ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নূরুল ইসলাম খান

আমার অনুজ কবি রফিক আজাদ স্মরণে

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৬ মার্চ ২০১৮

আমার অনুজ কবি রফিক আজাদ স্মরণে

আমার অনুজ কবি রফিক আজাদ বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ কবি। তাঁর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনন্তলোকে চলে যাওয়ার দু’বছর হয়ে গেল। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ রফিক আজাদ লোকান্তরিত হন। অগ্রজ হিসেবে তাঁকে পরম মমতা আর ভালবাসায় স্মরণ করছি। আমরা দেখেছি, একজন ভাল-মন্দের চেতনাসম্পন্ন মানুষের বিকশিত হয়ে ওঠার পেছনে তার পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিপাশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। আমাদের সকলের আদরের ‘জীবন’, পরিবার প্রদত্ত নাম রফিকুল ইসলাম থেকে কবি রফিক আজাদ হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের পারিবারিক ইতিহাস ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কবি রফিক আজাদের কবি-মানস গঠনে এ সবের প্রভাব নিয়ে অত্যন্ত নবিস পর্যায়ের এই সামান্য লেখাটির অবতারণা। আমাদের বাবা সলিম উদ্দিন খান, মা রাবেয়া খাতুন। পিতামহ নঈম উদ্দিন খান। নানা মমতাজ উদ্দিন খান। আমাদের পিতামহ ও মাতামহ উভয়ে তৎকালীন এন্ট্রাস্ট পাস ছিলেন। তাঁরা তাঁদের পুত্র-কন্যার বৈবাহিক সূত্রের আগে থেকেই পুরনো আত্মীয় এবং পরস্পর বন্ধু। দু’জনেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত এবং কংগ্রেস দলের অনুসারী ছিলেন। আমরা বড় হয়ে বাবার হাছে গল্প শুনেছি যে, আমাদের বাড়িতে দুদিকে বারান্দাযুক্ত একটি বৃহৎ ছনের চৌচালা কাছারি ঘর ছিল। সেই কাছারি ঘরে পিতামহ ও মাতামহ উভয়ে নেতাজী ও গান্ধীজীর ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে শরিক হয়ে সুতা কাটার চরকা ও খাদি কাপড় বুননের ব্যবস্থা করেন। নিজ গ্রামের এবং আশপাশের গ্রামের লোকজনকে ব্রিটিশদের তৈরি পণ্য না কিনতে এবং ‘স্বদেশী পণ্য কিনে হও ধন্য’Ñএই আদর্শ অনুসরণ করে নিজেদের হাতে বোনা কাপড় কিনতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এ কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টাঙ্গাইলে আমাদের বাড়িতে আসেন এবং দাদাকে বন্দী করে সঙ্গে নিয়ে আসা অতিরিক্ত ঘোড়ায় তুলে ময়মনসিংহ জেল হাজতে অন্তরীণ করে রাখেন। এ ইতিহাস দাদিমার মুখে বহুবার শুনেছি। জেল থেকে ফিরে এসে দাদা কিছু দিন পর নিখোঁজ হয়ে যান। এরপরের দাদুর কী হলোÑ সে ইতিহাস আজও রহস্যের আবরণে মোড়া। পারিবারিক কবরস্থানে দাদীমার কবরটি এখনো বিদ্যমান, কিন্তু দাদার কবরটি সেখানে কোথাও নেই। আমাদের মায়ের গর্ভে আমরা তিন ভাই, দুই বোন । খুকী বুজি প্রথম, আমি দ্বিতীয়, তৃতীয় বোন রেণু, চতুর্থ ভাই মওলা এবং পঞ্চম ও কনিষ্ঠ সন্তান জীবনÑ পরবর্তী জীবনে কবি রফিক আজাদ। রফিক আজাদের ভেতরে কবি প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে মায়ের মধ্য দিয়ে। তাই রফিককে নিয়ে বলতে গেলে অবধারিতভাবে মায়ের প্রসঙ্গ চলে আসে। সে সময়ের সামাজিক রীতি অনুসারে মার বাংলা পড়ালেখা তেমন হয়নি। বাংলা পড়তে না পারার কারণে মার মনে কষ্ট ছিল। বাবা তাঁকে বাংলা পুঁথি ও বিষাদ সিন্ধু পড়ে শোনাতেন। তিনি গ্রামের অসুস্থ লোকজন, বিশেষ করে বউ-ঝিদের অসুখ-বিসুখে ভেষজ চিকিৎসা করতেন, তিনি ঔষধি গাছ-গাছড়া বেশ ভাল চিনতেন। কোন গাছের কি ঔষুধি গুণ তা তিনি ভালই আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর ভেষজ চিকিৎসায় বেশ কাজ হতো, দেখেছি। আমাদের মার শেষ সন্তান গর্ভে থাকাকালীন পুত্র হলে তার নাম রাখা হবে ‘জীবন’ আর কন্যা জন্ম নিলে ‘লায়লা আর্জুমান্দ’Ñ আমাদের বড় বোন খুকি অসুস্থ অবস্থায় তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে মা-বাবাকে তার এই শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত খুকী বুজিকে মা নিজের বাংলা না পড়তে না পারার দুঃখবাধ থেকে কোলকাতার টোলে রেখে