আংটি টি ছিল তার স্তনের ভাঁজে।
আসলে সে রাখতে চেয়েছিল
বাঁ বুকের নিচে;
ওটাই ওর শ্রেষ্ঠ জায়গা।
ভালবাসার ভেলভেট মোড়া রত্নটি
তার অনামিকা আলো করেছিল
যখন সে দুরন্ত কিশোরী,
সম্পন্ন গৃহস্থ শিক্ষক বাবার কন্যা
চপল চঞ্চল; সমাপ্তির
মৃন্ময়ী যেন।
তখনও সে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেনি
অথবা ধরলেও মন তার ভাঙেনি
কৈশরের আড়।
দক্ষিণ বাগানে শিমুল আর নারকেল গাছের জোড়ে
ঘর বাঁধা
শালিকে তার মনোযোগ;
সন্তর্পণে একবার উঁকি মারা প্রতিদিন।
ঝুল বারান্দায় নুয়ে পড়া কুলের ডালে
তিতকুটে স্বাদ কুল আর তেঁতুলে মাখা মাদারের ফুল,
নীলিদের ক্ষেতে কচি ধনেপাতা
এক গোছা; লবণে চটকে
ফেটে পড়া উল্লাস
নীলিমাও তার
অমৃত স্বাদে মগ্ন দুপুর।
আকন্দ পাতার ডালে সৈনিকের মতো সার বেঁধে চলা
গুবরে পোকার দলছুট
রোগা ছানাটিকে,
নিয়ে করতলে
দু’হাতের ওমে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ প্রয়াস।
ফুফুরা নাইওর এলে অঘ্রাণে-
মেঝেতে বিছিয়ে শতরঞ্জ
হ্যাজাকের আলোয় কেচ্ছা আর পুঁথি পাঠ;
আইয়াজ বয়াতীর ভরা গলার টানে
মায়েদের চোখ টলমল,
তাই দেখে ফুফুরাও মোছে চোখ
কিশোরী খোঁজে ফ্রকের ঝালর কিংবা শাড়ির আঁচল।
রাতে ঘুমানোর আগে
ভক্তিভাবে নত মা শোনায়-
বায়েজীদ বোস্তামী, শেখ ফরিদ আর
ডাকাতের আউলিয়া কাহন।
বহুবার শোনা তবু শিহরণ-
সহস্র খুনী ডাকাত,
সততার খুনে
শেষবার রাঙালে হাত
মরা গাছে ফোটে ফুল,
শীষ দেয় দোয়েল
নিজাম ডাকাত হয়ে যায়
আউলিয়া।
কোনোদিন স্বপ্নে আসে মদন কুমার
পবনের নায়ে;
প্রাসাদ চূড়ায় মধুমালা, গজমতি হার গলায়
হাত রাখে রাজপুত্রের হাতে।
আংটি বদল শেষে খুলে দেয় মনের দুয়ার
দু’জন দু’জনার।
শেষ রাতে পরীদের কারসাজি-
উধাও রাজকুমার,
আংটিটি তার রয়ে যায়
কন্যার সোনার কনিষ্ঠায়।
এমনই একদিনে ফাল্গুনের ভর সন্ধ্যায়
ঘটক হাজির পুবের কাছারি ঘরে।
শিক্ষক বাবা শোনেন পাত্রের বৃত্তান্ত
শোনান সদ্য কলেজ পেরনো জ্যেষ্ঠ পুত্রকে।
বেঁকে বসে জ্যেষ্ঠ-
‘কিছুতেই দেব না বিয়ে
পড়বে ও আরও তারপর দেখা যাবে।’
লাল সাদা ডিমলা সুতোয় গাঁথা
প্রিয় দিস্তার খাতা আর
মলাটে মোড়া পাঠ্যবই ফেলে ছুটে আসে মেয়ে
-কার বিয়ে দাদা?
-কারো না, তুই পড় গিয়ে, রবিবার
ক্লাব ঘরে ‘ডাকঘর’
অমলের ডায়লগ ভুলবি না।
-ভুলি নি তো! শুনবি? দই আছে...
