ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘পেট্রোলবোমা গণহত্যাকারী’ নেতার বিচার গণতন্ত্রের পথে আরেক অধ্যায় শুরু -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৫ মার্চ ২০১৮

‘পেট্রোলবোমা গণহত্যাকারী’ নেতার বিচার গণতন্ত্রের পথে আরেক অধ্যায় শুরু -স্বদেশ রায়

গণতন্ত্রের পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ দুটি পূর্বশর্ত- দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করা। দেশে কেউ বা কোন গোষ্ঠী যখন আইনের উর্ধে থাকে, তখন ওই দেশে নির্বাচিত সরকার থাকলেও গণতন্ত্র থাকে না। যেমন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ অবধি দেশে নির্বাচিত সরকার ছিল, তবে দেশে আইনের শাসন ছিল না। কারণ সংবিধানের ১৯৭৫-এর খুনীদের জন্য ইনডেমনিটি ছিল। অর্থাৎ সংবিধানের মাধ্যমে তখন কিছু বিশেষ লোককে আইনের উর্ধে রাখা হয়েছিল। আমাদের সংবিধানে যে মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত আছে সেখানে বলা আছে, সংবিধান সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করে। তাই যখন কোন বিশেষ গোষ্ঠীকে বা কয়েক ব্যক্তিকে ওই সংবিধানের মাধ্যমে বিশেষ অধিকার দেয়া হয় তখন আর ওই সংবিধানের কোন অর্থ থাকে নাÑ দেশে গণতন্ত্রও থাকে না। তখন নির্বাচিত সরকার বাস্তবে অগণতান্ত্রিক সরকার বা কোন স্বৈরসরকারের উত্তরাধিকার বা অনুসারী হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে ইনডেমনিট অধ্যাদেশ বাতিল করে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পরে ১৯৭৫ এর খুনীদের বিচার শুরু হয়। এই বিচার শুরুর ভেতর দিয়ে দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করে। কারণ ইনডেমনিটি বাতিল ও খুনীদের বিচার কাজ শুরু হওয়ার ভেতর দিয়ে সংবিধানের মূল চেতনার পথে আবার যাত্রা শুরু হয়। সংবিধান তার নিজস্ব চরিত্র ফিরে পেতে শুরু করে, অর্থাৎ এদেশে সব নাগরিক সমান আইনগত অধিকার পাবার সুযোগ ফিরে পায়। ’৭৫-এর এই খুনীদের বিচার কাজ শুরুর পরে ও ইনডেমনিটি বাতিলের মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের পথে এ যাত্রা শুরু হলেও যাত্রাটি পরিপূর্ণ ছিল না। কারণ, ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে হত্যাকারীদের বাঁচানোর জন্য সংবিধানে ইনডেমনিটি যোগ করাই শুধু ক্ষমতা দখলকারীদের একমাত্র কাজ নয়, সংবিধানের চরিত্র অনেক পরিবর্তনও করে তারা। পাশাপাশি ১৯৭১ সালে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ করেছে এমন তিরিশ হাজারের বেশি বন্দীকে জেলখানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে হত্যাকারীদের নেতাদের রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। তারা দেশে ফিরলে বা প্রকাশ্যে বের হলেও গণহত্যাকারী হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা বা বিচারের সম্মুখীন করা হয় না। বরং তারা অলিখিতভাবে রাষ্ট্রে ও সমাজে অধিক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১-এর অক্টোবর অবধি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও ’৭১-এর এই গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যার ফলে গণহত্যারীরা ও তাদের নেতারা এক ধরনের অলিখিতভাবে এ দেশে আইনের উর্ধে উঠে যায়। উর্ধে উঠে যায় সংবিধানের। এই সুযোগে সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ, আরেক সামরিক শাসক জিয়ার উত্তরাধিকার খালেদা তাদের নিয়ে জোট বেঁধে একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ওই গণহত্যাকারীদের দু’জনকে মন্ত্রী বানায়, অপর একজনকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়। গণহত্যাকারীদের এই উত্থান স্বাভাবিকভাবেই দেশের ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা এবার সরকারী উদ্যোগে আবার গণহত্যার পথ বেছে নেয়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের মূল নেতা খালেদা জিয়া ও তার ছেলে সরাসরি এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত হন। তারা বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার সপক্ষের নেতৃত্ব শেষ করে দেয়ার জন্য শেখ হাসিনাসহ অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করতে কয়েক জঙ্গীকে পাকিস্তানী ও আফগান ট্রেনার দিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। ওই সব প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালায়। সরকারী হিসেবে ২৩ জন বাস্তবে ৫০-এর অধিক নেতা-কর্মী ওইদিন নিহত হন এবং হাজার হাজার নেতা-কর্মী আহত হন। এই গণহত্যা ছাড়াও ওই সময়ের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গীদের মাধ্যমে বিচারক হত্যা, এমপি হত্যাসহ অনেক হত্যাকা- ঘটে। ওই সব হত্যাকারীকে সরকার প্রোটেকশন দেয়। অর্থাৎ ২০০১ থেকে যে সরকারটি বাংলাদেশে আসে, সেটা বাস্তবে ১৯৭১ সালের ইয়াহিয়া সরকারের একটি ছায়া সরকারের মতো হয়। ১৯৭১ সালে সরকার গণহত্যা করেছিল প্রকাশ্যে, এবার চলতে থাকে সরকারী প্রটেকশনে। এর সঙ্গে সারাদেশে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পায় বাংলাভাইসহ নানা জঙ্গী। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ’৭১-এর খুনীদের এই উত্থান এক ধরনের চরমরূপ ধারণ করে। ১৯৭৫ এর পনেরো আগস্টের পর থেকে এই ’৭১-এর খুনীদের উত্থান শুরু হওয়ার পাশাপাশি মানুষের ক্ষোভও এদের প্রতি বাড়তে থাকে। কারণ এদের হাতেই তো একাত্তরে লাখ লাখ লোক নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মা-বোন ধর্ষিতা হয়েছে। এই সব ধর্ষক ও খুনী আবার দেশের দ-মু-ের কর্তা হবে, আবার তারা দেশে গণহত্যা চালাবে, দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে- এ হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি ক্ষোভের বিষয়। তারা তাদের পূর্বসূরিদের রক্তের, শ্লীলতার বিনিময়ে অর্জিত এই দেশকে এভাবে ধ্বংসের পথ থেকে বাঁচাতে চায়। আওয়ামী লীগ তাদের এ ক্ষোভকে বুঝতে পারে। তারা উপলব্ধি করে, তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে কোন্ পথে কীভাবে বিচার করতে হবে সেটা তরুণ প্রজন্মের বোঝার কথা নয়। অন্যদিকে স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে তিন দশক পরেই শুধু নয়Ñ যে দেশে প্রতিবিপ্লবী শক্তি রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে, ওই দেশে স্বাধীনতার সময়ের গণহত্যাকারীদের বিচার করা ও তাদের শাস্তি দেয়া ছিল একটি কঠিনতম কাজ। পৃথিবীতে যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম, রাষ্ট্র বিপ্লব প্রভৃতির দায় সাহসীতম নেতারা নেন, এখানেও তেমন সাহসী নেতার প্রয়োজন। ঠিক সেই সাহস নিয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের আকাক্সক্ষা পূরণ শুধু নয়, বাংলাদেশকে আইনের শাসনের পথে নেয়ার দায় নিতে কাঁধ পেতে দেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ এর নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি দেশবাসীকে জানান, তাঁকে ম্যান্ডেট দিলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। তরুণ প্রজন্মের প্রায় শতভাগ এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে সে ম্যান্ডেট দেয়। জনগণের ম্যান্ডেট এবং সংসদের জনপ্রতিনিধিদের অনুমোদন নিয়ে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের গণহত্যা, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচারের জন্য হাইকোর্টের মর্যাদায় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ওই ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের ও গণহত্যাকারীদের বিচার এখনও চলছে। শুরুতেই শেখ হাসিনা একাত্তরের গণহত্যাকারী ও গণহত্যার রূপকারদের বা হুকুমদাতাদের বিচার করেছেন। তাদের বিচার শুরু ও বিচারের রায় কার্যকরের দাবিতে যেমন এদেশে তরুণ প্রজন্ম বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো রাজপথে নেমে আসে, তেমনি এদের রক্ষা করতে শেষ অবধি গণহত্যার ও সরকারী সম্পত্তি ধ্বংসের পথ বেছে নেয় ’৭৫-এর প্রতি বিপ্লবী শক্তির বর্তমান মূল নেতা খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে ২০১২ সাল থেকে