ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতায় গতি, গতির কবিতা বীরেন মুখার্জী

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ১৬ মার্চ ২০১৮

কবিতায় গতি, গতির কবিতা বীরেন মুখার্জী

সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা ‘কবিতা’, বিশ্বের সকল ভাষার প্রাচীন নিদর্শনও ‘কবিতা’। সঙ্গত কারণে, কবিতা নিয়ে কবিতা স্রষ্টা, পাঠক কিংবা সাধারণ মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। জোর দিয়ে বলা যায়, পৃথিবীতে এমন মানুষ দুর্লভ, যারা জীবদ্দশায় অন্তত একটি পঙ্ক্তিও রচনা করেননি অথবা চেষ্টা করেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে, সত্যিকারের ‘কবিতা’ স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রণোদনা, যা নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে প্রকৃত কবির হাতেই লিখিত হয়। কোন কবিতা পাঠ করতে গিয়ে পাঠক যখন একটি চিন্তার ভেতর স্থির থাকেন কিংবা, একই চিন্তায় আবর্তিত হতে থাকেন, তখন কবিতাটি পাঠকের কাছে ক্লিশে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবী যখন নানাভাবেই এগিয়ে চলেছে; পারস্পরিক চিন্তা, বৈশ্বিক আবিষ্কার, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বস্তুর প্রকরণগত পরিবর্তন, চিন্তার উল্লম্ফন সর্বোপরি যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে মানুষ যখন সর্বাধিক বেগপ্রাপ্ত, তখন কবিতা কেন সনাতনী ধারণার বশবর্তী হয়ে একই চিন্তা-দর্শনে ঘূর্ণ্যমান- এমন প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না। সময়কে ধারণ করে ‘কবিতা’ও গতিশীল হয়ে উঠবে- এ বক্তব্য যৌক্তিক ধরে নিলে কবিতাকে গতিশীল করে তোলার দায়িত্ব কবির কাঁধেই বর্তায়। প্রকৃত কবির হাতেই লিখিত হয় সত্যিকারের কবিতা, সুতরাং কে সেই ‘প্রকৃত কবি’- এমন প্রশ্নও অবান্তর নয়। তিরিশের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বিষয়টি আগেই নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘...সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ জীবনানন্দ দাশের, ‘কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে’- বলতে, তারাই কবি, যারা সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ‘নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে’ এসে এবং ‘তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে’। জীবনানন্দ দাশের অভিজ্ঞানের ভেতর যে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত মেলে, তা প্রকৃত কবি শনাক্ত করতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। আবার বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন মৃত্যুর কিছুদিন আগে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গেও জীবনানন্দের চিন্তার যোগসূত্র আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না বিশ্বের কাছে আমি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছি, কিন্তু আমার কাছে আমার নিজেকে মনে হয় এক ছোট বালক যে কেবল সমুদ্র উপত্যকায় খেলা করছে এবং একটি ক্ষুদ্র নুড়ি বা ক্ষুদ্রতর এবং খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল’ (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। জীবননানন্দ দাশের ‘নানা রকম চরাচরের সম্পর্ক’ এবং নিউটনের ‘সত্যের মহাসমুদ্র তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল’- কথা দুটি সাযুজ্যপূর্ণ এ কারণে যে, জীবনানন্দ দাশ, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নতুন কিছুর সন্ধান, আর নিউটন, তার সামনে অনাবিষ্কৃত সত্য উদ্ঘাটনের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা নতুন (অনাবিষ্কৃতকে আবিষ্কারের অর্থই হলো ‘নতুন’)। এই আবিষ্কারের জন্য কবি কিংবা বিজ্ঞানী, উভয়কেই ছুটতে হবে, গবেষণা করতে হবে। গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞানই ‘নতুন’ রূপে প্রতিভাত হতে পারে। কবিতার সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক সুবিদিত। বিজ্ঞান যেমন গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করে, একজন প্রকৃত কবিও তার কবিতাকে চিত্তাকর্ষক করতে, কবিতাকে নতুন করে তুলতে এমন প্রপঞ্চের সংযোজন ঘটান, যাতে কবিতা নতুনত্বে উত্তরণ ঘটে। এক্ষেত্রে কবির অধ্যয়ন এবং কবি যে অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটান, তাও গবেষণালব্ধ হওয়া জরুরি। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় প্রসঙ্গ কাঠামোর বা পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে যখন কোন বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে তাকে গতিশীল বস্তু এবং এই ঘটনাকে গতি (Motion) বলে। এক্ষেত্রে কবিতার গতি কী- এমন প্রশ্ন উঠে আসা অমূলক নয়। যখন বলা হচ্ছে, বিশ্বজগতের প্রত্যেকটি বস্তুই গতিশীল, তখন মানুষের চিন্তা আক্ষরিক অর্থে অবস্তুগত হলেও, যে কবিতা পাঠে পাঠকমন নতুন চিন্তার ভেতর ক্রমেই প্রবিষ্ট হয়ে গভীর থেকে আরও গভীরতার দিকে ধাবিত হবে, তাকে ‘গতির কবিতা’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বৈকি। বোধের ব্যাপকতা, দর্শন, ভাবাবেগ, রহস্য কিংবা অন্য যে কারণেই হোক, আজও কবিতাকে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। তবে দর্শন, সৌন্দর্যবোধ, আবেগ, রহস্য ইত্যাদি প্রপঞ্চের কারণে কবিতাবোদ্ধারা নানাভাবে কবিতাকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। অভিজ্ঞজনের এরূপ নানাবিধ ব্যাখ্যার পরও সাধারণ পাঠকের কাছে কবিতা নিয়ে ভিন্ন অনুভূতি থাকতে পারে। বোধ করি, আছে। কবিতার একজন সর্বগ্রাসী পাঠক ও কবিতাকর্মী হিসেবে আমার বিশ্বাস, ‘কবিতা হলো এক ধরনের ইশারা।’ কবিতায় এক বা একাধিক ইশারার সন্নিবেশ ঘটাবেন কবি, আর পাঠক নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী গল্প সাজিয়ে নেবেন। প্রকৃত কবি যখন যথাযথ শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, বিজ্ঞান-দর্শন সর্বোপরি অর্জিত অভিজ্ঞতার নির্যাসের রসায়নে কবিতা ‘নির্মাণ’ কিংবা বিনির্মাণ (re-construction) করেন, তখন সেই কবিতা ‘বস্তুস্বরূপ থেকে অতীন্দ্রিয়ের দিকে ধাবিত হয়ে’ অনায়াসে গতিপ্রাপ্ত হতে পারে। ২. ‘মনের অনুভূতিপ্রবণ সুগভীর ভাবাবেগ ও কল্পনাপ্রসূত চিন্তা-চেতনাকে শৈল্পিকরূপে মননশীল এবং কাব্যিক চিত্রকল্প-রূপক-উপমা সংযুক্ত নান্দনিক ভাষার উপস্থাপিত রূপই কবিতা’- কবিতাবিষয়ে এরূপ ভাবনাকে সামনে রেখে কবিতাপাঠে, কবিতাটির আরও গহীনে যাওয়ার প্রবল বাসনা পাঠকমনে সৃষ্টি হওয়া অযৌক্তিক নয়। কবিতাপাঠ অর্থ এক ধরনের শৈল্পিক ভ্রমণ। কেননা, সাহিত্যও পাঠকের