‘চুপ করো।’ বাবার বজ্রকণ্ঠে
চাপা পড়ে কিশোরীর স্বর,
‘আশ্বিনে বিয়ে তোমার, এখন যাও।’
ভাইবোন অসহায় প্রজা
সামন্ত পিতার রক্তচোখ চাবুকের নিচে।
সহসা বটবৃক্ষ বড় ভাই;
আঁকড়ে ধরে দু’বাহু বোনের
টগবগে রক্তের তোড়ে উঁচিয়ে মাথা
ডিঙায় সাহসের সীমা-
‘পড়াবো ওকে আমি, আপনি চান বা না চান।
বৃক্ষের মতো মাথা তুলবে
উজিয়ে আকাশ, শেকড় ছড়াবে
মাটির গভীরে-
নিওলেথিক তারপর পেলিওলেথিক প্রাগৈতিহাসিকে।
কোনো ঝড় ওকে টলাবে না,
হবে না লবঙ্গ লতিকা।’
‘কী! এত সাহস!‘ মুহূর্তে অগ্নিকু-ু পিতা,
‘কলেজ পেরিয়েই বুলি কপচানো!
আমাকে জ্ঞান দান?
বেয়াদব নাদান, দূর হও
নইলে বার করে দেব বাড়ি থেকে।’
‘সেই ভাল’-তরুণ রক্তে এবার
মেশে অশ্রুর প্লাবন
॥ দুই ॥
বাতাসে উড়িয়ে ধুলো কেঁপে ওঠে চৈত্রের দুপুর;
একটা কি দুটো ঘুঘু ডেকে যায় জামিরের ডালে-
কাঠ ঠোকরার টানা ঠকঠক
বাড়ালে বিষণ্ণতা
ভাইবোন মুখোমুখি;
বারান্দার রেলিংয়ে ঠেকিয়ে মাথা
ফাঁকা দৃষ্টিতে শূন্যতা মাপে ভাই-
হাটসেপসুট, সেই প্রাচীন মিসরে
করেছে রাজ্য শাসন
সম্রাটের পোশাকের তলায় লুকিয়ে
নারীর শরীর, শ্মশ্রুমন্ডিত নকল সাজে।
প্রজা-প্রণাম পেয়েছে যুগ যুগ ধরে
ভক্তি ও ভালবাসায়
যতদিন বেঁচে ছিল সম্রাট হাটসেপসুট।
ও কেন হবে না তেমন...
কেন যাবে অন্য বাড়ি
ছেড়ে বই খাতা, নিজ বাড়ি?
এক ঠায় বসে থাকে নবীন যুবক
ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ যেন
বোধিবৃক্ষ তলে।
হৃদয় তোলপাড় ভাবনা নিয়ে মাথায়
কিংকর্তব্যবিমূঢ়; শক্তিহীন
নিজেরই পায়ের তলায় বাবার জমিন।
‘দাদা, সত্যিই কি...’
ধ্যান ভাঙে কিশোরীর ব্যাকুল স্বরে।
অক্ষম দুটি হাত জড়িয়ে বোনের হাতে
নির্বাক, নতমুখ-
কিশোরী টের পায় দু’ফোটা উষ্ণ নোনা জল।
হাতের তালুতে তার।
দুপুরের প্রকট খড়ায় হঠাৎ কি যেন খেলে যায় রক্তের ভেতর।
বয়ে যায় শিরায় শিরায়;
দহন আর দৃঢ়তার স্রোত ধমনী বেয়ে
পৌঁছে যায় জরায়ুতে তার
ভবিষ্যত, দূরগত ভ্রুণের অপেক্ষায়।
॥ তিন ॥
সত্যিই একদিন বৈঠকখানায় ঝাড়পোঁছ,
বাবার আরাম কেদারায় লাগে দর্জির হাত।
ফুলকারি নকশার টেবিল ক্লথ আর
চেয়ারের ব্যাক; ‘দেখিলে মায়ের মুখ
জুড়ায় সব দুঃখ- মার হাতে করা ফ্রেম বাঁধা
সেলাইয়ের কাজ আর
পিতামহের ঘোলাটে ফটোগ্রাফে দোলে
তাজা বকুলের মালা।
সদরের ফুলবাগানে নিড়ানী ও কাঁচির
যৌথ অভিযান,
বুনো ঘাসলতার উদ্ধত গ্রীবা ছেঁটে,
ভেঙ্গে দিয়ে মরা ক্যাকটসের ডাল
শিউলির শুকনো পাতা ঝেড়ে
সবুজে সাদায় মায়াময় জুঁই,
গোলাপ বেলি, দোপাটি কি হলো
মনোহর আরও?