শুরু হয় দেশে একাত্তরের গণহত্যাকারী ও তাদের পক্ষশক্তিকে রক্ষা করতে ভয় ছড়ানোর জন্য পেট্রোলবোমার মাধ্যমে গণহত্যা। সরকার শুরুতেই বুঝতে ভুল করে প্রতিবিপ্লবীরা আবারও গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এবার একাত্তরের মতো বা ’৭৫-এর মতো ট্যাঙ্ক বা কামান দিয়ে গণহত্যা করতে না পারলেও পেট্রোলবোমার মাধ্যমে গণহত্যা করছে। সরকারের এই ব্যর্থতার কারণে শুরুতে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছিল বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। এখানে সরকারের এই না বুঝতে পারার কোন কারণ ছিল না, যেহেতু সাঈদীর মামলার রায়ের পরে খালেদা একাত্তরের ও ’৭৫-এর ঘাতক জোট বা ২০ দলীয় জোটের মিটিং ডেকে সহিংস পথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর পথ নেয়। যা হোক, সরকার শেষ অবধি বুঝতে পারে এবং বেশ কয়েকটি গণহত্যার হুকুমের আসামিদের নামে মামলা করে। কয়েকটি মামলার একটি হলো ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ এ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায়। ওই থানার এসআই নুরুজ্জামান বাদী হয়ে বেগম জিয়া, রুহুল কবির রিজভী, সালাউদ্দিন আহমেদ ও রফিকুল ইসলাম মিয়াকে হুকুমের আসামি করে ৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কারণ এদের হুকুমে চৌদ্দগ্রাম জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘুমন্ত বাসযাত্রীদের ওপর পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। ওই বোমায় পুড়ে সাতজন যাত্রী একেবারে কয়লা হয়ে যায়, মৃত্যু পথযাত্রী সাতজনকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। তাদেরও সবাই বাঁচতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রে ও সমাজে ভয় ছড়ানো এবং সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে সাতজন যাত্রীকে পুড়িয়ে কয়লায় পরিণত করা হয়। ২৮ জন আগুনে পুড়ে আহত হয়ে শরীরের অঙ্গ ও আকৃতি হারিয়ে ফেলে। এই গণহত্যার বিচারের কাজ বিচারিক আদালতে শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ২৮ মার্চ। এই মামলায় খালেদাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাই জেলখানায় থাকা খালেদাকে ২৮ মার্চ কুমিল্লার বিচারিক আদালতে হাজির করা হবে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্য হুকুমের আসামিদেরও ২৮ তারিখের আগে গ্রেফতার করে সেদিন আদালতে হাজির করা উচিত। এই বিচার শুরু হওয়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কারণ কোন গণতান্ত্রিক দেশে প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রতিবিপ্লবী শক্তি, গণহত্যাকারী শক্তি বা তাদের সহায়ক শক্তি থাকতে পারে না। যতদিন তারা বিচারের বাইরে থাকে ততদিন ওই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। সমাজেও সুস্থ বুদ্ধির চর্চা শতভাগ সম্ভব হয় না। বাংলাদেশেও বর্তমানে যে একশ্রেণীর অসুস্থ বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা চলে এবং গণতন্ত্রের নামে খুনীরা রাজনীতি করে তার মূল কারণ, রাজনীতিতে পা গেড়ে রাখা এই প্রতিবিপ্লবী ও গণহত্যাকারী শক্তি বিচারের আওতার বাইরে আছে এখনও। বাংলাদেশের ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু উত্তরকালে শেখ হাসিনার মতো সাহসী নেত্রী পেয়েছে। তিনি ধাপে ধাপে দেশকে আইনের শাসনের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। যার প্রথম ধাপ ছিল পঁচাত্তরের খুনীদের বিচার, দ্বিতীয় ধাপ ’৭১-এর খুনীদের বিচার, এখন তৃতীয় ধাপে এসেছে ’৭১ ও ’৭৫-এর খুনীদের রক্ষাকারী গণহত্যাকারীদের বিচার। সরকার যখন ’৭৫-এর খুনীদের বিচার করেছিল, সে সময় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ছিল না। এখন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আছে। আশা করা যায়, বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে এসে পেট্রোলবোমার এসব গণহত্যার বিচার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে চলে আসবে। [email protected]
×