বাংলা পড়ালেখা করিয়েছিলেন। পরে তিনি সংষ্কৃত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন বলে মা-বাবার কাছে শুনেছি। রফিক তার না দেখা বড় বোন এবং তার চেয়ে বয়সে বড় রেণুকে নিয়ে তাঁর ‘কোন খেদ নেই’ আত্মজীবনীমূলক বইয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন এবং বেশ কিছু চমৎকার কবিতা লিখেছেন। ইতোমধ্যে আমার দাদির প্রায় সাতানব্বই-আটানব্বই বছর বয়স হয়ে গেছে। তাঁর অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে আমাদের একমাত্র কাকা- আহম্মদ আলী খান (যিনি পেশায় উকিল ছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন)। আমাদের ভাই মওলার বয়স প্রায় তখন চার বছর। মা কাজের লোকজন নিয়ে অতিথিদের জন্য রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। সবার অগোচরে মওলা বাড়ির ঘাটে বাঁধা ডিঙি নৌকায় উঠতে গিয়ে পানিতে পড়ে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তাই আমার সব কিছুই মনে আছে। আমরা ভাই-বোনেরা শোকাতুর হয়ে পড়ি । ভাইয়ের শোকে তখন আমাদের অন্তঃসত্ত্বা মা প্রচ- অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবাও শোকে নির্বাক। এমন অবস্থায় মওলার মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মাস কয়েকের ব্যবধানে খুকী বুঝিও কী এক দুরারোগ্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের মা-বাবার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা অবর্ণনীয়। শোকাভিভূত আমাদের মা কিছু দিনের মধ্যে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। সদ্যপ্রয়াত খুকী বুজির রেখে যাওয়া নামেই মা-বাবা তাঁদের এই পুত্রটির নাম রাখলেন ‘জীবন কুমার’- আমাদের সকলের জীবন। বাবা তো বেশ কয়েক বছর প্রায় নির্বাক এবং সংসারধর্ম থেকে নিজেকে নির্বাসিত করে রাখেন। সে জন্য মায়ের সহযোগিতায় দাদীমাই তখনো সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহন করতেন। দুই নারীর সুদক্ষ পরিচালনায় সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব- অনটন ছিল না। পরিবারে নারীকর্তৃত্বের চমৎকার সফল দিকটি রফিকের চেতনায় নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায়। এই হলো রফিকের বেড়ে ্ওঠার পারিবারিক ও পারিপাশির্^ক পরিপ্রেক্ষিতের সামান্য কিছু অংশ। এবার রফিকের কবি হয়ে ওঠা নিয়ে কিছু কথা। আমার বয়স এখন সাতাশি বছর। স্মৃতি কিছুটা ধূসর হয়ে আসছে, তবু একেবারে মুছে যায়নি। বাংলা ভাষার প্রতি মার গভীর ভালবাসা ছিল। মাতৃভাষা পড়তে জানতেন না বলে তাঁর মনে খুব কষ্ট ছিল। জীবন যখন বাংলা পাঠ শিখছে তখন থেকেই মা তাকে উৎসাহ দিতেন বাংলা চর্চা করার জন্য। মা চাইতেন তাঁর অতি দুঃখের ধন ‘জীবন’ যেনো বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষা পেয়ে বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখে যেতে পারে। আর সেভাবেই তাকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি রফিকের কাছ থেকে বাংলা ভাষার আস্বাদ নিতেন। রফিক তাঁকে রবী ঠাকুরের কবিতা, গান শোনাতেন। রফিক শিশুকাল থেকেই অনুভব করতে পারতেন মার দু’টি সন্তান হারানোর শোক। রফিকের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়- ‘জীবনেরই আরেক নাম মরণ’... এসব পংক্তিমালায় নিজের জীবনের কথাও পরোক্ষে প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে এ দুঃখের কাহিণীটি তাঁকে ছোটবেলায় শুনতে হয়েছে -বহুবার। রফিকের জন্ম বাংলা ১৩৪৭ সনের ১লা ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার। তার ভলো নাম রাখা হয় রফিকুল ইসলাম খান। পরবর্তী পর্যায়ে ‘রফিক আজাদ’ নামে কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং এ নামেই তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। । মা-বাবার শেষ সন্তান। দুটি প্রিয় সন্তান অকালে হারানোর বেদনা ও শোকে মুহ্যমান মা-বাবার এই অবস্থার মধ্যেই ‘জীবন’ বড় হতে থাকে। রফিক আজাদ চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীতে