ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প- খাম

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ১৬ মার্চ ২০১৮

গল্প- খাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) ধরতেই হলো। ‘আব্বা, আপনি নাকি মসজিদ থেকে বাসায় ফেরেন নি। কারও কলও ধরছেন না। কেইসটা কি বলুন তো? এই ভর দুপুরে কোথায় আপনি? কী করছেন? খেয়েছেন কি ?’“ ‘কোন্টা আগে বলবো বাবা।’ ‘ও. কে, এখন কিছুই বলতে হবে না। আপনি এখনই বাসায় চলে যান। আম্মা রুনা মুনা সবাই খুব টেনশনে। আর আপনার যা প্রবলেম একটু শুনলাম, সেগুলো কিছুই না। রাতে বাসায় ফিরে সব ক্লিয়ার করে দেব। কিচ্ছু ভাববেন না। ও. কে আব্বা?’ ‘ও. কে বাবা।’ -সুবোধ ছেলের মতো উঠে পড়েন আবুল হাসান। রক্তের ক্ষুধাটা তখন আবারো নাড়িভুঁড়িতে। এবার আরও জোরেসোরে। ০৪. ‘না আব্বা, আপনি যা বলছেন তা ঠিক ক্লিয়ার হলো না। আমার মনে হয়, কেউ আপনার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চেয়েছে, না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। জঙ্গি টঙ্গি নয় তো আব্বা?’ -জামাই মারুফ উত্তরের জন্য শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘নারে বাবা, জঙ্গি টঙ্গি কিছু না। বিষয়টা আসলে তোমাদের বোঝানোর মতো না। একটু কমপ্লিকেটেড। তোমার আম্মাকে যেটা বলেছি সে ব্যাপারে যদি কিছু করতে পার তো কর, না পারলে আমাকে আর বিরক্ত কর না বাবা। আমার ভালো লাগছে না।’ কারো কাছে কোন হেল্প পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিলেন আবুল হাসান। অনেক ভেবে চিন্তে যে পথ ধরলেন তা অনেকটা আত্মঘাতী। খাওয়া কমিয়ে দিলেন। সকালে শুধু এক কাপ চা, দুপুরে এক প্লেট ভাত আর রাতে এক গ্লাস গরম দুধ। এর বেশি কেউই তাঁকে জোর করে খাওয়াতে পারে না। কথাও বলেন খুব কম। এভাবে মাস দেড়েক কেটে গেছে। শরীর ভেঙে পড়েছে। দুর্বলতায় মসজিদেও ঠিকমতো যেতে পারেন না। সারা দিনরাত একা ঘরেই পড়ে থাকেন। মোবাইলে ঘনিষ্ঠ কারো সঙ্গে যে টুকটাক কথা বলতেন, সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর খাম দেয়া-নেওয়ার বিষয়টা সম্ভবত হামিদ মিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করলো। কিন্তু কী উত্তর দেবেন আবুল হাসান? সমস্যাটার সুরাহা তো করা গেল না। রাগে দুঃখে মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঘরের বাইরে। এখন একেবারে বিচ্ছিন্ন। দুনিয়া আর আখেরাতের আজাবের কথা ভেবে ভেবে মাঝেমধ্যে হাউ মাউ করে কাঁদেন, পাগলের মতো চিৎকার করেন। এরপরও মেরিনা বেগমের অনড় অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না। মে মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। সাত জুন থেকে রোজা শুরুর সম্ভাবনা। আবুল হাসানের বেড থেকে ওঠা নামা করতেও এখন কষ্ট হয়। বেডের পাশে ক্যালেন্ডারের দিকে অসহায়ের মতো তাকান তিনি। ১৬ তারিখটাকে কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন সেই দিকে। শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি নেমে যায় কোমড়ে। তিনি কি সত্যিই বিশ্বাস করছেন তারিখটাকে? হয়তো, হয়তো বা নয়। হতে