে প্রতিদিনের নানা খুঁটিনাটি জানিয়ে, পরিবারের নানা কথা জানতে চেয়ে মৃণালিনীকে সুন্দর সুন্দর সব চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যেকটা নারীর কাছে তাঁর গহনা অনেক প্রিয়। কিন্তু মৃণালিনী আশ্রম বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হাত মেলালেন স্বামীর সঙ্গেই। বিদ্যালয়ের কাজে যখনই অভাব দেখা দিয়েছে, নিজের গায়ের গহনা বিক্রি করে রবীন্দ্রনাথকে টাকা এনে দিয়েছেন মৃণালিনী। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যেকটি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। সাহস দিয়েছেন উৎসাহ দিয়েছেন স্বামীকে বিভিন্ন কাজে। কিন্তু বড় অসময়ে ১৯০২-এর ২৩ নবেম্বর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে রাত্রে চলে গেলেন কবিপতœী মৃণালিনী। নিভে গেল জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে মৃণালিনীর ঘরের সব আলো। রইলেন এক আকুল কবি আর মা-হারা তাঁর পাঁচটি ছেলেমেয়ে। ভিড়ে, আদরের আড়ালে আর রইল নিজের অনুবাদের খাতার শেষ মলাটে দেবনাগরী অক্ষরে মৃণালিনীর নিজের হাতে লিখে রাখা, ভালবাসা আর বেদনায় ভেজা এক কবির সংসারের সাতটি তারার নাম। তথ্যসূত্র : মৃণালিনী দেবী (রবীন্দ্রভবন কর্তৃক সংকলিত), মৃণালিনী দেবী : রবীন্দ্র কাব্যে ও জীবনে (প্রজ্ঞাপারমিতা বড়ুয়া), চিঠিপত্র : প্রথম খ- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
×