সঙ্গে শিল্পিত যোগাযোগের একটি মাধ্যম। শৈল্পিক ভ্রমণে রহস্য খুঁজে না পেলে পাঠক পাঠবিমুখ হতে পারেন। ফলে কবিতায় পাঠককে টেনে রাখার রসদ যোগান দিতে হবে কবি-কে। স্মর্তব্য যে, বিজ্ঞানের ‘গতিতত্ত্ব’ অনুযায়ী পাঠক অনুসন্ধানী হয়ে উঠলে তার পাঠতৃষ্ণা ক্রমেই বাড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘কবিতায় গতি’ সৃষ্টিতে পুরোধা হিসেবে মানেন কবিতাবোদ্ধারা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গতির উপাসক, নবপ্রবণ ও নবগতির জয়ঘোষক। কবি-মনের সেই গতির সুর ‘বলাকা’ কাব্যে সুস্পষ্ট। ‘বলাকা’ গ্রন্থের কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার ‘বলাকা’র কবিতাগুলোতেও সেই গতির কথাই বলেছি। গতির ছন্দেই বিশ্বের সৌন্দর্য। গতি নিয়েই সৃষ্টি। এই চরাচর সেই সৃষ্টি বা গতির প্রবাহ। কি অপূর্ব ছন্দে এ সৃষ্টির প্রবাহ চলছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়।” সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ‘গতির ছন্দেই বিশ্বের সৌন্দর্য’ দেখেছেন, এ বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ থাকে না। প্রাবন্ধিক-গবেষক মোবারক হোসেন খানের মতে, ‘গতিবাদই হলো বলাকা’র মর্মকথা। বলাকার বিমানগতি এবং তার পাখার শব্দ কবির অন্তরে অদ্ভুত কল্পনা জাগিয়েছে। সে কল্পনা গতি বা যাত্রার কল্পনা। প্রকৃতির একটা উপযুক্ত পরিবেশে কবির গতি-অনুভূতি বিস্ময়কর সমগ্রতা লাভ করেছে। এ অনুভূতি কবির একান্ত নিজস্ব। এ অনুভূতির গতির সঙ্গে একান্ড কবিমানসের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তের বহির্প্রকাশ।’ বিজ্ঞান স্বীকার করে ‘শক্তি এবং গতি’র ফলেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি। ‘বিগব্যাঙ’ তত্ত্ব কিংবা ‘ঈশ্বরকণা’ তত্ত্বেও এ যুক্তির সত্যতা আছে। তবে গতিঋদ্ধ কবিতা সৃষ্টিতে কবিমানস মানবমুখীন হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন বোদ্ধারা। প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভার প্রধান ধর্ম ইহার মানবমুখিতা; কালিদাসের পর এত বিরাট মানবমুখী কবিপ্রতিভা আমাদের দেশে জন্মিয়াছে কি না সন্দেহ।’ অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বিজ্ঞান ও গতি সম্পর্কিত প্রবন্ধে (আনন্দবাজার পত্রিকা ৭ আগস্ট ২০১২) আশীষ লাহিড়ী উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মের দু’বছর আগেই বেরোয় ডারউইনের ‘অরিজিন’। কিন্তু বিবর্তনবাদের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রবীন্দ্রনাথের সৃজনধর্মী রচনায় পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ‘মানসী’ (১৮৯০) ও ‘সোনার তরী’র (১৮৯৪) যুগ পর্যন্ত। ...‘বলাকা’য় (১৯১৬) পৌঁছে অন্য এক রবীন্দ্রনাথ। তিনি গতির মহিমায় অভিভূত। বিংশ শতকের পদার্থবিজ্ঞান বলে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা থেকে সুদূরতম নক্ষত্রজগত পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবল চলা আর চলার আবেগ। এতে স্পষ্ট হতে পারে যে, কবিতাকে গতিশীল করতে রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই নিমগ্ন ছিলেন। সুতরাং বলা যেতে পারে, কবিতাকে ‘প্রকৃত কবিতায়’ উত্তরণ ঘটাতে চাইলে ‘গতি’ সঞ্চালনের বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ৩. ‘কবিতা’ ভাব