ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ১৬ মার্চ ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) (পর্ব- ৮) ছিয়াত্তর এ এসে জীবনের গতি প্রকৃতি ভিন্নতর হয়ে গেল।এটাই স্বাভাবিক। প্রথম ছিলাম একা, ব্যাচেলর। তারুণ্যের ধর্ম যেমন উদ্দাম গতিতে জীবন এগিয়ে চলত সামনের দিকে। বিয়ের পর স্বভাবতই জীবন একটু ভিন্নতা পেয়েছিল তবে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি তখনও জীবনে। একসাথে নাটকের কাজ করতাম আমি এবং সারা। প্রতিদিন সন্ধ্যেগুলো একসাথে কাটতো। অতএব দুজনের কাছে দুজন নিতান্তই পরিচিত বন্ধু ছিলাম কিন্তু সন্তানের জন্মের পর জীবনে এমন কতগুলো পরিবর্তন এলো যা আগে কখনও ভেবে দেখিনি। তবে এই কথাগুলোয় আসবার আগে আমার মনে হয় পাঠকদের স্বার্থে সেই ব্যাচেলর জীবনের কিছু কিছু কথা-বার্তা বলে নেয়া ভালো। একে তো স্মৃতিগুলো ছিল বড়ই সুেখর তার ওপরে বাধা-বন্ধনহীন নিঃর্ঝঞ্ঝাট জীবন ছিল বর্ণময় এবং চিত্তাকর্ষক । আমি সেই সব কতিপয় সৌভাগ্যবানদের একজন যার একটি চার চাকা যুক্ত বাহন ছিল সেই চব্বিশ বছর বয়স থেকেই। আমি গাড়ি চালাতে বড় ভালবাসতাম। তখন সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ির দাম আয়ত্তের মধ্যে ছিল এবং সর্বোপরি আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম তারা বড়ই সদয় ছিলেন। চাওয়া মাত্র সহজ শর্তে গাড়ি-ঋণ কোন বিষয়ই ছিলনা। আমার অবিবাহিত জীবনে এই চারচক্রযানটির বিশাল এক ভূমিকা ছিল। সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে কিংবা ছুটি-ছাটায় তিন চার জন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়তাম ঢাকার বাইরে। কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না। এমনও হয়েছে গাড়ি চালাতে চালাতে সেই কোন সুদূরের মধুপুর জংগলে পৌঁছে গেছি। পথে ছোট খাটো হোটেলে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়েছে কিন্তু সূর্য ডুবে যাচ্ছে, রাত্রি সমাসন্ন, মাথার ওপরে ছাদ নেই, রাত্রি যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই অতএব পথের ধারে একটা গাছ বেছে নিয়ে তার নিচে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে মনের সুখে আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছি। পরের দিন অতি প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে পাখির ডাকে। রাস্তার ধারের কোন পুকুরে অবগাহন ¯œান সেরে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে ছোট্ট চায়ের দোকানে বনরুটি আর কলা দিয়ে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করার মাধ্যমে। এরপর আবার ছুটে চলেছি অজানা কোন গন্তব্যের পথে। জীবনের এই সময়টিতে বড় মজার সব ঘটনা ঘটেছে। মনে পড়ে একবার আমরা জয়দেবপুরের শ্মশানঘাটে রাত্রিযাপন করেছিলাম চারজন। উদ্দেশ্য ভূত দর্শন। কে যেন বলেছিল ভরা অমাবশ্যায় ওই শ্মশানঘাটটিতে রাত্রিযাপন করলে ভূতের দেখা মিলবেই। আমরা ওখানে পৌঁছে প্রথম একঘন্টা চুপচাপ ঘাটের ওপরে বসে থেকে ভূতের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে আমি পায়ের কাছ থেকে একটি নুড়ি পাথর কুড়িয়ে পুকুরের মাঝে ছুঁড়ে মারলাম। টুপ করে আওয়াজ হলে সবাই সরব হয়ে উঠল। কে যেন একজন বলল ভূত মনে হয় ’বিপন্ন বিস্ময়’ । এই শব্দবন্ধ সম্বন্ধে আমরা অবহিত হয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের মাধ্যমে। মনে পড়ে তার সেই অবিস্মরণীয় কবিতা আট বছর আগের একদিন : ”অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় - আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে ক্লান্ত ক্লান্ত করে;” এইভাবে জীবনানন্দ দাশকে সঙ্গী করে নিয়ে কখন যে অমাবশ্যার প্রগাঢ় অন্ধকারকে ফর্সা করে দিয়েছি সে সম্বন্ধে একদম সচেতন ছিলাম না। ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। নিজেদেরকে আবিষ্কার করি বিভিন্ন সিঁড়িতে শো’য়া অবস্থায়। এই পুকুরটি খুব কমই ব্যবহৃত হত। অতএব এই দিকে মানুষের আনাগোনাও কম ছিল। সেবারে ওই পুকুরের জলে হাত মুখ ধুয়ে জয়দেবপুরের একটি হোটেলে পরোটা-ভাজি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরেছিলাম। আজ পর্যন্ত সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে। আমার যৌবনের এরকম আরও কত জীবনানন্দ দাশের কথা হচ্ছিল। এই রকম বাংলা সাহিত্যের আরও কত দিকপাল যে আমাদেরকে ছায়াবৃত করে রেখেছিল তখন তার পরিমাপ করা বড় কষ্টসাধ্য এই সময়ে। