ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বাছেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৯ আগস্ট ২০১৭

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বাছেশ

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ আজ ৬ জিলহজ। চতুর্দিকে পবিত্র হজ ও কোরবানির সুশোভিত ব্যস্ততায় ভরা এ মৌসুম। বিশ্বের সব জায়গায় মসজিদ আছে নামাজ আদায়ের সুযোগ আছে, যেখানে সেখানে পবিত্র মাহে রমজান জুড়ে মুসলমানরা সিয়াম সাধনা করতে পারেন। বিশ্বের দেশে দেশে ধনীরা অকাতরে যাকাত দান করে। অর্থাৎ এসব ইবাদত সব জায়গায় করা যায় কিন্তু হজ তাওয়াফের মতো হৃদয়কাড়া ইবাদত একমাত্র পবিত্র কা’বাকেন্দ্রিক ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর ঘরের মহিমা দেখার জন্য এবং পবিত্র তাওয়াফ বা কা’বা ঘর প্রদক্ষিণের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের তামান্না আরজু শুধু মুসলমানের নয় তাওহীদবাদী গোটা মানবজাতি এ কাজে ছুটে এসেছেন শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে। মানবের সঙ্গে এমনকি দানব পশু পাখিও তাদের স্রষ্টার ঘরের তাওয়াফ ও হিফাজতে অংশ নেয়। চুম্বক যেমন লোহাকে কাছে টানে, ফুল যেমন ভ্রমরকে নিজের সঙ্গে মিতালী করতে ডাকে কা’বার চতুর্দিকে হামেশাই ঘুরছে পরওয়ার দিগারের মজনু দল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রত্যেক ভাল মানুষের যেমন শত্রু থাকে, ভাল কাজের প্রতি যেমন ঈর্ষা থাকে, এক নম্বর কোন বিষয়ের নকল পণ্য বের হয়, তদ্রƒপ আল্লাহর পবিত্র ঘর ও তাওয়াফের গুরুত্বও খাটো করার চেষ্টায় যুগে যুগে নাফরমান অপরিণামদর্শী লোভাতুর লোকেরও সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা কখনও সাকসেস হয় না, সাকসেস কখনও হবেও না। কারণ আল্লাহর কুদরতের সঙ্গে কোন বান্দার ফন্দিবাজি টেকে না, আল্লাহ সহ্যও করেন না। যেমন তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ওয়ামান কাফারা ফাইন্নাল্লাহা গানিউন আনিল আলামিন অর্থাৎ যে বা যারা এ বিষয়ে কুফরি করে মনে রাখা উচিত আল্লাহ বিশ্বের কারও কাছেই তার তাবেদারি পাওয়ার মুখাপেক্ষী নন বরং প্রত্যেক মানুষ ও সৃষ্টিই তার বিধান মানতে বাধ্য। (আল কুরআন)।’ কুরআনুল কারীমের সূরা ফিলে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কাবা শরীফ ধ্বংস অভিযাত্রী দাম্ভিক রাজা আবরাহা ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে এক নগণ্য ব্যবস্থায় নাস্তানাবুদ করার কাহিনী শুনিয়েছেন আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদকে (স.)