ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজীব আহম্মেদ রাজু

প্রযুক্তি আর নিজস্ব মেধায় আরমান উড়াল উড়োজাহাজ

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১০ মার্চ ২০১৮

প্রযুক্তি আর নিজস্ব মেধায় আরমান উড়াল উড়োজাহাজ

দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই কবে এই কথাগুলো বলে গেছেন। কিন্তু যুগে যুগে স্বপ্নকে আশ্রয় করে তরুণরা সৃষ্টি করেছে। তেমনি এক স্বপ্ন থেকে কিশোর আরমান বানিয়েছেন আধুনিক বিমান। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন জয়ের আশা নিয়ে তার এগিয়ে চলা। প্রথমে ছোট ছোট উড়োজাহাজ বানিয়ে বাড়ির পাশে খেলার মাঠে উড়াতেন আর স্বপ্ন দেখতেন আরও ভাল কিছু করার। তারই ধারাহিকতায় আকাশ ছোয়া স্বপ্ন দিয়ে ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাঝারি মানের উড়োজাহাজ বানিয়ে স্বপ্ন পূরণের আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। বলছি গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রামের কিশোর আরমানুল ইসলাম আরমানের কথা। যিনি উড়োজাহাজ বানিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। শুধু উড়োজাহাজ দেখতেই নয়, তাকে দেখতেও প্রতিদিন শত শত মানুষের ভিড়। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার পুইশুর ইউনিয়নের মোঃ হাফিজুর রহমান সমাদ্দারের একমাত্র ছেলে আরমানুল ইসলাম। তিনি একই উপজেলার রামদিয়া এসকে কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আরমান ২০০১ সালের ১ আগস্ট রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার চাকরির সুবাদে ২০১৭ সালের বাগেরহাট জেলার বেতাগা ইউনাইটেড হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। তার বাবা বর্তমানে বাগেরহাটের মংলায় ব্র্যাক এনজিওতে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও আরমানুল ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্ভাবনী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে বলে মনে করেন তার কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এবং এলাকার মানুষ। তারা বলেন, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরমানের আবিষ্কার দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই উড়োজাহাজ বানানোর ইচ্ছা ছিল আরমানের। আর তাই তখন থেকেই সোলা দিয়ে ছোট ছোট উড়োজাহাজ বানিয়ে উড়ানোর চেষ্টা করতেন। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন একটি উড়োজাহাজ বানানোর মনস্থির করেন আরমান। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে তখন পেরে উঠেনি। এমনকি এসএসসি পাস করার পর গ্রামের বাড়িতে চলে আসতে হয় তাকে। আর তাই বাড়ির অদূরে রামদিয়া এসকে কলেজে ভর্তি হওয়া তার। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আবারও উড়োজাহাজ বানানোর জন্য মনস্থির করেন আরমান। যেটি বানাতে তার প্রযোজন ছিল ১২ হাজার টাকা। আর এ টাকার একটি বড় অংশ দেন তার দাদি হাফিজা বেগম। বাকি টাকা দেন তার বাবা এবং তার সহযোগী (চাচাতো বোন) সিতারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জাসিয়া আকতারের বাবা দুবাই প্রবাসী এনামুল হক। গত বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে শুরু হয় আরমানের উড়োজাহাজ বানানোর কাজ। সপ্তাহ দুয়েক চেষ্টার পর অবশেষে ৮ জানুয়ারি পরীক্ষামূলক আকাশে উড়ে তার উড়োজাহাজটি। ওইদিনই বাড়ির পাশের মাঠে উড়োজাহাজটিকে উড়ানো হয়। উড্ডয়নের পর প্রায় ১৫ মিনিট আকাশে উড়তে সক্ষম হয় তার নিজ হাতে বানানো উড়োজাহাজটি। এরপর একই মাঠে অবতরণ করা হয় এটি। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার বানানো উড়োজাহাজটি আকাশে উড়া দেখতে ভিড় করেন। কিশোর আরমানের আবিষ্কার করা উড়োজাহাজটি আকাশে উড়তে দেখে অবাক হয়েছেন। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চীন ও আমেরিকার মতো উন্নত প্রযুক্তির মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ ও ড্রোন বানাতে পারবেন তিনি, যা গোয়েন্দা কাজে, সেনাবাহনীর কাজের ক্ষেত্রে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে বলে দাবি করেন এই ক্ষুদে উদ্ভাবক। আরমান বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ভবিষ্যতে পাইলট বা ড্রোন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। তবে সরকারের সহযোগিতা আমার খুব প্রয়োজন। কারণ, আমার পরিবারের সচ্ছলতা নেই যে, আমাকে এসব কাজে সহযোগিতা করবে।’ আরমানুল ইসলাম আরও জানান, তার আবিষ্কৃত উড়োজাহাজটির ওজন ৮শ’ গ্রাম, দৈর্ঘ্য ৩৬ ইঞ্চি ও উইং ৫০ ইঞ্চি। এটিতে ব্র্যাশ লেস ডিসি মটর ব্যবহার করা হয়েছে। মটরের স্পিড কন্ট্রোল করার জন্য ইলেকট্রিক স্পিড কন্ট্রোলের সঙ্গে আরও ৪টি সারভো মটর লাগানো হয়েছে। ইলেকট্রিক স্পিড কন্ট্রোল মেইন মটরকে কন্ট্রোল করে। সারভো মটর এলোরন অ্যালিভেটর এবং রাডার কন্ট্রোল করে। উড়োজাহাজটি সিক্স চ্যানেলের একটি প্রোগ্রামেবল রিমোট সংযোজন করা হয়েছে। এটি দেড় কিলোমিটার রেঞ্জে চলতে পারে। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রেঞ্জ আরও বাড়ানো সম্ভব বলে দাবি আরমানের। তার সহযোগী চাচাতো বোন জাসিয়া আকতার বলেন, উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশে উড়ানোর খুব শখ ছিল আরমান ভাইয়ের। তিনি প্রায়ই বিষয়গুলো আমার সঙ্গে শেয়ার করত। এরপর আমিও তার এ কাজে সহযোগিতা করার ইচ্ছা পোষণ করি। তারপর তার সঙ্গে এটি বানাতে কাজ শুরু করি। উড়োজাহাজটি আকাশে উড়ার পর আমাদের খুব ভাল লেগেছে। ভবিষ্যতে আমরা দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আরমানের মা রেহানা পারভীন বলেন, ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কাজের প্রতি অনেক ঝোঁক ঝিল আরমানের। স্কুল জীবনে বিভিন্ন সময় বিজ্ঞান মেলায় সে অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছে। তাতে পুরস্কারও পেয়েছে। আর ছোটবেলা থেকে ওর একটি উড়োজাহাজ বানানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, তার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, তা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। পরে ওর দাদু, বাবা ও জাসিয়ার বাবার সহযোগিতায় টাকা জোগাড় হয়। গত নবেম্বর মাসে ওই টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে এটি বানানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে আরমান। এরপর উড়োজাহাজটি বানাতে ওর দুই সপ্তাহ লেগেছে। আরমানের মা হিসেবে আমি সত্যিই আমি গর্বিত। আমি চাই ওর এই উদ্ভাবনী কাজে সরকার পাশে থাকবে। রামদিয়া এসকে কলেজের শিক্ষার্থী ও আরমানের বন্ধুরা বলেন, আরমান অনেক মেধাবী ছেলে। সে অনেক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে এটি বানিয়েছে। যা আমাদের কলেজের জন্যও গর্বের। এই কলেজের ছাত্র হিসেবে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান নিত্যানন্দ রায় বলেন, আমরা যখন জানতে পারলাম ছেলেটি একটি উড়োজাহাজ বানাতে চায়। তখন আমরা তাকে উৎসাহ দিয়েছি। এরপর সে উড়োজাহাজ বানিয়ে আমাদের কলেজ মাঠে আকাশে উড়িয়েছে। এতে আমরা গর্বিত। সত্যিই এটি বানিয়ে আরমান সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমরা আনন্দিত ও অভিভূত। এই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আরমানুল ইসলাম উড়োজাহাজ বানিয়েছে। আর সেই এটি একই কলেজ মাঠে উড়িয়েছে। যা দেখতে শত শত মানুষ কলেজ মাঠে ভিড় করেছে। সত্যিই অনেক ভাল লেগেছে। আমরা কলেজ থেকে যতটুকু সম্ভব তার পড়াশোনার পাশাপাশি তার বিভিন্ন উদ্ভাবনী কাজে সহায়তার চেষ্টা করব। লেখক ॥ তৃণমূল সাংবাদিক
×