ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব শর্মা

দ্যুতিময় স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ১৬ মার্চ ২০১৮

দ্যুতিময় স্মৃতিকথা

লেখালেখির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন বিষয় কোন্টি-এমন প্রশ্ন যদি কেউ করে আমাকে আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দেবো আত্মজীবনী বা আত্মস্মৃতি লেখা। তখন যদি প্রশ্নকর্তা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘নিজের অতীত নিয়ে লেখা এ আবার কঠিন কি? সেটাতো সহজই! আমি বলবো, সত্যিই কি তাই? সহজ কথা কি সহজে বলা যায়, বলতে পারেন সবাই? নিশ্চয়ই না; সহজ কথা সহজে বলা যায় না। সবাই বলতে পারেন না। বিশেষ করে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী খ্যাতিমান লেখকরা অনেকক্ষেত্রেই অকপটে প্রকাশ করতে পারেন না স্মৃতিময়তার আখ্যান। বিতর্কিত হতে চান না বলেই এড়িয়ে যান সত্যকে! কবি বলেছিলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ অথচ আত্মকথন লিখতে গিয়ে সত্যকে উপেক্ষা করে যান অনেকেই। তবে সবাই যে সেটা করেন তা কিন্তু নয়। এমন অনেকে আছেন যারা অবলীলায় বলেন জীবনের কথা। তাদের সেই সত্য কথন আমাদেরকে প্রাণিত করে, পথ দেখায় সুন্দরের পথে চলতে। এবারের বইমেলায় তিন প্রখ্যাতের এমনই তিনটি আত্মস্মৃতি বের হয়েছে যা ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে পাঠকপ্রিয়তা। দ্বিজেন শর্মার, ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’, শওকত আলীর ‘অবিস্মৃত স্মৃতি’ এবং হরিশংকর জলদাসের ‘নোনাজলে ডুবসাঁতার’-দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে বোদ্ধাদের। বিশেষ করে দ্বিজেন শর্মা ও শওকত আলীর প্রয়াণ পরবর্তী দুটি আত্মজীবনী প্রকাশ তাদের সম্পর্কে পাঠকদের জানার আগ্রহ মেটাতে সক্ষম হয়েছে অনেকাংশে। রাখঢাক না করে সোজাসাপ্টা এমন অনেক কথাই তারা বলেছেন, যা পাঠকদের করেছে আপ্লুত। . মধুময় পৃথিবীর ধূলি পৃথিবীটা মধুময় ছিলো দ্বিজেন শর্মার কাছে। ভিন্নদৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখেছেন তিনি। সাধারণের সঙ্গে মহৎপ্রাণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ঠিক কতোটা পার্থক্য তা তাঁর জীবনস্মৃতি পাঠে ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়! একজন দ্বিজেন শর্মা নানা কারণেই আলোচিত ছিলেন বাংলাদেশে। শুদ্ধ জীবনাচার, ন্যায়নিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি অকৃতিম ভালোবাসা অনন্য মানুষে রূপান্তরিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি যখন কলম ধরলেন জীবন নিয়ে তখন সরলতার আখ্যানেই নির্মাণ করলেন ক্যানভাস। আত্মহঙ্কার কিংবা অহমিকার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই তাতে। আছে সারল্যভরা জীবনপ্রবাহের আখ্যান। সত্য বলতে ভালো বাসতেন দ্বিজেন শর্মা। কঠিন যেনেও তিনি করেছেন সত্যের সাধনা। তাই জীবনস্মৃতি নিয়ে লিখতে গিয়ে অকপটেই স্বীকার করলেন অক্ষমতার কথা। নানা পর্বে সাজানো গ্রন্থের পর্ব শিরোনামগুলোও বেশ নান্দনিক। পটভূমির যৎকিঞ্চিৎ, কিশোরকালের কথা, ফুল তুলিতে ভুল, উড়নচণ্ডে পুত্রের প্রত্যাবর্তন, পণ্ডিতম্মন্যের বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন, বরিশাল নিয়তিনির্বন্ধ, পুনশ্চ ঢাকা : সুবর্ণের সন্ধানে, ক্রান্তিকালের কথকতা, আমার দেশের মাটি, এলাম নতুন দেশে, পরিশেষ- শিরোনামে জীবনস্মৃতির আখ্যানকে বিন্যস্ত করেছেন তিনি। ঐতিহাসিক পটভূমিতে সূচনা করেছেন কথামালার। প্রথমেই জানান দিয়েছেন জীবনের সঙ্গে ইতিহাসের সম্মিলনেই এগিয়ে যাবেন তিনি। সূচনা থেকে উদৃত করলেই খোলাসা হবে বিষয়টি। ‘আমাদের একই গ্রামের ঠিকানা কয়েকবার পালটেছে, অর্থাৎ বদলেছে রাজনীতির সঙ্গে ভূগোল।’ তাঁর এইযে উক্তি সেখানেই নিহিত আছে মনোবেদনার আখ্যান। এই পরিবর্তন তাঁর মনে দাগ কেটেছে বলেই গ্রন্থের শুরুতে সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন তিনি। যেন না বলেও বলে দিয়েছেন, ভালো লাগেনি এই ভাগাভাগি আর পরিবর্তন। আসলে দ্বিজেন শর্মার মতো মানুষেরা যে ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে আবৃত রাখতে পারেন না নিজেদের সেটাই প্রতিভাত হয়েছে তাঁর বক্তব্যে। এই পর্বে স্মৃতিময় শৈশবকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন তিনি যা আমাদের নিয়ে গেছে ছায়াসুনিবিড় পল্লী গাঁয়ে। যে গ্রামকে আজীবন হৃদয়ে লালন করেছেন তিনি। মূলত প্রকৃতির প্রতি ভালোলাগার সূত্রপাত হয়েছিল সেই থেকেই। একাত্তরকে দহনকালের কথা বলতে গিয়ে কোনও ছলচাতুরির আশ্রয় নেননি তিনি। নির্মোহভাবে বলেছেন, উত্থান-পতনের কথা। তাঁর এই আত্মস্মৃতি ভিন্নমাত্রা পেয়েছে হাসান আজিজুল হকের কল্যাণে। পুরো জীবনস্মৃতিকে কতিপয় কথা দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন হাসান আজিজুল হক, যা হজেই একজন দ্বিজেন শর্মাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে আমাদের। ‘মোট দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে যেমন দ্বিজেন শর্মাকে তাঁর জীবনসাধনাসমেত জেনে নেওয়া যায়, তেমনি এর পাশাপাশি তাঁর সমকালের একটি বহুকৌণিক প্রতিচ্ছবিও এখানে মেলে। শৈশবেই কীভাবে তাঁকে প্রকৃতি মুগ্ধ করেছিল, পরে সেই মুগ্ধতা থেকে কী করে নিসর্গবিশারদের বিশ্লেষণী জগতে তাঁর পদার্পণ, শিক্ষালাভ ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, একাত্তরে প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে থাকার উপাখ্যান, পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় অনুবাদকের কাজ নিয়ে পদার্পণ ও মোহভঙ্গের দিনলিপি, অবশেষে দেশে ফিরে গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা-সবই তিনি এক অনুপম গদ্যে বিবৃত করেছেন। কোথাও আমিত্বের বাগাড়ম্বর নেই, নেই কোনো কিছুকে অহেতুক মহান বা খাটো করার আকাক্সক্ষা। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক সহজাত আকর্ষণ অনুভব করার কথা তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে লিখেছেন, আবার সোভিয়েত রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক অন্দরমহলের ভয়াবহ দুর্নীতির কথাও বিবৃত করতে ভোলেননি। বস্তুত, এই জীবনস্মৃতি যেন লেখা হয়েছে কবি এবং বিজ্ঞানীর সত্তার যুগলসম্মিলনে।’ কতিপয় কথায় অন্দরের সকল কথাই বলে দিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। শুধু তাই নয়, এই গ্রন্থটিকে তিনি ‘এক অমূল্য সম্পদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক আগেই লেখার কথা ছিলো জীবনীটি। কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। শুরুটা করলেও এগিয়ে নিতে পারেন নি। প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি সেভাবে! তবে, ২০১৫ সালে ১৩ বছরের ব্যবধানে শেষ হয় জীবনস্মৃতির আখ্যান। যা কথাপ্রকাশের কল্যাণে আলোর মুখ দেখলো অবশেষে। কিন্তু ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’র গ্রন্থরূপ দেখে যেতে পারেন নি দ্বিজেন শর্মা। এটাই আজ বেদনাহত করছে আমাদের। . অবিস্মৃত স্মৃতি ‘আত্মকথা শেষ হতে না হতেই তিনি পৃথিবীলোক থেকে পরপারে যাত্রা করেন’-কথাগুলো প্রসঙ্গকথায় লিখেছেন আসিফ শওকত কল্লোল। শওকত আলীর মেঝো ছেলের এমন বক্তব্যে বিক্ষত হয় আমাদের হৃদয়। কৌতূহলী মন বলে উঠে এ কারণেনই কি