। ইরশাদ করেছেন, আলামতারা কাইফা ফা’আলা রাব্বুকা বিআস হা-বিল ফীল, আলাম ইয়াজআল কায়দাহুম ফী তাদলীল অর্থাৎ হে প্রিয় নবী (স.) আপনি কি দেখেননি আপনার প্রভু হস্তিবাহিনীর সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি? . . . উল্লেখ্য, আবরাহা লক্ষ্য করেছিলেন, আরবের লোকেরা মক্কা নগরীর কা’বা শরীফে হজ করতে যান। এতে কা’বার মর্যাদা, মক্কার মর্যাদা বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পায় একই সঙ্গে মক্কাবাসীও সম্মানিত ও ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়ে থাকে। তিনি মক্কার সে পবিত্রতা ও আভিজাত্য খর্ব করার মানসে সানয়ায় একটি সুন্দর গীর্জা তৈরি করেন এবং সবাইকে এখানে হজের সুযোগ নেয়ার আহ্বান জানান। দিগি¦দিকের কাবাপ্রেমী লোকেরা তার ডাকে তো সাড়া দেয়নি বরং কেউ কেউ তার নির্মিত গীর্জায় গিয়ে অপবিত্র করে আসে। এতে তিনি আরও ক্রোধান্বিত হন। তিনি কা’বা শরীফ ধ্বংসের নিমিত্তে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। এ খবর জানতে পেরে মক্কার লোকেরা ভয়ে পাহাড় পর্বতে আশ্রয় নেয়। মহানবীর দাদা পবিত্র কা’বা ঘরের প্রধান সেবক হযরত আবদুল মুত্তালিবের সহায় সম্পত্তির ওপর চড়াও হয় আবরাহা বাহিনী। তার ২০০ উট করায়ত্ত করে। অগত্যা তিনি পবিত্র কা’বা ঘরের দরজায় পরওয়ার দিগারের কাছে মুনাজাত করে বলেন, মহামহিম! চতুর্দিকে আবরাহা শক্তি আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তার মোকাবেলায় আমার লোকবল নেই। এ ঘর রক্ষায় এখন আমি একমাত্র তোমার কাছেই ভরসা করছি। তুমিই তোমার ঘরের হিফাজত করো। এ বলে তিনি কাবার দরজায় চাবিটি রেখে দিয়ে আবরাহার কাছে বললেন কা’বা ঘর এখন জনমানবশূন্য। তোমার ইচ্ছা হলে তা ধ্বংস করতে তুমি এগিয়ে যাও। শুধু আমার এতটুকু আরজ, আমি ছা-পোষা মানুষ। আমার উটগুলো আমাকে ফেরত দাও। মহান আল্লাহ পাক আবদুল মুত্তালিবের প্রার্থনা কবুল করলেন। তার ঘর কা’বা শরীফের জিম্মা নিজে গ্রহণ করলেন। এদিকে পাপিষ্ঠ আবরাহা হস্তিবাহিনী নিয়ে যতই অগ্রসর হয় ততই হাতিগুলো বেঁকে বসে। সামনে না গিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে থাকে। আল্লাহ পুরো বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য আকাশে উড়িয়ে দিলেন ছোট ছোট এক ঝাঁক আবাবিল পাখি। তাদের চঞ্চুতে ছিল ছোট ছোট পাথরকণা। সে পাথরগুলো যখন কোন একটি হাতির ওপর ফেলত অমনিই হাতি ও তার বাহকের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যেত। পলায়নপর হস্তিবাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আজকের মিনা মুযদালিফার মাঝখানে ওয়াদি আল মুহাসসারা নামক এক পাহাড়ী এলাকায়। এখনও হাজী সাহেবগণ হজ করতে গেলে ঐ এলাকাটি আল্লাহর গযবের কথা স্মরণ করে দৌড়েই পার হয়ে যায়। ইতিহাস বলছে, আখেরি নবী হযরত মুহম্মদের (স.) জন্মের ৫০/৫৫ দিন আগে এ বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছিল। সেটি ছিল আরবি মহরম মাস, ইংরেজী ফেব্রুয়ারির শেষ এবং মার্চের শুরুর দিকের ঘটনা। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে একটি বর্ণনা আছে, তিনি বলেছেন, আমাদের ছোট বেলায় রাস্তাঘাটে আমরা কিছু অভিশপ্ত দুর্দশাগ্রস্ত অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষুকদের দেখতাম। মরুব্বিরা বলতেন এরা আবরাহা সেনাবাহিনীর লোক। -(মাআরিফুল কোরআন, আর রাহীকুল মাখতুম ও বিশ্বনবী)।
×