তদারক করেন বাবা নিজে।
মা ব্যস্ত পিঠার শতব্যঞ্জন নিয়ে
ঝন ঝন রিনঠিন সুর ওঠে রান্নাঘরে।
আশ্বিনের আগেই আসে তারা
পাত্র ও তার পরিবার।
ফুফুরাও আসে-
একমাত্র ভাইয়ের মেয়ে, একা হাতে মার
সব সামলানো দায়।
ফুফু বের করে লাল জামদানি
মা গয়নার বক্স, তিব্বত স্নো
রুজ আর ক্লিওপেট্রা কাজল।
সেনদের মেয়ে নিরুপমা দির
নকশার খ্যাতি গোটা গাঁয়;
আলতায় আঁকে কল্কে ও লতা
কিশোরীর ঝিনুকের মতো পায়।
জবাকুসুমের সুগন্ধি মেখে এলোকেশ করে পরিপাটি
দু’হাতে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরে
মা’র প্রিয় সখী গাঙ্গুলী কাকী।
মেহেদী দেয়া হয়েছে গতকাল।
এরপর অন্দর থেকে সদরে
জড়সড় কিশোরী-
দু’ধারে দুই ফুফু
মুখোমুখি পাত্রের স্বজন।
বৈঠকখানায় তখন পশ্চিমের শিরীষের ডাল
ভেদ করে উপচে পড়া
কনে দেখা আলো
কতিপয় সাবধানী চোখ
সে আলোয় পরখ করে নিয়ে
বলে- ‘কোরান তেলাওয়াত কর মা
খতম দিয়েছ ক’বার?’
‘সুরেলা গলা ওর, পড় মা
ইয়াসিন আল কুরআনুল...’
রেডিও জকির মতো থড়বড়িয়ে
বলে উঠে ফুফু নিজেই ধরেন টান
ইয়াসিন আল কুরআন...
কন্যা ক্ষীণ স্বরে মেলায় ঠোঁট;
আয়াতে মন নেই মোটে কোন মতে
শিখেছে সুরা ইয়াসিন
বৈতরণী হতে পার।
‘মাগো, গান জানো? আবার প্রশ্ন ও তরফে
‘না। জানি কবিতা আর অমলের ডায়লগ’
কিশোরীর গলায় ফিরেছে আত্মবিশ্বাসের জোর।
‘রাঁধতে কি জানো?’ ‘না।’
‘চুল বাঁধতে? নকশী খোঁপা, বাহারি বিনুনী...’
‘তাও না। লিচু চোর জানি, জানি বীর পুরুষ,
ঠাকুমার ঝুলি- বিষাদ-সিন্ধু
ফোরাতের তীরে হায় হোসেন! হায় হোসেন!’
‘থাক থাক মা ঠিক আছে
এবার যাও’ পাত্র পক্ষে স্নেহের প্রশ্রয়।
কিশোরী নিমিষে চৌকাঠপার-
খিড়কীর বাগানে
প্রিয় শিউলি তলায় গজিয়েছে
টাইম ফুলের গোছা;
গতকাল কুঁড়ি দেখেছিল
আজ নিশ্চয় ফুটে গেছে ফুল।
নত মুখে আঁকড়ে ধরে মাটি
বিভোর কিশোরী গোনে এক দুই তিন...
