ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মীর আবদুল আলীম

দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্র!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৬ মার্চ ২০১৮

দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্র!

বাংলাদেশের বেসরকারী বিমান চলাচল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছে। ইতিবাচক কথা হলো, গত কয়েক বছরে আমাদের জাতীয় পতাকাবাহী বিমানের বহর বড় হয়েছে। বিদেশে দাবড়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের বেসরকারী বিমান। দেশের অভ্যন্তরে ও আশপাশের দেশগুলোতে যাত্রী পরিবহনে যুক্ত এসব বিমান। এর মধ্যে ইউএস বাংলা অন্যতম। ইউএস বাংলার যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। মাত্র ৪ বছরে এই বিমান কোম্পানি দেশের সেরা বিমানের মর্যাদা পায়। আন্তর্জাতিক রুটেও যথেষ্ট সুনাম ইউএস বাংলার। তারা এগিয়ে যাচ্ছিল দুর্বার গতিতে। দেশ ছাড়িয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মাসকাটে দক্ষতার সঙ্গে দেশীয় এই বিশাল সংস্থাটি বিমান পরিচালনা করে সুনাম পায়। ইউএস বাংলা একটি কাজ করতে যাচ্ছে চলতি বছর। বাংলাদেশ বিমানও যেখানে চীনে ফ্লাইট দিতে ব্যর্থ, সেখানে আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে ইউএস বাংলা ২-১ মাসের মধ্যে চীনে তাদের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। হাজীদের উদ্দেশে জেদ্দায় তাদের ফ্লাইট শুরু হচ্ছে চলতি বছরই। অল্প সময়ে ইউএস বাংলার এত সাফল্যে ঈর্ষায় অনেকেই। নানা কারণে আন্তর্জাতির অনেক বিমান সংস্থার রোশানলে আছে ইউএস বাংলা। বাংলাদেশের বিমানের এত দাপটে, অনেক দেশী-বিদেশী বিমান সংস্থা পেছনে চলে আসছিল, আর তাতেই তারা ঈর্ষণীয় হয়। ইউএসবাংলা বিমান দুর্ঘটনা পরিকল্পিত কিনা তাও এখন ভাববার বিষয়। নেপাল বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত বিমানটি অবতরণের সময় ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে বার বার বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনা ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। পত্রিকাগুলোও তাই লিখছে। এটি ষড়যন্ত্র! এটি সুনামের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ইউএস বাংলার যাত্রা বাধাগ্রস্ত করার জন্যও হতে পারে। এটি খোদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও হতে পারে। এ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ তদন্তসাপেক্ষ। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের ভুল বার্তার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পত্রপত্রিকাও সংবাদ ছেপেছে। নেপাল বিমানবন্দরে টাওয়ার থেকে ভুল তথ্য এবং বিভ্রন্তি তৈরির বিষয়টি এখন অনেকটাই স্পষ্ট। পাইলটের অডিও থেকে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। টাওয়ার থেকে বলা হয়, ‘বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান। রানওয়ের কোন্ প্রান্তে নামতে চান। জিরো টু অথবা টু জিরো।’ উত্তরে পাইলট বলেন, ‘আমরা টু জিরোয় (উত্তর রানওয়ে) নামতে চাই।’ কথোপকথনের ১ মিনিট ২২ সেকেন্ড পর টাওয়ার থেকে বলা হয় ‘ঠিক আছে’। রানওয়ে টু জিরো ক্লিয়ার। বাতাসের গতি তখন ঘণ্টায় ২৭০ ডিগ্রী ৬ নটিক্যাল মাইল। টাওয়ারের উত্তরে পাইলট বলেন, ‘জানলাম (কপিড)। ল্যান্ডিংয়ের জন্য ক্লিয়ার।’ ঠিক সে মুহূর্তে টাওয়ার থেকে আবার বলা হয়, বাংলাস্টার আপনারা কি রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন, নিশ্চিত করুন। পাইলট তখন জানান নেগেটিভ স্যার। টাওয়ার থেকে তখন বলা হয়, বাংলাস্টার টু ওয়ান ওয়ান ডানে ঘুরুন। এখনও রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন না? পাইলট তখন বলেন, হ্যাঁ, পাচ্ছি। ল্যান্ডিংয়ের জন্য অনুমতি চাচ্ছি। (রিকোয়েস্টিং ক্লিয়ার টু ল্যান্ড স্যার)। টাওয়ার থেকে তখন বলা হয়, হ্যাঁ, অনুমতি দেয়া হলো। কিন্তু উত্তর অংশে নামার অনুমতি পাওয়ার ঠিক এক মিনিটের মাথায়ই পাইলট আবার দক্ষিণ (জিরো টু) রানওয়েতে অবতরণ করতে যাচ্ছেন বলে জানান। টাওয়ারও অনুমোদন দেয়। এ সময়ই আবার পাইলট টাওয়ারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের অবতরণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে কিনা? জিরো টুতে অনুমোদন দেয়ার ঠিক ৫০ সেকেন্ড পরে টাওয়ার থেকে চিৎকার করে ডানদিকে ঘুরতে বলে। এর কিছুক্ষণ পরেই রানওয়ে বন্ধের ঘোষণা আসে। কিন্তু ততক্ষণে ফ্লাইটটি রানওয়ে ছুঁয়ে ফেলে। আর টাওয়ারের নির্দেশে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় উড়োজাহাজটি। বিষয়টি অনেকটাই ষ্পষ্ট, কি ঘটেছিল সেদিন নেপালের বিমানবন্দরে? ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের এ জাতীয় টালবাহানার হেতু কি? তা অনেকটাই ষ্পষ্ট। ইউএস বাংলার সামনে এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের বিমানের বড়ধরনের প্রতিনিধি অনেকেই হয়ত ভাল দৃষ্টিতে নিচ্ছে না। বন্দরের টাওয়ারের সংশ্লিষ্টদের অর্থ দিয়ে কেউ কি তা ঘটিয়ে থাকতে পারেন? এটাও তদন্ত হোক। এটা আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হওয়া খুব জরুরী। ষড়যন্ত্র হলে এতে কারা জড়িত তাও তলিয়ে দেখা দরকার। নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সে সময় দায়িত্বে থাকা ছয় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এটা প্রাথমিক শাস্তিরই অংশ বলা যায়। তাদের ভুলভ্রান্তি ধরা না পরলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ হয়ত তা করতেন না। যদি ভুলে তা হয়ে থাকে তার দায় কে নেবে? ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারী বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৫১ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে ২৬ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এ ক্ষতির দায় অবশ্যই কাউকে না কাউকে নিতে হবে। আমরা এ দুর্ঘটনার সঠিক এবং দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যাপারগুলো চিহ্নিত করার জন্য যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, আমরা আশা করব, ওই কমিটি যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবে। তবে, ফ্লাইট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের দিক থেকে কোন ভুলভ্রান্তি ছিল না বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। আমরা জানি, ত্রিভুবন বিমানবন্দর বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি। এ বিমানবন্দরে এর আগেও বেশ কয়েকবার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। পাহাড় ঘেরা এই বিমানবন্দরটি কাঠমান্ডু উপত্যকায় এবং শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। একের পর এক বিমান দুর্ঘটনার কারণে এই বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। নেপালের বিমানবন্দরে কর্মরতদের দক্ষতা নিয়ে এর আগে অনেক প্রশ্ন ওঠে। নেপাল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা বলছেন, বিমানবন্দরটিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোন বিমান অবতরণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বিমানের পাশাপাশি সেখানে হেলিকপ্টারও বিধ্বস্ত হয়েছে অনেক। উইকিপিডিয়া বলছে, নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানে একের পর এক বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ১৯৯২ সালে থাই এয়ারওয়েজের একটি এয়ারবাস অবতরণ করার জন্য বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়ে। এতে ১১৩ জন যাত্রীর সকলেই নিহত হন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হয় আরও একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা। পিআইএর বিমানটি বিধ্বস্ত হলে বিমানের ভেতরে থাকা ১৬৭ জনের সবাই প্রাণ হারান। ১৯৯৫ সালে রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান বেষ্টনী ভেঙে মাঠের ভেতরে ঢুকে যায়। তাতে দুজন নিহত হন। লুফথানসার একটি বিমান এয়ারপোর্ট থেকে উড়ান শুরু করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। তাতে পাঁচজন নিহত হয়। এটি ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। ওই একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নেকন এয়ারের একটি বিমান ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি টাওয়ারের সঙ্গে সংঘর্ষে কাঠমান্ডু থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি অরণ্যে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১০ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রুর সবাই নিহত হন। ২০১১ সালে বুদ্ধ এয়ারের একটি বিমান বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় ২০ জন আরোহীর মারা যান। ২০১২ সালে সিতা এয়ারের একটি বিমান উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয়। এতে ১৯ জন আরোহীর সবাই মারা যান। ২০১৫ সালে তুর্কী এয়ারলাইন্সের একটি বিমান নামতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়ে। ৩০ মিনিট ধরে এটি বিমানবন্দরের ওপর উড়তে থাকে। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় নামতে পারলেও সেটি রানওয়ে থেকে ছিটকে মাঠের ঘাসের ওপর চলে যায়। সে সময় ২২৭ জন যাত্রী আহত হন। ২০১৭ সালের মে মাসে সামিট এয়ারলাইন্সের একটি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। সর্বশেষ দুর্ঘটনার শিকার হলো ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমানটি। ক্ষণে ক্ষণেই মনে হচ্ছে এটি ষড়যন্ত্র। এটি খোদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। পরিশেষে বলতে চাই, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের একের পর এক বিমান দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তাতে নেপাল সরকার কি করছে? তারা ভাবনাহীন মনে হয়। বিমানবন্দরটি কেন তারা নিরাপদ করতে পারছে না? নাকি নিরাপদ করছে না। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, দায়িত্বহীন বিমানবন্দরে বিমান পরিচালনা কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের বিমান ইউএস বাংলা বিধ্বস্ত হওয়ার পর নেপালে বিমান চলাচলে নিরাপত্তার দুর্বলতার বিষয়টি আবারও চোখে সামনে চলে এলো। নেপালে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে তাদের সমালোচনা হয়েছে। তাতেও তারা শতর্ক হয়নি কখনও। তাই এবারও যা হওয়ার তাই হলো। আমরা এ জাতীয় বিমান দুর্ঘটনা আর চাই না। লেখক : সাংবাদিক
×