ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বই

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১৬ মার্চ ২০১৮

বই

নজরুলের প্রেম ও বিরহের উপাখ্যান বেলাল বাঙালি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল বিচিত্র। কবির এই বিচিত্র জীবনেই এসেছিলেন বেশ কয়েকজন নারী। কবি প্রধানত ভালবেসেছিলেন নার্গিস, প্রমীলা ও ফজিলাতুন্নেসাকে। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের বাসর রাতেই তিনি পালিয়েছিলেন। পরে ভালবেসে বিয়ে করেন প্রমীলাকে। তিনিই ছিলেন কবির সারাজীবনের সঙ্গী। আর ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তার প্রেম ছিল একতরফা। ফজিলাতুন্নেসা কবির প্রেমে সাড়া দেননি। তবে এই তিন নারীর প্রেরণায় তিনি অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন। আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের এই প্রেম নিয়েই তৌহিদুর রহমানের উপন্যাস ‘অলৌকিক বাঁশি’। বইয়ের ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপন্যাস লেখা খুব কঠিন কাজ। সেখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে চরিত্রকে ইচ্ছেমতো পরিচালিত করা যায় না। ইতিহাসের তথ্য উপাত্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লিখতে হয়।’ তবে উপন্যাসটি পড়ার পরে মনে হয়েছে, লেখক এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির জীবনের বিচিত্র প্রেমের উপন্যাসের প্রথম পর্বেই উঠে এসেছে নার্গিসের কাহিনী। নার্গিস- এই নামটি কবিই দিয়েছিলেন। কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়ে নজরুলের বাঁশির সুরেই প্রেমে পড়েন নার্গিস। নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হলেও বাসর রাতেই তিনি পালিয়েছিলেন। এটা ছিল কবির জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কবি কখনই আর নার্গিসকে ভুলতে পারেননি। বিয়ের প্রায় পনেরো বছর পরেও নার্গিস কবির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। কবি এটা জানতে পেরে নার্গিসকে একটি চিঠি লিখেন। নার্গিসকে লেখা সেই চিঠিতে তিনি তাকে ভুলে যেতে বলেন। পরে নার্গিসকে বিয়ে করেন কবি আজিজুল হক। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছে প্রমীলার কাহিনী। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে কবি আশ্রয় নিয়েছিলেন কুমিল্লার বীরজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে। আর সেই বাড়ির মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তের প্রেমে পড়ে নজরুল। পরে প্রমীলাকেই বিয়ে করেন তিনি। তবে প্রমীলাকে বিয়ে করা সহজ ছিল না। কেননা দু’জন ছিলেন দুই ধর্মের। সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এই বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়। প্রমীলার মা গিরিবালা দেবীই এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন কবি নজরুল। সেবার ঢাকায় এসে উঠেছিলেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বাসায়। সে সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার। কবি প্রেমে পড়েন এই ছাত্রীর। তবে ফজিলাতুন্নেসা কবির এই প্রেমে সাড়া দেননি। তাই এটি ছিল নজরুলের ব্যর্থ প্রেম। ‘অলৌকিক বাঁশি’ বিদ্রোহী কবির প্রেমের উপন্যাস হলেও শুধু প্রেমের মধ্যেই উপন্যাসের কাহিনী সীমাবদ্ধ থাকেনি। লেখক উপন্যাসটির কাহিনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে কবি নজরুলের বেশ কয়েকটি চিঠিও উপন্যাসে দেয়া তুলে ধরেছেন। একইভাবে নজরুল গ্রেফতার হওয়ার পরে আদালতে যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন, তারও বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। সেই সময়ের কয়েক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক নজরুলকে তীব্র ভাষায় যেভাবে কটাক্ষ করেছিলেন, সেটাও এই উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন। সে কারণে বইটিতে শুধুমাত্র যে কবির প্রেমের উপাখ্যান উঠে এসেছে, তা নয়। এর বাইরেও কবির জীবনের বিভিন্ন বিষয় এসেছে। উপন্যাসটি লিখতে লেখক অনেক পরিশ্রম ও গবেষণা করেছেন সেটা সহজেই বোঝা যায়। তিনি খুব সহজ ভাষায় উপন্যাসটি লিখেছেন। উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে পাঠকদের বিদ্রোহী কবির বিষয়ে আরও জানতে ও বুঝতে সহজ হবে বলে প্রত্যাশা করছি। অলৌকিক বাঁশি লেখক : তৌহিদুর রহমান প্রকাশনী : বেহুলাবাংলা মূল্য : ২০০ টাকা . হারিয়ে ফেলেছি করোটি এ কে এম আব্দুল্লাহ রচিত ‘যে শহরে হারিয়ে ফেলেছি করোটি’ কাব্যগ্রন্থটি বইমেলা উপলক্ষে বাসিয়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির বিশেষত্ব হচ্ছে বাংলা এবং ইংরেজী দুভাবেই কবি কাব্যগ্রন্থটিতে কবিতা সন্নিবেশিত করেছেন। কবিতায় যেমন ব্যক্তিক আবেগ, সামাজিক অসঙ্গতি, সামাজিক দায়িত্ববোধ, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের মিশেলে ব্যক্তিক দায়িত্ববোধের সচিত্র প্রতিবেদনের চিত্র ফুটে উঠেছে আবার কাব্যগ্রন্থটি কাব্যিক সৌন্দর্যের নামান্তর। একটি কবিতায় কবি দেখিয়েছেন; কিভাবে ব্যক্তিক চিন্তনের জায়গা থেকে আমরা কতটা দূরে সরে গিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছি এবং এর ফলে হারাচ্ছি ব্যক্তিক সক্ষমতা ও আবেগশ্রুত অর্জন। পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিসত্তা আধুনিকতার জৌলুসে। কবি তাঁর কাব্যময় বয়ানে তুলে ধরেছেন সামাজিক বাস্তবতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যর্থতার বয়ান। তিনি বলেছেন ‘আমাদের সম্পর্কের কথা যেদিন ফাঁস হলো, জঙ্গী আক্রান্ত এলাকার মানুষের মতো তুমি আতঙ্কিত হলে।’ সে সূত্র ধরেই বাংলাদেশ যে এখনও জঙ্গী আক্রমণে হতাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সে বিষয়টি কিন্তুই প্রকারান্তারে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি রাতের শহুরে চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, ছিন্নমূল মানুষদের আশ্রয়ের অভাব কবিকে মারাত্মকভাবে বেদনাগ্রস্ত করে তোলে। কবি ধিক্কার জানান তাদের প্রতি যারা সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করে রাস্তার মানুষদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজেদের মনোবাসনা পূরণ করে থাকে। বইটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে কবির কাব্যরস, কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে জটিল বিষয়কে সহজভাবে ফুটিয়ে তোলার শৌখিনতা কবিকে অন্যদের চেয়ে সহজেই আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে। কাব্যসুধা, কবিতাপিপাসু পাঠকরা সহজেই কাব্যগ্রন্থটিতে কবির বিশেষত্বকে চিহ্নিত করে কবিতার মানের বিচার বিশ্লেষণ করতে পারবে। মনে হয় কবিতাগ্রন্থটি কাব্যপিপাসুদের মনের খোরাক মেটাতে সক্ষম