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই। ছায়ানটের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনে আমরা সবাই মোটামুটি রবীন্দ্র উন্মুখ ছিলাম। এইখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে ছায়ানটে আমরা কেন যেতাম। সত্যি কথা বলতে কি, একমাত্র আমাদের বন্ধু মাহমুদুর রহমান বেনু ছাড়া আর কেউ ছায়ানটে গান-বাজনা শিখতে যায়নি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন স্বাধীনচেতা সংস্কৃতিবান বাঙালী হওয়ার যে অদম্য ইচ্ছে আমাদের মধ্যে ছিল সেটাই আমাদেরকে ছায়ানটমুখী করেছিল। ওইখানে অনেক প্রাজ্ঞজনের সান্নিধ্য পেয়েছি। এদের মধ্যে ওয়াহিদুল হক এবং সানজিদা খাতুন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওয়াহিদ ভাই তো বস্তুতপক্ষে আমার গুরুই ছিলেন। ছায়ানটের বাইরেও আমরা তাঁর বাসার বৈঠকখানায় অসংখ্য অলস দিন-রাত্রি কাটিয়েছি। এই সময় অনেক কবি-লেখককে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। একেক সময় রবীন্দ্রনাথের অনেক কথাই নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে। এখন রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে গেলে সেই শিক্ষানবিশীর সময়ে ওয়াহিদুল হকের উপদেশ পরামর্শগুলো নিরন্তর আমাকে সজাগ রাখে। ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছেই শিখেছিলাম যে কবিতা অভিনয় করা যায় এবং এখন নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে জেনেছি যে কিভাবে একটি চরিত্র এবং সেই চরিত্রকে ঘিরে নানাবিধ ঘটনার সাথে একাত্ম হওয়া যায়। এই একাত্ম হতে পারলেই বুঝি অভিনয়ের সত্য রূপ ফুটে ওঠে। আজ জেনেছি যে একেই বলে সৃজনশীলতার সত্য আবিষ্কার। এই রকম অভিজ্ঞতা আমার নিজের জীবনেই হয়েছে। গ্যালেলিও কিংবা নুরলদীনের সারা জীবন নাটকের একটি সংলাপ উচ্চারণ করার সাথে সাথে গায়ে কাঁটা দিয়েছে। বুঝতে পেরেছি সৃষ্টির সত্য স্পর্শ করলো আমায়। আমি নিশ্চিত যে ওই সংলাপে আমি দর্শকেরও হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পেরেছি। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অন্যান্য সম-সাময়িক বাঙালী কবিদের প্রতি আকৃষ্ট হই আমরা। এদের নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হতো। বলা যায় অনেক সময় চা-য়ের পেয়ালায় ঝড় বইয়ে দিতাম। আমাদের প্রিয় কবিরা ছিলেন সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন এবং এদের সবাইকে ছাপিয়ে মধ্য গগনে জ্বলজ্বল করতেন জীবনানন্দ দাশ। প্রসঙ্গত সমর সেনের একটি রসালো উক্তি এই মুহূর্তে মনে এলো। তাকে কোলকাতার কোন একটি পত্রিকার সাহিত্য সমালোচক একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন ” বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কি?” জবাবে সমর সেন বলেছিলেন, ” ভবিষ্যতে ভূতপূর্ব হওয়া।” সমর সেনের এই প্রশ্নোত্তরের আড়ালে কি কোন দুঃখবোধ ছিল? কে জানে হয়তো থাকতেও পারে। এই পরিণত বয়সে এসে আমার মনেও এই প্রশ্নটির উদয় হয় যে আমরা কি কবিতার কথা অহরহ বলি কবিতাকে ভালোবেসেই? নাকি আমরা আসলে এক ধরনের উন্নাসিক আত্মপ্রচারেই বেশি আগ্রহী? অর্থাৎ কবিতাকে ভালোবাসি বললে আমাদের বৈদগ্ধ আরও একটু পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছু কবিতা অবশ্য আছে যাতে আমাদের বিভিন্ন বয়সে আমরা নিজেদেরকে খুঁজে পাই। যেমন, আমার যৌবনকালে রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সত্যিই খুব মনে ধরতো। সেই যে ক্যামেলিয়া কিংবা সাধারন মেয়ে! একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঐ একই কথার ছন্দে লেখা ছেলেটা অথবা শেষ চিঠি অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী মনে হয়েছে আমার। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে হয়তোবা একটা নেড়ী কুকুরের ট্র্যাজেডী রয়েছে। কে বলতে পারে? অথচ এর চেয়ে অনেক ভারি ভারি কবিতা প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হয়েছে সেই বাল্যকাল থেকেই। যার অর্থ তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন সম্যক উপলব্ধি করতে পারি : ”ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠয়েছো বারে বারে”! অথচ এই বয়সে এসে অমন অদৃশ্যের প্রতি আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মন চায় এবং এটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি ঐ ধরনের শিক্ষনীয় সব কাব্যের প্রভাব কোন কাজেই এলো না আমার জীবনে? আরও কিছু কবিতা আছে রবীন্দ্রনাথের যা আঙ্গিক কিংবা প্রতিপাদ্যে হয়েছে কালজয়ী অথচ একেবারেই বোধবুদ্ধি দিয়ে একাত্ম হতে হয় যার সাথে। যেমন : এবার ফিরাও মোরে অথবা মানস সুন্দরী অথচ যেতে নাহি দিব -কে কত বেশি হৃদয় এর কাছের মনে হয়। ঠিক একই রকম একটা নরম ভালোবাসা মনকে দোলা দেয় যখন ”শিশু ভোলানাথ” এর কবিতাগুলো পড়ি : মনে পড়া, খেলাভোলা অথবা অন্য মা আহা! আমার এই লেখাটি কাব্য আলোচনা করবার জন্য নয় কিন্তু কোন বিষয় যখন হৃদয়ের ভেতরে নিরন্তর দোলা দেয় তখন দূরে থাকি কি করে? (চলবে)
×