ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশে বিপন্ন বাংলা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশে বিপন্ন বাংলা

গত সংখ্যায় এই কলামে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে কেমন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা বিপন্ন তার প্রাথমিক আলোচনা করা হয়েছে। এবার তার দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো। আগামী পর্বে লেখাটি সমাপ্ত হবে। ॥ দুই ॥ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ও সরকারী অফিসে বাংলা : গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলা প্রচলন বিষয়ক আইন সম্পর্কে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটির অংশ বিশেষ এ রকম : “দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালুর লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ প্রণয়ন করা হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’। এতে বলা হয়, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস-আদালত, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এই আইনে আরও বলা হয়, কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তাহলে সেটি বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি এই আইন অমান্য করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আইন চালু হলেও এর বাস্তবায়নের কাজটি হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। কিছু সমস্যাও ছিল। কারণ, যথাযথ পরিভাষার অভাব ও বানানরীতির ভিন্নতার কারণে ব্যবহারিক ভাষায় অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এছাড়া প্রমিত ভাষারীতি সম্পর্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভালভাবে অবহিত না থাকার কারণে নথিপত্রের ভাষার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিষয়টি ২০১২ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচিত হয়। পরে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর সরকারী কাজে বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করার নির্দেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর এ কাজ কিছুটা গতি পায়। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ শাখা, যেটির নাম বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ। এই কোষের অ্যাসাইনমেন্ট কর্মকর্তা মো মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারী কাজে বাংলা ভাষা সহজ করে ব্যবহারের জন্য এই কোষ থেকে ইতোমধ্যে চারটি পুস্তিকা বই আকারে বের করা হয়েছে। এগুলো হলো পদবীর পরিভাষা, প্রশাসনিক পরিভাষা, সরকারী কাজে ব্যবহারিক বাংলা পুস্তক ও ছোট বই (পকেট বুক)। এছাড়া সরকারী কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম ও সরকারী কাজে ব্যবহারিক বাংলার দ্বিতীয় সংস্করণ বের করার কাজও প্রক্রিয়াধীন আছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারী কর্মকর্তারা প্রমিত বাংলা ব্যবহারে সহায়তা নিতে পারছেন। অফিস সময়ে এই কোষে ফোন করেও সহায়তা নেয়া যায়। ওই কোষের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণে লেখা এই পুস্তক ও ছোট বইগুলো ছোটবড় সব সরকারী দফতরেই বিতরণ করা হয়েছে। এখন সেই অনুসারে নথিপত্রের ভাষা লেখা হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনেও একইভাবে একই বানানরীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া এই কোষ ইংরেজী থেকে বাংলায় করা আইনের খসড়াগুলো প্রমিত বানানো হচ্ছে কি না, তা যাচাই করে দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জনবল বাড়িয়ে এই কোষকে শক্তিশালী করে আরও অনেক কাজ করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। বর্তমানেও দু’জন অনুবাদ কর্মকর্তা ও একজন বিশেষজ্ঞের পদ শূন্য আছে। এছাড়া বদলিজনিত কারণে যুগ্ম সচিবের পদও এখন শূন্য। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন এলাকায় সাইনবোর্ড যাতে বাংলায় লেখা নিশ্চিত করা হয়, সে জন্য গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।” কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে আমরা এই চিঠির প্রয়োগ দেখতে পাই না। নগর এলাকায় বাংলা সাইনবোর্ড দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হয়। আমি মনে করি, বাংলা ভাষা বর্জন করার বিষয়টি পুরো সরকারের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে কারণে বা অকারণে আমলারা ইংরেজী ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন বা সরকারের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ এসব বিষয়ে কেন এই আইন লঙ্ঘন করার জন্য কারও বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এর মূল কারণ বাংলা ভাষার প্রতি এদের কোন অঙ্গীকার নেই। যা হোক, এই পরিস্থিতির আলোকে এতদিনে বাংলা ভাষার কতটা দুর্দিন তৈরি হয়েছে সেই বিষয়েও আমি আলোকপাত করতে পারি। নিবন্ধের পরের অংশে আমরা সংকটগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরব। রাষ্ট্রভাষার দেশে অসহায় বাংলা : বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার অসহায়ত্ব নিয়ে আমরা লেখাটি শুরুই করেছি। বস্তুত, বাংলা ভাষার নামে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সেই ভাষারই এখন চরম দুর্দিন বিরাজ করছে সেটি বিশ্বাস করা অনেকটাই কষ্টের। ভাবা যায় যে, এমনকি সেই ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? যদি আমাদের এটি ভাবতে হয় যে, আমরা যতই ডিজিটাল হচ্ছি বাংলা ভাষার দুর্দিন ততই বাড়ছে, তবে কেমন লাগবে একজন বাংলাভাষী হিসেবে। সাম্প্রতিককালে এই দুর্দশাটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে সেই অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে কেবল বাংলা ভাষা ও লিপির দুর্দিনই দেখতে পাচ্ছি। কোন মহলই এই চরম সঙ্কট থেকে বাংলাকে উদ্ধারের কোন চেষ্টা করছে সেটি দেখছি না। বরং একদল মানুষ জেনে না জেনে বাংলা ভাষাকে বিপন্ন করার জন্য সবশক্তি দিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা থাকব বটে-তবে বাংলা ভাষার সঠিক (বা কোন প্রকারের) ব্যবহার থাকবে না। আমি বাংলা লিপির বিলুপ্তিরও আশঙ্কা করছি। যদিও আমি এটি বিশ্বাস করি যে, ৩৫ কোটি লোকের ব্যবহƒত একটি লিপি বা হাজার বছরের সমৃদ্ধ একটি ভাষা-সাহিত্য কোনভাবেই বিলুপ্তির স্তরে যেতে পারে না, তবুও ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বিশেষত বাংলাদেশে যেসব কাজ হচ্ছে তাতে আশঙ্কার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছেই। চিন্তা করে দেখুন, এটি কি ভাবা যায় যে, রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে যে জাতি সেই জাতির হাতেই তার মাতৃভাষা বা তার রক্তমাখানো বর্ণমালা হারিয়ে যাবে? এটি কি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করা যায় যে, সেই পথেই পা বাড়িয়েছি আমরা। কয়েকটি বিষয় নজরে আনুন। কেউ কি এটি ভাবতেও পারেন যে, আমাদের সরকারের দুর্বলতার জন্য বাংলা ভাষাকে এখনও দেবনাগরী কোড ব্যবহার করতে হয়। এটি আমরা বছরের পর বছর ধরে মেনে চলেছি এবং সেটি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে। কেউ কি ভাবতে পারেন যে, কম্পিউটারে বাংলা ভাষা যে প্রমিত মান প্রয়োগ করার কথা সে বিষয়ে সরকারের কোন স্তরে সচেতনতাই নেই। কেউ কি ভাবতে পারেন যে, খোদ সরকার কীবোর্ড পাইরেসির দায় ঘাড়ে নিয়ে বছরের পর বছর নীরবতা পালন করেছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করার কথা সেসব কাজ শুরু করতে ২০১৭ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মাঝে যেসব কাজ হয়েছে সেগুলো প্রায় সবই নিষ্ফলতায় পড়েছে এবং সমন্বয়ও দেখা যায়নি। আপনারা কি ফেসবুক বা টুইটারে দেখেন আমাদের বঙ্গ-সন্তানরা কি সুন্দর (!) বাংলা লেখেন? এটি ভাবতে পারেন যে, ফেসবুকের মতো ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলিশ, অশুদ্ধ ও শুদ্ধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাত্র শতকরা মাত্র ৮ ভাগ মানুষ বাংলা ব্যবহার করে। এর মানে দেশের ৯২ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী বাংলিশও ব্যবহার করেন না। কেউ কি এটি ভাবতে পারেন যে, রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রশিক্ষণ দিয়েছে সরকারি সংস্থা এবং রোমান হরফে বাংলা লেখার উৎসাহদাতাও সরকারী সংস্থা। যার সন্দেহ আছে তার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কোন বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে সেটি জানার অনুরোধ করছি? সরকারের একটি সংস্থার নির্দেশে হাজার হাজার শিক্ষক ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন তাই রোমান হরফে বাংলা লেখে। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৫০ হাজার ল্যাপটপ কেনার স্পেসিফিকেশনে রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যবস্থা সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরামর্শক। সকলেই সরকারের এসএমএসগুলো কি দেখেন? কি চমৎকারভাবে রোমান হরফ দিয়ে ভুল বাংলায় এসএমএস লেখা হয়! কেউ কি এটি কল্পনা করতে পারেন যে, সরকার নিজেই তার প্রণীত মান মানেন না? বাস্তব অবস্থাটি আমার ওপরের বর্ণনার চাইতেও ভয়াবহ। আরও ভয়াবহ যে এই বিষয় নিয়ে সরকার তো কথা বলেই না, দেশের সুশীল সমাজও কথা বলেন না। বাংলা ভাষার জন্য যারা কথায় কথায় জীবন দিয়ে ফেলেন তারাও কথা বলেন না। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা এখন এতিমের মতো অযতেœ অবহেলায় বেড়ে উঠছে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই এতিম রাষ্ট্রভাষার অতি জরুরী সঙ্কট বা চ্যালেঞ্জগুলোকে অতি সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরা। আজকের ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সঙ্কট অতি সাধারণ নয়। এর চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তি জড়িত রয়েছে। অতীতের সরকারসমূহের কোন কোন মহলের চরম অবহেলার জন্য প্রযুক্তিগত সঙ্কটগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বাংলার পশ্চাৎপদতা রয়েই গেছে। ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৭ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net
×