প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। কেননা, কবিতা এমন এক রচনা-যা নান্দনিক ও শৈল্পিকতার আধার। একটি জাতির বুদ্ধিভিত্তিক স্ফূরণ ও মননশীলতার নিখুঁত চিত্র পাওয়া যেতে পারে কবিতার মাধ্যমে। কবিতার আছে চিরন্তন উচ্ছ্বাস ও স্রোত, যার মাধ্যমে কবিতা পুরনো ও জীর্ণ রীতিনীতি পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। কবিতার এ স্রোত এমন অজেয় যা কখনও স্তব্ধ হবে না। জীবন স্তব্ধ হতে পারে তবে কবিতা কখনই নয়। পথের যেমন বাঁক আছে, তেমিনভাবে কবিতাও কখনও কখনও বাঁক নেয়। কবিতা যেমন স্বাধীন, দুর্বিনীত ও স্বেচ্ছাচারী, তেমনি আধুনিকতার প্রশ্নেও পোশাকে নয় মননে। এ জন্য কবিতাকে শাশ্বত করতে কবিমানসের সেই ঋদ্ধি অতীব জরুরী, যা একই সঙ্গে আধুনিকতাকেও সমর্থন করে। কবিতার পটভূমি তৈরিতে কবি-চিন্তা কোন নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না। ‘স্থান-কাল-পরিবেশ কিংবা কবির হৃদয়াবেগ ও অনুভূতি কবিতাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে তা কবিতার স্রষ্টা তথা কবির জানা থাকে না। কেননা বেদনার্ত হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি কিংবা কবিতা কবিরই জীবনের প্রতিফলন।’ দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, চিরকালীন হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, সামাজিক উৎসব ও আচার-অনাচার এবং প্রকৃতি কবির কবিতার উপজীব্য বা পটভূমি। কবির চিন্তা গতিপ্রাপ্ত হলে এই পটভূমি চিন্তাবিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে সমকাল-মহাকাল আলোকিত করতে পারে। কবিতার এসব আধার ও আধেয় বিবেচনায় কবিতাযাত্রায় দীক্ষিত পাঠকেরও আরাধ্য হয়ে ওঠে প্রকৃত গতির কবিতা। ‘যে কোন কবিতাকে, তিনটি মানদণ্ডের সমন্বয়ে মাপা যায়; তিনটির প্রতিটি নিক্তিতে যখন কোন একটি প্রস্তাবিত সত্য বা অভিজ্ঞতার উদ্ভাসঋদ্ধ সৃজনীরচনাকে ওজনদার হিসেবে পাওয়া যায়, তখনই বলা যাবে, এটি কবিতা; নিক্তি তিনটি হলো: ১. জীবন সম্পর্কে এর কি কোন নতুন বা উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি আছে? ২. শিল্প সম্পর্কে এর কি কোন নতুন বা উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি আছে? ৩. সত্য বা উপলব্ধি কিংবা অভিজ্ঞতার জগতে এটি কি কোন নতুনত্ব বা উদ্ভাবন অথবা পুনরাবিষ্কার যুক্ত করছে? একটি কবিতার ক্ষেত্রে সব ক’টি অথবা অন্তত দুটি জবাব হ্যাঁ বোধক হওয়া চাই’- এমনটি মনে করেন কবি রহমান হেনরী। গতির কবিতা খুঁজতে কবির এই বিশ্লেষণ যুক্তিপূর্ণ এবং অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক কাব্যবিশারদই দাবি করেন গত শতাব্দীর পশ্চিমা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি রায়নার মারিয়া রিলকে। রিলকের কবিতা প্রসঙ্গে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের আলোচনায় ‘গতি’র স্বরূপ উদ্ভাসিত। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর ভাষ্য অনুযায়ী, রিলকের কবিতায় যন্ত্রণাবোধ ও শোকানুভূতি অনায়াসে প্রবেশ করে, যদিও এই যন্ত্রণা আর শোক-ই কবিতার পধঃযধৎঃরপ প্রভাবে জীবনের জয়গানে রূপান্তরিত হয়। কবিতার বোধ বস্তুস্বরূপ থেকে অতীন্দ্রিয়ের দিকে ধাবিত হয়। শোক থেকে আনন্দ অভিমুখী এই যাত্রাকে গতির বিস্তার বললেও বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। ৪. দৈনন্দিন জীবন থেকেই মানুষ জীবনের মৌল পাঠ গ্রহণ করেন। আর কবিরা প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ-বেদনা, অপমান-লাঞ্ছনা কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রের নানান অসঙ্গতি এবং অবারিত প্রকৃতিসহ দৈনন্দিনতা খুঁড়ে শব্দ আহরণ করে তা ঘষে-মেজে তৈরি করেন কবিতার কাঠামো। এরপর ছন্দ, কাব্যিক উপমা ও উৎপ্রেক্ষার শাব্দিক অলঙ্কারে বিনির্মাণ করেন কবিতাকে; যাতে কথা, বিচার ও তাৎপর্যের সমন্বয় থাকে, প্রতিভাত হয় বিশ্বচরাচরে সর্বশেষ আলোচিত ঘটনা। সাধারণ মানুষ অভিধানের শব্দাবলী জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু কবির ব্যবহৃত শব্দাবলী আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে যায়, আর এখানেই কবির সার্থকতা। কবিতাবোদ্ধাদের মতে, কবিতায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দই একেকটি চিত্রকর্ম। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ভাবনা বা কবির বোধ, মনন ও চৈতন্যে মুগ্ধতার আবেশ ও প্রকাশভঙ্গির কারণে কবিতা হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ ও জীবন্ত। কবির বিমূর্ত ভাবনায় কবিতা কখনও কখনও নিছক প্রেমের কোমল অনুভূতি, বিরহের বেদনাবিধুর কান্না কিংবা কখনও-সখনও শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ হয়ে ব্যঞ্জিত হতে পারে। আবার যুগ-যন্ত্রণা ধারণ করে অধিকারবঞ্চিত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা দান কিংবা স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত সশস্ত্র সৈনিক কিংবা সমকাল-মহাকালের প্রতিভূ হয়ে উদ্ভাসিত হতে পারে। এত কিছুর পরও কবিতা যেন লোকাল ট্রেনের মতো খুঁড়িয়ে না চলে, শব্দ-জঞ্জালে পরিণত না হয়- সে ব্যাপারে কবিকে থাকতে হবে অধিক সচেতন। পরিশেষে বলা যেতে পারে, কবিতাকে প্রকৃত কবিতা করে তুলতে, শুধু অবয়বই বিচার্য নয়, কবিতার অন্তর্গত বোধের জায়গাটিতেও পরিবর্তন জরুরী। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ‘জীবনের সবকিছুর মাঝেই নিয়মতান্ত্রিক স্পন্দন আছে। মানুষের ভাবনা, আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ম মেনেই সর্বদা উড়ে চলেছে। ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে জানা নেই তবু আশা-আকাক্সক্ষার মোহে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে মানুষের মন। কোথায় সব চলেছে কে জানে? মনের এই ছুটে চলাই গতির প্রকৃত রূপ। বীজ থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে বৃক্ষে, বৃক্ষ থেকে ফুলে, ফুল থেকে ফলে, আবার ফল থেকে বীজে চক্রাকার এই প্রাণের যাত্রা। জীবন ও মৃত্যুর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই গতির লীলা বিরাজমান।’ কবিতা যদি নানাবিধ অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে মানবমুখীন না হয়, তাহলে সে কবিতাকে গতির কবিতা বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে সংশয়-সন্দেহ থেকেই যায়। আমার বিশ্বাস, শাশ্বত কবিতা বিনির্মাণে সেই সব প্রপঞ্চের সন্নিবেশ এবং রসায়ন জরুরী, যাতে কবিতা হয়ে ওঠে ‘গতিঋদ্ধ’, সর্বাঙ্গসুন্দর এবং জীবনমুখীন। এমন কবিতাপাঠে পাঠকের শৈল্পিক ভ্রমণ একই সঙ্গে যুগোপযোগী এবং সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
×