ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপকথন-৮ ॥ ষষ্ঠ বিশ্বকাপ : সুইডেন ১৯৫৮

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৭ মার্চ ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-৮ ॥ ষষ্ঠ বিশ্বকাপ : সুইডেন ১৯৫৮

যেন একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একবার ল্যাটিনে হলে দুইবার ইউরোপে। ঘুরে ফিরে বিশ্বকাপ সেই ইউরোপ-আমেরিকার গ-িতেই আটকে থাকল। প্রথমবার ল্যাটিনে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ইউরোপে; চতুর্থবার ল্যাটিনে আর পঞ্চম ও ষষ্ঠবার ইউরোপে। সেই ল্যাটিন-ইউরোপের গ-ি ছেড়ে বিশ্বকাপ বেরিয়ে আসতে পারল না। এবার আয়োজক সুইডেন। সুইডেন আয়োজক নির্বাচিত হলো ফিফার ৮৬টি সদস্য দেশের ভোটে। এবারও ষষ্ঠ বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল আগের মতোই ১৬টি দেশ। এবারও কোন দল নাম প্রত্যাহার করেনি। ফলে এবারের বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নেয় যথারীতি ১৬টি দেশ। এই ১৬টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৫৩টি দেশের মধ্যে থেকে। ওশেনিয়া থেকে এবারও কোন দেশ অভিষিক্ত হলো না। খেলল কেবল ইউরোপ এবং দ. আমেরিকা। অঞ্চল ভিত্তিক দলগুলো হলো- ইউরোপ : প. জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লাভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, উ. আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড; কনকাকাফ : মেক্সিকো; কনমোবল : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ষষ্ঠ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ৯০টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ৩৫টি ম্যাচ। সুইডেনের ১১টি স্টেডিয়ামে এই ৩৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চম বিশ্বকাপের মতো এবারও আবার গ্রুপিং করা হয়। গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোয়ার্টার ফাইনাল বিজয়ী ৪ দল সেমি-ফাইনাল ও সেমি বিজয়ী দুই দল ফাইনাল খেলে। এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল দুই সাবেক চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে ও ইতালির বাছাই পর্বের দেয়াল ডিঙ্গাতে না পারা। চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও স্বাগতিক সুইডেন সরাসরি মূল পর্বে খেলার সুযোগ পেলেও অপর দুই চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে ও ইতালি মূল পর্বে খেলতে ব্যর্থ হয়। আগের বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি হট ফেবারিট থাকলেও এবার টপ ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। কাপ শুরুর অনেক আগেই ব্রাজিল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়। এ কারণে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই অনেকে ব্রাজিলের পক্ষে বাজি ধরতে রাজি ছিল। এবার আগেভাগেই সবাই বুঝে গিয়েছিল, কাপ জিতবে ব্রাজিল। আগের বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি এ বিশ্বকাপে ততটা ফেবারিট ছিল না। পঞ্চম বিশ্বকাপের পর হাঙ্গেরির খ্যাতিমান ফুটবলাররা ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে, বিশেষ করে স্পেনে খেলতে ব্যস্ত থাকায় তাদের জড় করা সম্ভব হয়নি। ফলে হাঙ্গেরির জয়রথ গ্রুপ পর্বেই আটকে থাকে। যে কারণে তারা ওয়েলসকে টপকে কোয়ার্টারে পৌঁছতে পারেনি। অন্যদিকে এ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্যান্তোস ব্রাদার ছাড়াও জিটো, বেলিনি, ভাভা, ডিডি, জাগালো, গ্যারিঞ্চার সঙ্গে আবির্ভাব ঘটে কিংবদন্তি ফুটবলার এডমন্ড অরান্তেস দো নাসিমেন্তোর। যিনি সারা ফুটবল দুনিয়ায় ‘পেলে’ নামে সুপরিচিত। পরবর্তীকালে যিনি নিজেকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ষষ্ঠ বিশ্বকাপে নিজেদের অভিষেক ম্যাচে ব্রাজিলের পেলের সঙ্গে দর্শকদের নজর কাড়েন গ্যারিঞ্চা। দলনায়ক বেলিনির দক্ষ নেতৃত্বে ব্রাজিল একের পর এক সাফল্য পেতে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, ১৬টি দল ষষ্ঠ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এই ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হয়। ক গ্রুপ : প. জার্মানি, আর্জেন্টিনা, চেকোশ্লাভাকিয়া ও উ. আয়ারল্যান্ড; খ গ্রুপ : ফ্রান্স, যুগোশ্লাভিয়া, প্যারাগুয়ে ও স্কটল্যান্ড; গ গ্রুপ : হাঙ্গেরি, সুইডেন, মেক্সিকো ও ওয়েলস; ঘ গ্রুপ : ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অস্ট্রিয়া অংশ নেয়। ব্রাজিল, প. জার্মানি, সুইডেন ও ফ্রান্স গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া ও চেকোশ্লাভাকিয়া রানার্স আপ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। ব্রাজিল, সুইডেন, প. জার্মানি ও ফ্রান্স অর্থাৎ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ৪ দলই কোয়ার্টার ফাইনালে জয়ী হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল ওয়েলসের বিপক্ষে ১-০ গোলের কষ্টসাধ্য জয় পেলেও সেমি-ফাইনালে স্বরূপে ফেরে। তারা শক্তিশালী ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে আগাম জানিয়ে দেয় এবার বিশ্বকাপ তাদের। অপর সেমি-ফাইনালে স্বাগতিক সুইডেন ৩-১ গোলে হারায় চ্যাম্পিয়ন প. জার্মানিকে। অনুষ্ঠিত হয় ল্যাটিন-ইউরোপ ফাইনাল। তবে ফাইনালটা হয়ে যায় এক তরফা। আর সেই এক তরফা পানসে ফাইনালে ল্যাটিন ব্রাজিল ৫-২ গোলে ইউরোপের দল স্বাগতিক সুইডেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ছোঁয়ার গৌরব অর্জন করে। স্বপ্নের বিশ্বকাপ। যেটার জন্যে ব্রাজিলিয়ানরা লড়ছিল সেই প্রথম বিশ্বকাপ থেকে। ধরি ধরি করেও ধরতে পারছিল না। বার বার হাত ফসকে যাচ্ছিল স্বপ্নের বিশ্বকাপ। কিন্তু এবার আর ফসকাতে দেয়নি ব্রাজিলিয়ানরা। পেলে, গ্যারিঞ্চা, ভাভা, বেলিনিদের কৃতিত্বে এবার কাপ জয় করে। এই প্রথমবার ফেবারিটরা কাপ জয় করে। তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ঘটে আরেক চমক। ফ্রান্স ৬-৩ গোলে চ্যাম্পিয়ন প. জার্মানিকে হারিয়ে চমক দেখায়। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : পুল-১ : প. জার্মানি-৩ আর্জেন্টিনা-১; উ. আয়ারল্যান্ড-১ চেকোশ্লাভাকিয়া-০; প. জার্মানি-৩ চেকোশ্লাভাকিয়া-০; আর্জেন্টিনা-৩ উ. আয়ারল্যান্ড-১; চেকোশ্লাভাকিয়া-৬ আর্জেন্টিনা-১; প. জার্মানি-৩ উ. আয়ারল্যান্ড-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : প. জার্মানি গ্রুপ রানার্স আপ : চেকোশ্লাভাকিয়া। পুল-২ : ফ্রান্স-৭ প্যারাগুয়ে-৩; যুগোশ্লাভিয়া-১ স্কটল্যান্ড-১; যুগোশ্লাভিয়া-৩ ফ্রান্স-২; প্যারাগুয়ে-৩ স্কটল্যান্ড-১; ফ্রান্স-২ স্কটল্যান্ড-২; যুগোশ্লাভিয়া-৩ প্যারাগুয়ে-৩; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ফ্রান্স গ্রুপ রানার্স আপ : যুগোশ্লাভিয়া। পুল-৩ : সুইডেন-৩ মেক্সিকো-০; হাঙ্গেরি-১ ওয়েলস-১; ওয়েলস-১ মেক্সিকো-১; সুইডেন-৩ হাঙ্গেরি-১; সুইডেন-০ ওয়েলস-০; হাঙ্গেরি-১ মেক্সিকো-০; প্লে অফ : ওয়েলস-২ হাঙ্গেরি-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : সুইডেন গ্রুপ রানার্স আপ : হাঙ্গেরি। পুল-৪ : ইংল্যান্ড-২ সো. ইউনিয়ন-২; ব্রাজিল-৩ অস্ট্রিয়া-০; ব্রাজিল-০ ইংল্যান্ড-০; ব্রাজিল-২ সো. ইউনিয়ন-০; ইংল্যান্ড-২ অস্ট্রিয়া-২; প্লে অফ : সো. ইউনিয়ন-১ ইংল্যান্ড-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল গ্রুপ রানার্স আপ : ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনাল : ফ্রান্স-৪ উ. আয়ারল্যান্ড-০; প. জার্মানি-১ যুগোশ্লাভিয়া-০; সুইডেন-২ সো. ইউনিয়ন-০; ব্রাজিল-১ ওয়েলস-০; সেমি-ফাইনাল : ব্রাজিল-৫ ফ্রান্স-২; সুইডেন-৩ প. জার্মানি-১; তৃতীয় স্থান : ফ্রান্স-৬ প. জার্মানি-৩; ফাইনাল : ব্রাজিল-৫ সুইডেন-২; (পেলে-২, ভাভা-২, জাগালো) (লিডহোম, সিমোনসন) চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল রানার্স আপ : সুইডেন তৃতীয় স্থান : ফ্রান্স। পঞ্চম বিশ্বকাপে ব্রাজিলের নেতৃত্ব দেন বেলিনি আর সুইডেনের বার্গমার্ক। ফ্রান্স পায় তৃতীয় স্থান আর প. জার্মানি চতুর্থ। চতুর্থ বিশ্বকাপে মোট ১২৬টি গোল হয়। চতুর্থ বিশ্বকাপে সর্বধিক গোল করেন ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন। তিনি এ বিশ্বকাপে ১৩টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন ককসিস ২ বার, ব্রাজিলের পেলে এ বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেন। ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন মাত্র একটি বিশ্বকাপ খেলেছেন ১৯৫৮ সালে। এক বিশ্বকাপে একাই ১৩ গোল করেন। যা কিনা এক বিশ্বকাপে কোন স্ট্রাইকারের সর্বাধিক গোলের রেকর্ড হয়ে আছে এখনও। এ রেকর্ড এ পর্যন্ত আর কেউ ভাঙতে পারেনি। সহসা পারবে বলে মনে হয় না। চতুর্থ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ফ্রান্সের রেফারি গুইগ। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×