শেষবেলায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন শওকত আলী। অজানা কথা জানান দেওয়ার জন্যই কি গ্রহণ করেছিলেন পাণ্ডুলিপি তৈরীর প্রয়াস? কেন জানি মনে হয়, হয়তো তাই! দায়িত্ব শেষ করেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। আমরা যাদের ক্ষণজন্মা বলে থাকি, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত আলী তাদের একজন। এপার-ওপার দুইপারেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। রচনাশৈলীতে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন অনেককেই। অবিস্মৃত স্মৃতির আখ্যানটি অনুলিখনে নির্মিত হয়েছে। লেখক, শিক্ষক আব্দুস সাত্তার এজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। যা মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না। শওকত আলী প্রসঙ্গে তার উপলব্ধিটি এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’ নিজের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের কালীতলায় বসে লেখেন এবং তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। তারপর থেকে তিনি নিরন্তর লিখেছিলেন আরো ৩০টি উপন্যাস, ৪০টির মতো গল্প, শিশু-কিশোরদের জন্যও যথেষ্ট গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, কবিতা, প্রবন্ধও লিখেছেন। সাহিত্য সমালোচকদের অনেকেই মনে করেন শওকত আলী অন্য কোনো কিছু না লিখলেও ওই একটা উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রকৃতজন’ লেখার জন্য বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন।’ একজন লেখক কতোটা শক্তিশালী হলে মাত্র একটি উপন্যাসের জন্য তাঁকে এমন উচ্চতায় আসীন করার কথা চিন্তা করা হতে পারে তা বোধহয় শব্দ দিয়ে বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। লেখায় মানুষের জীবনভাবনা, আত্মত্যাগ, শোষণ-নির্যাতনের কথা এমনভাবে তুলে ধরেছেন তিনি যা আমাদেরকে পরিচিত করিয়েছে এমন সব বিষয়ের সঙ্গে যা এতকাল ছিলো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। যার লেখনি এমন সমৃদ্ধ তাঁর ব্যক্তিজীবনে সমৃদ্ধি থাকবে না সেটা ভাববার অবকাশ নেই। মায়াবি মুচকি হাসির এই লেখকের জীবনও ছিলো আলোকময়। আমাদের ঐতিহাসিক বাঁকবদলগুলোকে এমনভাবে তিনি ‘অবিস্মৃতি স্মৃতি’তে তুলে ধরেছেন যা আগামীর ইতিহাস বিনির্মাণে কাজে আসবে নিঃসন্দেহে। একটা উদাহরণ দিলে তাঁর দৃষ্টির গভীরতা অনুমান করা যাবে সহজেই। ‘সমগ্র উত্তরবঙ্গ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর দিনাজপুরে তখন তেভাগা কৃষক আন্দোলন চলছিল। পাকিস্তান সরকার তেভাগার কৃষক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কঠোরভাবে দমন করেছিল। দলে দলে কৃষক, কর্মী ও নেতাদের পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে ঢোকাচ্ছিল। জেলের ভেতর আমি তেভাগা আন্দোলনের বহু বন্দীর দেখা পেয়েছিলাম। আমি তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। বিভিন্ন আদিবাসী-সাঁওতাল, গারো, হাজংদের সাথেও কথা হতো। তবে পলিয়াদের সাথে মিশেছিলাম সবচেয়ে বেশি। আমার দেখা মানুষদের মধ্যে এরাই সেরা মানুষ। এদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে কথাবার্তা বলে আমার মনে হয়েছে, এরা সত্যি সত্যিই মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষ।’ এইযে সারল্যভরা উক্তি ঠিক এমনভাবে কয়জন বলতে পারেন সেটা। সাংবাদিকতা, রাজনীতি, শিক্ষকতা আর লেখালেখি জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই সবই বিবৃত করেছেন তিনি সহজ-সাবলীল গদ্যভাষ্যে। সমৃদ্ধ জীবন কথার আখ্যান বিবৃত হয়েছে, তাও সেটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। আকার বা আঙ্গিকে হয়তো বৃহদায়তন হয়নি গ্রন্থটি কিন্তু ইতিহাসের আকর বিবেচনায় তার ওজন অনেক বেশি। ইত্যাদিগ্রন্থ প্রকাশ এই আত্মস্মৃতিটি প্রকাশ করে পালন করেছে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। যার মাধ্যমে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে এক সম্ভাবনার দ্বার। . নোনাজলে ডুবসাঁতার সব জলেই সাঁতার কাটা যায়। ডুবসাঁতারও দেওয়া যায় নদী কিংবা সমুদ্রে। কিন্তু জীবনকথা লিখতে গিয়ে হরিশংকর জলদাস যে নোনাজলে ডুবসাঁতারের কথা বললেন সেটা যে লবণাক্ত জলে অবগাহনের কথা নয় তা বুঝতে পুরো গ্রন্থপাঠের প্রয়োজন নেই। তাঁর ফেলে আসা দিনগুলো যে মধুময় ছিলো না সেই আভাস দিতেই শিরোনামে কঠিন অতিক্রমের কথা তুলে ধরলেন তিনি। তবে, একথা অকপটেই বলতে পারি জীবন নদী সাঁতরে তিনি যে সাহিত্যের মহাসমুদ্রে পৌঁছেছেন এবং তা তাঁকে যে উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেকের কাছে সেটা ঈর্ষণীয়! সমকালে এমন জীবনমুখি সমৃদ্ধ কথাকারকে পেয়ে যেমন ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর হচ্ছে আমাদের কথাসাহিত্য, তেমনই আমাদের চিন্তার আকাশও হচ্ছে সম্প্রসারিত। যা আমাদের নতুন করে ভাবাতে সাহায্য করছে। আত্মজৈবনিকতার আখ্যানে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন সকল কথাশিল্পীকে! জীবনের এমনসব অন্ধকারাচ্ছন্ন দিককে তিনি সার্বজীন করেছেন যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও ডুবসাঁতার দিয়েছেন তিনি! লালন, নজরুলের সঙ্গেই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন হরিশংকর! সেটা জাতপাত নিয়ে। জাত নিয়ে লিখতে গিয়ে লালন বলেছিলেন, জাত গেলো জাত গেলো বলে, একি আজব কারখানা’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরেকটু অগ্রসর হয়ে লিখেছিলেন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’ আর হরিশংকর দেখালেন নিম্নবর্গের প্রতি নির্মমতা! উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও তিনি যে সবলের তাচ্ছিল্য ভরা তিরস্কার সহ্য করেছেন পদে পদে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা অমানবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতো তারই বিস্তৃত বিবরণ উঠে এসেছে তাঁর জীবনকথায়। ভাবা যায়, আধুনিকতার এই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন অধ্যক্ষ একজন অধ্যাপককে বলছেন, ‘জাইল্যার পুত’ এবং সেটা তাঁর অবর্তমানে অনেক সহকর্মীর সামনে। ভাবা যায়, জেলে সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি কেউ? তখন আপনাআপনি তোলপাড় করে মনন বিশ্ব। তাঁর বেদনাবহ অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, কলেজ শিক্ষকতা শুরুর কালেও তাঁকে জীবনের প্রয়োজনে মাছ ধরতে যেতে হয়েছে সমুদ্রে। এবং সেই অতীতকে কখনো বিস্মৃত হতে চাননা হরিশংকর-এখনেই তিনি সবার থেকে আলাদা, অনন্য। হরিশংকর জলদাস জীবনের যে নদীটি সাঁতরে আজ পৌঁছেছেন স্বচ্ছ জলধারায় সেই নদীটি সত্যিই ছিলো নোনাজলে টুইটম্বুর! যা তাঁর জীবনের জন্যও ছিলো বিপজ্জনক। মহাসমুদ্র সাঁতরে পার হওয়ার মতোই তিনি সাঁতার কেটেছেন, চোখ বন্ধ করে দিয়েছের ডুবসাঁতার! দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে আজ জয়ের বন্দরে পৌঁছেছেন তিনি। আমরাও দিচ্ছি বাহবা। অকপটে সত্য বলার সাহসই একজন হরিশংকর জলদাসকে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। নিজের দুঃখবোধকে সার্বজনীন করতে গিয়ে সেই যে কলম ধরেছিলেন আর থমকে দাঁড়াতে হয়নি তাঁকে। যে বয়সে মানুষ বিভোর থাকে অবসরের স্বপ্নে, সেই বয়সে তিনি হাতে তুলে নিলেন কলম। জানান দিতে শুরু করলেন একজন প্রান্তবর্তী মানুষের আত্মদহনের