শিক্ষা গ্রহণকালীন বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, রবী ঠাকুরের কবিতার বই পাঠ করতেন এবং সম্ভবত এ সময় থেকেই তাঁর কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই রফিক সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাকে আমি এবং আমার সহধর্মিণী হামিদা ইসলাম পাঠ্যপুস্তক নিয়মিত পাঠের জন্য কড়া নজরে রাখতাম। কিন্তু খুব সংগোপনে কবিতা লেখার চর্চা চলতো। রফিক আজাদকে প্রাথমিক শিক্ষালাভের জন্য বাড়ির অদূরে সাধুটি মিডল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণশাসন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর করটিয়ার সা’দত আলী কলেজে তাকে মানবিক বিভাগে ভর্তি করা হয় । রফিক সেখানে সাহিত্যচর্চায় ডুবে থাকতেন। পড়ালেখার এই অবস্থা দেখে আমি তাকে আমার চাকুরীস্থল নেত্রকোণায় নিয়ে আসি এবং আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি করে দিই। সেখানেও সাহিত্য অনুরাগী খালেক নেওয়াজের মত প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাহিত্যপ্রেমিদের সাথে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা- আলোচনা ও কবিতা লেখার চর্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ এম.এ. পাশ করেন। ষাটের দশকে তার কাব্যচর্চা নতুন দিকে বাঁক নেয়। কাবুলিওয়ালার কাছে হাতঘড়ি বন্ধক রেখে প্রকাশ করেন ‘স্বাক্ষর’ নামে সাহিত্যের ছোট পত্রিকা। ‘স্যাড জেনারেশন’ নামক কাব্য আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে ওঠেন রফিক আজাদ। এ নিয়ে তার একটা নাতি-দীর্ঘ ইংরেজী ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। মার কাছে তাকে দেখেশুনে রাখার অঙ্গিকার করায় তার এ সমস্ত কাজের খোঁজও আমায় রাখতে হতো বৈকি। যাই হোক তার অনেক ব্যক্তিগত আচার-আচরণ তার কাব্যচর্চার সাথে সম্পর্কিত, যে রকমটি অন্য কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আমি সামান্য আলোকপাত করলাম। প্রাথমিক স্কুল পর্ব থেকে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত প্রচুর বাংলা, ইংরেজী সাহিত্য পাঠ করেছেন, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় আঁকা বিশ্বখ্যাত মাস্টার আর্টিস্টদের চিত্রকলার অনুকৃতি দিয়ে প্রকাশিত বইগুলো তার ব্যক্তিগত সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলো। না খেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বাকি রেখে তিনি এই বইগুলো কিনতেন। একবার সে এরকম কিছু রেফারেন্স বই কিনতে পারেনি বলে মন খারাপ করেছিলো। ঢাকায় ওকে দেখতে এসে কোনভাবে বিষয়টা জানতে পেরে আমি বইগুলো কিনে ওর হলে রেখে এসেছিলাম। পরে আমি জেনেছিলাম, বইগুলো পেয়ে কী ভীষণ খুশি হয়েছিলো আমার বইপাগল ভাইটা। রফিক আজাদ বেশকিছু দিন যাবত অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসাগ্রহণে খুব সজাগ ছিলেন। কিন্তু অমোঘ নিয়তির টানে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬ তারিখ রাতে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হয় আমার সন্তানতুল্য আদরের ছোট ভাইটি। তারপর শুরু হয় তার বেঁচে থাকার মরণপণ যুদ্ধ। আটান্ন দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে দেশের অন্যতম কবি ও মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ ১২ মার্চ, ২০১৬ তারিখ বেলা দুইটার সময় আমার ১৪ বছরের ছোট, আমাদের আদরের জীবন ‘সুতোর ওপারে’র দেশে পাড়ি দেন। রফিকুল ইসলাম থেকে কবি রফিক আজাদ হয়ে ওঠার পেছনে অগ্রজ হিসেবে আমার সামান্যতম চেষ্টার জন্য নিজেকে ধন্য মনে করি, গর্ববোধ করি। কবি রফিক আজাদ দুই বাংলার আধুনিক কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আমি বিশ্বাস করি তাঁর কবিতা ও সাহিত্যকর্ম তাঁকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখবে সারা বিশ্বে। আমি রফিকের শোক বুকে ধারণ করে অপেক্ষায় আছি মা-মাটির কাছে ফিরে যাবার। তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র অভিবাদন।
×