ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জয় প্রকাশ

বাংলাদেশের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন

১৯৭১ সাল। যুদ্ধের বিভীষিকায় রক্তাক্ত বাংলাদেশ। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার ফলে প্রায় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণ-পোষণ করতে ত্রাণ-সামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেয়। শরণার্থী জীবন এমনিতেই দুর্বিষহ। সে সময় বিখ্যাত সেতার বাদক প-িত রবি শঙ্কর হ্যারিসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রবি শঙ্কর বাংলাদেশের জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনের কথা বলেন। হ্যারিসন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান এবং পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সেই ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’র প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে সেদিন তরুণ হ্যারিসনের সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘ দিনের বন্ধু সহকর্মী রিঙ্গোস্টার, ছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্লাপটন, বিলি প্রিস্টন আর হ্যারিসনের নতুন ব্যান্ড ফিঙ্গারের যন্ত্রী শিল্পীরা। একাত্তরের আগস্টের প্রথম দিবসে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ৪০ হাজার আসনের মধ্যে সেদিন একটিও খালি ছিল না। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে কনসার্টটি অডিও আকারে প্রকাশিত হয়। কনসার্ট থেকে আয় হয়েছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮.৫০ মার্কিন ডলার। যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয় হয়। হ্যারিসনকে এক সাংবাদিক কনসার্টের পর জিজ্ঞেস করেছিলেন, দুনিয়াতে এতো সমস্যা থাকতে আপনি কেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় কিছু করার জন্য আগ্রহী হলেন? উত্তরে হ্যারিসন বলেন, ‘আমার এক বন্ধু সহায়তা চেয়েছেন। বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজন করি। আমরা বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কারণ কনসার্টটি যখন করছিলাম তখন মার্কিন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছিল। কিন্তু সংবাদপত্রে লেখা হচ্ছিল সামান্য।’ কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। যুদ্ধের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত করতে অনন্য ভূমিকা রাখে। ২৫ ফেব্রুয়ারি এই মহান শিল্পীর ৭৪তম জন্মবার্ষিকী। এদিনে এই মহান শিল্পীকে বিনম্র শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। ‘গীতিকার হওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে নয়, মূলত গান লিখেছি মন থেকে কিছু বের করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। আমি মনে করি কিছু লেখক আছেন যাদের কাছে তাদের অনুভূতি কিংবা অভিজ্ঞতার বর্ণনা যথেষ্ট নয়, তাদের হাতে এটা একটা শৈল্পিক কর্ম। যেসব ভারতীয় সঙ্গীত এখন আমরা শুনছি, তা সরাসরি সঙ্গীতের আবেগ বহন করে। সেজন্য গীত রচনা আমার কাছে সেই আবেগকে ছাপিয়ে ওঠার একটা মাধ্যম, ঐ মুহূর্তের, ঐ সময়ের। তেমনি একটি গান ‘বাংলাদেশ’ যা ঐ সময়ের। দুঃসময়ের, দুঃখ ভারাক্রান্ত সত্তুরের...’ এমন কথাই নিজের আত্মজীবনীমূলক প্রন্থ ‘আই সি মাইন‘-এ লিখেছেন দুনিয়া মাতানো রক ব্যান্ড বিটেলসের লিড গিটার বাদক জর্জ হ্যারিসন। বিটলসের একটা বিখ্যাত গান ছিল ডযবহ ও’স ংরীঃু ঋড়ঁৎ কিন্তু মরনব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হ্যারিসন যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তার বয়স ৫৮। শয্যা পাশে তার প্রিয়তমা স্ত্রী অলিভিয়া এবং ২৪ বছরের ছেলে ডেনি হ্যারিসন। তার শয্যার পাশে ছিলেন সেতার বন্ধু শাম সুন্দর এবং সুকুন্দ, দু’জনেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় মগ্ন প্রিয় বন্ধু হ্যারিসনের জন্য। তারপর চিরকালের নীরবতা। হঠাৎ কেঁদে উঠলেন প্রিয়তমা অলিভিয়া। সময়টা ২৯ নবেম্বর ২০০১। আমেরিকার লস এঞ্জেলসে তখন ঘড়িতে সময় দুপুর ১.৩০ চলে গেলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটেলসের সাবেক গিটারিস্ট ও গায়ক আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না। গণশিল্পী ভূপেন হাজারিকার এই আবেগপ্রবল গানের মতো যিনি তার সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে একাত্তরের ক্রান্তিকালীন দুঃসময়ে ইংল্যান্ডের শহর লিভারপুলে ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন হ্যারিসন বাবা হ্যারোল্ড হারপ্রিভিস হ্যারিসনের কেমন ছিল বলে কন্ডাক্টরি আর মা লুসিয়ে একটি দোকানে কাজ করতেন। প্রাইমারী স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৪ সালে খরাবৎঢ়ড়ড়ষ ওহংঃরঃঁঃব ভড়ৎ ইড়ুং-এ ভর্তি হন। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়েছেন। এ স্কুলেই তার গিটারে হাতেখড়ি। হ্যারিসনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, হ্যারিসনের জন্য প্রথম দিকে গিটার কিনে দিতে পারে না। পরে তার মা তাকে ৩.১০ পাউন্ড দিয়ে তাকে একটা গিটার কিনে দেন। একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট মানবতার মূর্ত প্রতীক জর্জ হ্যারিসন। যার প্রতিভা কেবলমাত্র এ দু’য়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তার বিচরনের ক্ষেত্র ব্যপ্ত ছিল সঙ্গীত পরিচালনা, রেকর্ড প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্র প্রযোজনা পর্যন্ত। দ্য বিটেলেসের চার সদস্যের একজন হিসেবেই তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়, তিনি অস্ত্র হাতে নন, গিটার হাতে গান গেয়ে যুদ্ধ করেছেন বহু দূরের অচেনা কিছু মানুষের জন্য। মানুষ মরণশীল। সে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে তারপর কিছুদিন জীবন যাপন করে এবং সবকিছুর পরিসমাপ্তি করে অজানায় পাড়ি দেয়। এভাবে যত মানুষ আসবে সবাই চলে যাবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটে যখন মানুষ হয় কীর্তিমান। গুণীজনরা বলে, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তিনি থাকেন নানা প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে আসেন আমাদের মধ্যে।
×