হবে। মোহাম্মদ কুদ্দুস তারান্নুম নাজনীন বেগম ‘তারান্নুম’ গল্পগ্রন্থটি অনেকটাই আত্মকথনমূলক। ২০১৮ সালে ভাষার মাসে প্রকাশ হওয়া বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শতাব্দী জাহিদ। প্রকাশকের দায়িত্বে ছিলেন শফিক হাসান। গল্পকার জীবনের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া স্মৃতিময় পর্বগুলোকে শৈল্পিক মাত্রায় যেভাবে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন তা যেমন অভিনব পাশাপাশি সৃজন শক্তির অনবদ্য প্রকাশও। ৮টি ছোট গল্পের চমৎকার সমন্বয়ে গ্রন্থটির যে নির্মাণশৈলী তা গল্পকারের নান্দনিক অনুভবের এক অনবদ্য উপস্থাপন। ‘তারান্নুম’ গল্প দিয়ে শুরু গ্রন্থটি লেখকের বিদেশ ভ্রমণের এক পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিক অভিব্যক্তির নির্মল কথামালা। চার সন্তানের জননী তারান্নুম ছেলেমেয়েদের টানেই অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যান। বড় ছেলে ও মেয়ে দু’জনই থাকে অস্ট্র্রেলিয়ায়। গল্পের কাহিনী যেখানে গতিময়তা লাভ করে সেখান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না ব্যক্তিক অনুভব-অনুভূতি আর আনন্দ-বেদনায় সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের নির্দেশনা। ‘চোর’ গল্পটি চমকপ্রদ, মজাদার এবং অভিনব। এখন তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ব্যক্তিক যোগাযোগের যে অভূতপূর্ব উত্তরণ তা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে বাস্তব প্রেক্ষাপটেরও। মাত্র চার পৃষ্ঠার এ ক্ষুদ্র গল্পটিতে ফেলে আসা দিনের একটি বই চুরিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। গ্রন্থ চুরি আসলে কোন গর্হিত কাজ নয়। বরং পাঠাভ্যাসের অন্যতম একটি অনুষঙ্গও বলা যেতে পারে। এখানেও গল্পের রূপকার নিজের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাকে কাহিনীর আবরণে সাজিয়ে পাঠক সমাজকে উপহার দিতে চেয়েছেন, যা শুধু জীবন গাঁথাই নয় সৃষ্টিশীল অনুভবের এক অনুপম সম্পদও। ‘প্রতিদান’ গল্পে ছেলের সঙ্গে পরের বউয়ের পরকীয়ায় আহত মায়ের করুণ আর্তি। অতি অল্প বয়সে বিধবা হওয়া তসিরন মাত্র ৬ বছরের ছেলে জামসেদকে নিয়ে শ্বশুরের পূর্ব পুরুষের ভিটায় বসবাস করে আসছে। কৈশোর থেকে সদ্য যৌবনে পা দেয়া জামসেদ ২০ বছর বয়সে পাশের বাড়ির আর একজনের বউকে নিয়ে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় মা ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এই ধরনের সামাজিক অপরাধ জীবন চলার নিত্য সঙ্গী। এভাবে ‘তারান্নুম’ গল্প সংগ্রহের প্রতিটি গল্পে যে জীবন বোধের বাস্তব আখ্যান আছে একই সঙ্গে সামাজিক বিধি ব্যবস্থারও স্পষ্ট চালচিত্র নির্মিত হয়। কোন সৃজনশীল মানুষই জীবন ও সমাজ নিরপেক্ষ হতে পারে না। একটি বিশেষ বোধে সমাজ জীবনকে চালিত করতে গিয়ে আপন ব্যক্তিক অনুভূতি যেমন পাঠককে নাড়া দেয় তেমনি চেতনার নির্ধারক হিসেবে সামাজিক অবয়বও সৃজনশীলতায় ভর করে। দীলতাজ রহমানের প্রতিটি গল্পে তারই অনুরূপ। নিজের বয়ানে সুখ-দুঃখের বিচিত্র আঙ্গিনাকে সাজাতে গিয়ে আত্মকথনের মতো অভিব্যক্তি যেমন প্রত্যক্ষ হয় একইভাবে গল্পকারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নান্দনিক চৈতন্যও পাঠক সমাজকে মুগ্ধ করে। পাঠক মহলে গ্রন্থটি আদৃত হবে এ আশায় তারান্নুমের বহুল প্রচার কামনা করছি। শফিক হাসান প্রচ্ছদ-শতাব্দী জাহিদ মূল্য-২০০ টাকা
×