গল্প। নির্যাতিত ও উপেক্ষিত হওয়ার করুণ কথা। যা আমাদের জীবনী সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পালন করছে অনুঘটকের ভূমিকা। গ্রন্থের ৮৭ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করতে চাই, তাহলে কিছুটা হলেও অনুমিত হবে, তাঁর দহন যাতনার আখ্যান,‘ কত ছোট ছোট বেদনা বুকে চেপে আমাদের যে দিনযাপন! উঠতে চেয়েছি, পেছনে হেঁচকা টান পড়েছে; জাগতে চেয়েছি, কানের কাছে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে উঠেছে বর্ণবাদী মানুষেরা- আয় ঘুম আয়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি, পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। গাছের ডালে ফুল দেখে মই বেয়ে উঠে ওই ফুলকে ছুঁতে গেছি, পেছন থেকে মইটা সরিয়ে নিয়েছে।’ এভাবে কত কত বেদনার কথা বলে গেছেন তিনি অকপটে, তা বলে শেষ করা যাবেনা। তবে ফ্ল্যাপে লেখা কয়েকটি শব্দ তুলে ধরলে সহজেই অনুমান করা যাবে গ্রন্থসীমা। ‘বইটি শুধু জীবনাখ্যান নয়, এতে আছে উপন্যাসের মতো আকর্ষণ, আছে সমাজ-ইতিহাস এবং সময়।’ যা পাঠকদের দাঁড় করায় জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। সত্যিই তাই। তার এই জীবনস্মৃতি আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট করে রাখে। গ্রন্থটি প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশ সত্যিই পালন করেছে অনন্য এক দায়িত্ব। ঝকঝকে ছাপা, সুন্দর প্রচ্ছদ ছড়িয়েছে নান্দনিকতার বিভা। . স্বপ্নেরা জেগে থাকে! প্রখ্যাতত্রয়ীর আত্মস্মৃতির আখ্যান পর্যালোচনা শেষে একটি কথাই বলতে চাই, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এই তিনজন লেখকই পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মহান ব্রত নিয়ে অতিক্রান্ত করেছেন চলার পথ, সেটাই অনুমিত হয়েছে তাদের জীবনী পাঠে। এই তিন লেখকের জীবন আখ্যান পৃথক হলেও একটা জায়গায় ভীষণ মিল রয়েছে তাদের। সেটা শিক্ষকতা। এই তিনজনই শিক্ষা পরিবারের সদস্য ছিলেন। জীবনের প্রথমভাগে যেমন মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা তেমনই একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের মানসে তুলে নিয়েছিলেন কলম। সময়ের প্রয়োজনেই তারা অবতীর্ণ হয়েছেন লেখকের ভূমিকায়। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম চালিয়ে তারা পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন সুন্দরের। শিক্ষকতাই তাদেরকে মহান করেছে, করেছে কল্যাণব্রতী। জীবন থেমে যাবে, থেমে যায়। অমরত্বের তিলক পরে কেউ আসেনা পৃথিবীতে। তেমনই থেমে গেছে দ্বিজেন শর্মা ও শওকত আলীর গতিপথ। সচল রয়েছেন হরিশংকর জলদাস। কিন্তুু প্রয়াণের মধ্যে যে থেমে যায়নি দ্বিজেন শর্মা কিংবা শওকত আলীর স্বপ্ন সেটা বলতে পারি নির্দ্বিধায়। সেই কথাই বলার চেষ্টা করেছেন হাসান আজিজুল হক। দ্বিজেন শর্মার কথা বলতে গিয়ে জ্ঞানতাপসদের প্রজ্বলিত আলোক যে নিভে যায় না কখনো সেটাই যেন তুলে ধরলেন তিনি। প্রকৃতিপুত্রের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বেশিরভাগ পিপাসার অন্ত মেলে, কেবল জ্ঞানপিপাসারই অন্ত মেলে না। কিন্তু আমরা কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে, যা পেয়েছি তাতেই আমাদের প্রত্যাশার ঘট পূর্ণ হয়েছে। দ্বিজেনদার হাতের প্রজ্বলন্ত মশালটি নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাবে পরের প্রজন্মের তরুণরা। ওই মশাল হাতে নেওয়ার সাধ্য আমার নেই’ তাঁর কথায় সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আগামীর প্রজন্মইতো প্রবহমান রাখবে সেই মশাল, তাহলেই স্বার্থকতা পাবে দ্বিজেন শর্মা, শওকত আলী, হরিশংকর জলদাসের স্বপ্ন।
×