কুঁড়ি আছে আরও।
‘শোন, এটা নাও’ হাতে গুঁজে দিয়ে
কারুকাজ করা রঙিন বটুয়া
পালায় দ্রুত যে, তাকে দেখেছিল বৈঠকখানায়
চোরা চাউনিতে মুগ্ধতা মাখা।
আকাশে আবির ছড়িয়ে সূর্য
তখন অস্তের আয়োজনে
কনে দেখা আলোর শেষ রেশটুকু
ফিকে হতে হতে মিলিয়েছে বহুক্ষণ
কিশোরী বিহ্বল; দ্রুত দেখে চারপাশ
লুকায় ব্লাউজের ভাঁজে।
হাতে লেগে থাকা স্পর্শের রেশ
বিদ্যুত ঝলক তোলে তরঙ্গ বিভায়।
এই তবে পুরুষ!
আবারো তরঙ্গ খেলে বাঁ দিকের বুকে,
যেখানে রয়েছে বটুয়া সঙ্গোপনে।
বাবা নয় দাদা নয় অন্য এক ছোঁয়া
যেন বেলায়েত খাঁর সেতারের তান
শতমুখে ছলকে ওঠা।
পানচিনি শেষে গমনোদ্যত পাত্রপক্ষ-
গুটি গুটি পায়ে কিশোরী দাঁড়ায়
ঝুল বারান্দার পশ্চিম কোনে
আঁচলে চেপে বুক;
কোন এক ব্যাকুলতায়
থির হয় সন্ধ্যার আকাশ।
মিলিয়ে হাত দু’পক্ষ, বিদায় পর্ব শেষে
লেবুতলা দিয়ে যেতে যেতে দলছুট হয় একজন,
দৃষ্টি তার ইতিউতি ঘুরে আটকায়
ঝুল বারান্দার পশ্চিম দিকের কোনে।
সন্ধার অন্ধকারে আবছা অবয়ব এক
তির তির কাঁপে; পথিক
পেরিয়ে দূরত্ব দ্রুত পায়
মিশে যায় বাকিদের ভিড়ে।
॥ চার ॥
বুকের মধ্যে সোনালি কারুকাজ
তোলপাড় তোলে তারাভরা রাত।
নক্ষত্ররা ভুলেছে ছায়াপথ; নীল অপরাজিতা
কিশোরী আজ
হৃদয় তার রহস্যের বুনো ঘাস।
কাঁপা হাতে স্পর্শ বার বার
বুকের বকুল তলায়, নড়ে ওঠে দুলে ওঠে
সোনালি কারুকাজ।
ঝিঁঝিঁদের ডাক মিইয়ে গেলে
গম্ভীর হয় রাতের আঁধার
বাঁশঝাড়ে প্যাঁচাদের সংসারে খুনসুটি;
মা গুটিয়ে দিনের সব কাজ
ধ্যানমগ্ন জায়নামাজে
তসবিহ হাতে মুদিত নয়ন।
এই বুঝি সুবর্ণ সময়-
চিমনিতে কাগজ চাপা
তার পরও হ্যারিকেন বাতি
কমিয়ে দিয়ে আরও
উন্মোচিত করে গুপ্তধন।
‘কিরে ওটা?’ ধরা পড়ে হাতেনাতে
‘কিছু না তো!’ লজ্জায় রাঙা মুখ অবনত
ভীরু দৃষ্টিতে অপরাধ মাখা; ভাই বোঝে কিছু,
তারও মুখ আলোকিত
ফাগুনের সেই সন্ধ্যার পর এই প্রথম।
টুক টুকে লাল চুনী, এক ধার সরু
স্বর্ণলতা জড়িয়ে আছে, দুদিকে হীরার পাতা
দুটো, দ্যুতিময়- রত্নর চেয়ে বেশি
প্রণয়ের গন্ধমাখা গভীর।
-কি হলো রে পর! সস্নেহ, বন্ধু বড় ভাই
- না, দেখে ফেলে কেউ যদি!
- তাতে কি, ওই তো বর হবে তোর ক্ষতি কি।
সেই থেকে আংটিময় কিশোরীর ভূবন
ভালবাসার আশ্চর্য পিরামিড
অক্ষয় অবিনশ্বর; শোভা পায় অনামিকায়। (অসমাপ্ত)
শীর্ষ সংবাদ: