ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ার চাদরে মোড়ানো ফেঞ্চুগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৯ মার্চ ২০১৮

মায়ার চাদরে মোড়ানো ফেঞ্চুগঞ্জ

ফেঞ্চুগঞ্জ-ফ্রেন্স শব্দ হতে ফেঞ্চুগঞ্জ নামের উৎপত্তি কিনা জানি না। তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলাটা যেন মায়াবি প্রকৃতির চাদরে মোড়ানো ষোলোকলায় পূর্ণ। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র চিফ অর্গানাইজার মোঃ জাভেদ হাকিম। সিলেট প্রেসক্লাবের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক নবেল ভাইয়ের সহযোগিতায়, বন্যা পরবর্তী মানবতার কল্যাণে আয়োজিত একটি পোগ্রামে ‘দে-ছুট’ সংগঠনের বন্ধুরা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় গিয়েছিলাম। যাওয়ার পরপরই আমরা নিজেদের মতো করে ফেরি ঘাটের পাশে রাজনপুর গ্রামে চিরশায়িত হযরত শাহ্ মালুম [রঃ] মাজার দর্শন ও গাল্লিবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরখ করে নিয়েছি। জায়গাটা খুবই নৈসর্গিক । মাজার শরীফ আর বিলের মাঝে সমান্তরাল রেললাইন সত্যিই ভাললাগার মতো অনুভূতি কাজ করে। গাল্লিবিলে মাছ ধরার দৃশ্য আর হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটে চলার ঝিক ঝিক শব্দ শোনার ফাঁকে, প্রোগ্রামের জন্য সেল ফোনে তাড়া আসে। স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদউদ্দিন দাদা ভাই, আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে অপেক্ষায় আছেন। ওদিকে দুস্থ মানুষগুলোও পিঠাইটিকর গ্রামের স্কুল মাঠে জড়ো হয়েছে। তাই আর সময় ক্ষেপণ না করে আমরা দ্রুত সেখানে চলে যাই। শুরু করি ত্রাণ বিতরণ। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও অসহায় মানুষগুলোর মুখে ক্ষণিকের জন্য হাসি ফুটাতে পেরে আমরাও বেশ পুলকিত হই। বেলা প্রায় ১১টায় শুরু হওয়া প্রোগ্রামের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিসমাপ্তি হতে প্রায় ২টা ৩০মিনিট বেজে যায়। ত্রাণ কার্যক্রম শেষে, স্বভাব সুলভ আচরণের বহির্প্রকাশ। ফরিদ উদ্দিন দাদা ভাইকে চেপে ধরলাম, ভাই এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখান। ইতোমধ্যে পূর্ব পরিচিত বড় লেখা উপজেলার আরও দুই সাংবাদিক তপন দাদা ও লাভলু ভাইও এসে হাজির। সিলেটে আমি আছি শুনে বেশ সাংঘাতিকভাবেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে মোটরবাইকে চলে এসেছেন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য দাদা ভাইও রাজি। প্রথমে ভেবে ছিলেন কিন্তু আদি ঢাকার পোলাপানগো কাছে কোন ভাবই টিকে না-তা আরও একবার প্রমাণ করেছি। পিঠাইটিকর থেকে চলে যাই কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে মল্লিকপুর গ্রামের প্রগতি যুব সংঘ ক্লাবে। দাদা ভাইর সৌজন্যে সেখানে চলে দুপুরের খানাপিনা। আলাপচারিতায় জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে এই গ্রামের বীরত্বের ইতিহাস। দৃষ্টিনন্দন কুশিয়ারা নদীর উপর ঐতিহাসিক কুশিয়ারা রেল ব্রিজ। যা সিলেটের সঙ্গে বাংলাদেশের একমাত্র রেল যোগাযোগের মাধ্যম। স্বাধীনতার যুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই রেল ব্রিজ হতে আমাদের মুক্তিকামী গেরিলা বাহিনী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এই ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্ত হতে পার্শ্ববর্তী ইলাশপুর রেল ব্রিজে হানাদার বাহিনীর ট্রেন, গেরিলা বাহিনী বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বীরত্বপূর্ণ হামলা পাকিদের কবল হতে সিলেট মুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষ অবদান রাখে। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ অন্যদের চাইতে অনেকটাই ব্যতিক্রম। আমরা কোথাও ঘুরতে গেলে নিজেদের বিনোদনের পাশাপাশি, সে জায়গার প্রকৃতি-পরিবেশ, ইতিহাস ও মানুষের জীবনমান জানারও প্রবল আগ্রহ থাকে। সাধ্য অনুযায়ী সংগঠনের পক্ষ হতে, সেসব এলাকার উন্নয়ন ও অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার চেষ্টা থাকে। এরপর বিকেলের সোনামাখা রোদ সঙ্গী করে চলে যাই ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট। এখান থেকেই শুরু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। পর্যটকদের জন্য ঘাটে বাধা নানা প্রকারের নৌযান। শতবর্ষী বট বৃক্ষের ছায়ায়, বিশাল হাওড়ের বিশুদ্ধ বাতাসের ঝাপটা লাগে গায়ে। থৈথৈ করা পানির ছলাৎছলাৎ শব্দে মন আর বাধ মানে না। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সুরমানিউজ ২৪.কমের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। তাকে নিয়েই এবার ট্রলারে করে ছুটলাম বিশাল জলরাশির বুকে। পড়ন্ত বিকেলে হাওড়ের বুকে ভেসে চলা ট্রলারে তপন দাদার কণ্ঠে, ভাটিয়ালি গান শুনতে শুনতে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছাই। ট্রলার ছেড়ে একেবারে টাওয়ারের উপরে গিয়ে উঠি। ওয়াও! সু-উচ্চ টাওয়ার হতে চারপাশের নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর লাল আভা ছড়ানো সূর্যাস্ত, ভ্রমণপিপাসুদের মাঝে এক অন্যরকম উম্মাদনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এর আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর, তারমধ্যে শুধু বিলের আয়তনই ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। বুঝতেই পারতেছেন এর নয়নাভিরাম নান্দনিকতা কেমন হতে পারে। ওয়াচ টাওয়ারে আমাদের আড্ডাবাজি যখন চরমে, তখনি বর্তমানে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া বেলাল পানিতে দিল লাফ। এবার শুরু হলো কে কত লাফ দিতে পারে। আমিও পানিতে নামবো কিনা কেউ একজন জানতে চেয়েছিল। আমি তখন সাত-পাঁচ না ভেবে উত্তর দিলাম আবার জিগায়। ওমনেই আমিও দিলাম এক লাফ। বেশ খানিকটা সময় ধরে চলল ডুবাডুবি। দে-ছুটের দল ভিজে চুবুজুবু। যেন ভেজা কাপড়েই অনাবিল সুখ। ভর সন্ধ্যা, মাঝির হাকডাক। ওয়াচ টাওয়ারে এক স্মৃতিময় মুখোর জম্পেশ আড্ডা’য় ছেদ পড়ে। দিন শেষে নীড়ে ফেরা পাখির মতো আমরাও ফিরতি পথ ধরি। হাকালুকি ভ্রমণ তথ্য- বছরের বারো মাসই হাকালুকি হাওড় ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে এই হাওড়ের বিস্তৃতি। ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া ৩ ইউনিয়ন হতে হাকালুকি হাওড় শুরু। বর্ষায় পানি থৈথৈ আর নানা জাতের দেশী টাটকা মাছের বাহার। শীতকালে পরিযায়ী পাখির কলতান আর নানা প্রকারের সবজি, ভ্রমণপিপাসুদের বিনোদনের পাশাপাশি রসনা তৃপ্তিও মিটাবে বেশ। যোগাযোগ- ঢাকা থেকে বাসে-ট্রেনে দুইভাবেই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ যাওয়া যাবে। অথবা সিলেট শহর হতে লেগুনা বা সিএনজিতে ফেঞ্চুগঞ্জ। ঘোরাঘুরির জন্য সবচেয়ে ভাল হবে নিজস্ব গাড়ি/রেন্টকার নিয়ে গেলে। হাওড়ে নৌ-ভ্রমণের জন্য ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট খেয়াঘাটে নানা ধরনের নৌযান রয়েছে। ভাড়া ঘণ্টা প্রতি দরদাম করে নেয়াটাই উচিত হবে। খরচপাতি- দুই রাত একদিনের জন্য জনপ্রতি দুই হাজার টাকা হলেই যথেষ্ট।
×