পারে-একটা নিষ্পাপ শিশুর মুখ দিয়ে তারিখটা আল্লাহই বলিয়েছেন, আবার এ-ও হতে পারে-এ এক অস্বাভাবিক শিশুর অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া কিছুই না। তবু মালাকুল মউত যদি ওই দিন তশরিফ এনেই ফেলেন, তাহলে? সময়ই তো নেই হাতে। রাতদিন আল্লাহর কাছে ক্ষমার জন্য কাঁদাকাটি করছেন বটে কিন্তু সম্পদ থাকতে তো এর দায় থেকে মুক্তি মিলবে না। অর্ধ অনশনও কাজে আসছে না। স্ত্রী, সন্তান সবাই হঠাৎ করে পর হয়ে গেল। কেউ আর কাছেও আসে না। সম্পদের মায়া সব বন্ধনকে এভাবেই মিথ্যে করে দেয়? কাদের জন্যে তাহলে জীবনটাকে শেষ করলেন তিনি! চোখের কোণটা ভিজে ওঠে আবুল হাসানের। হঠাৎ কিসের একটা হৈচৈ এর শব্দ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। বিছানা থেকে উঠে বসেন আবুল হাসান। হ্যাঁ, মারুফের গলাই তো। ‘আমি আর কোন কথাই শুনতে চাই না আম্মা। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে আব্বাকে পেয়েছি। সেই আব্বাকে আপনারা সবাই প্রায় না খাইয়ে মেরে ফেলছেন। এ আমি হতে দেব না আম্মা। হয় আপনি রাজি হবেন বাড়ি বেচতে, না হলে এক্ষুণি আমি সবকিছু ছেড়ে চলে যাব। গো আই মাস্ট। কোনদিন ফিরবো না। নেভার।’ ‘শোন মারুফ। একটু বোঝার চেষ্টা কর। তোমার আব্বাকে তো আমি চিনি। সরল সোজা মানুষ। কেউ হয়তো কুবুদ্ধি দিয়ে বলেছে- তোমার তো ছেলে নেই, দু’দুটো বাড়ি রেখে কী করবে? একটা বেচে দাও। ঋণ টিন আসলে কিছু না। তোমার আব্বা ঋণ করার মানুষ না। ওটা একটা অজুহাত। কয়েক দিন পর রোজা। দেখবে-তখন আর উনি না খেয়ে পারবেন না। আরেকটু ধৈর্য ধর বাবা।’ ‘বেয়াদবি নেবেন না আম্মা। ধৈর্য অনেক ধরেছি। আর না। আপনারা কেমন মানুষ বলুন তো? চোখের সামনে নিজের স্বামী বাবা না খেয়ে খেয়ে বিছানায় লেগে যাচ্ছে, প্রেসার লো হয়ে যাচ্ছে। সেটাকে কিছুই মনে করছেন না? তুচ্ছ বাড়িটাকেই বড় করে দেখছেন? আফটার অল, এটা আব্বার নিজের সম্পদ। তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। এখানে আমরা বলার কে?’ ‘তোমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো বলেছিলাম বাবা। আমার আর কী প্রয়োজন।’- অস্ফুট কান্নায় গলাটা কেঁপে ওঠে মেরিনা বেগমের। আর কথা বাড়ান না। ধীর পায়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ঠিক আছে। দক্ষিণ পাশের বাড়িটা রেখে বাকিটা যা ইচ্ছে হয় কর। আমার আর কিছু বলার নেই।’ পূর্ণ অনশনে আর যেতে হলো না আবুল হাসানের। অর্ধ অনশনেই কাজ হয়ে যাওয়াতে শরীর মন দুটোই এখন বেশ চাঙ্গা। মনে মনে খুশি হন তিনি মারুফের ওপর। পরের ছেলে হয়েও যে এতটা করবে-ভাবতেও পারেননি তিনি। মেইন রোডে বাড়ি বলে বিক্রি হতে সময়ও লাগলো না। টাকা হাতে পেয়েই আবুল হাসান হামিদ মিয়ার সঙ্গে ঝামেলা মেটালেন আগে। তালিকার অন্য সবার সঙ্গেও যোগাযোগ করে খাম বিতরণের কাজ শেষ করে এনেছেন প্রায়। রোজা শুরুর আগেই তালিকার সর্বশেষ মানুষটির কাছে খাম পৌঁছে দিয়ে মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করেন আবুল হাসান। কিন্তু চট করে মনে পড়ে যায় সেই তারিখটার কথা। আর মাত্র আট দিন বাকি। ধক্ করে ওঠে বুকটা। শেষ হয়ে যাচ্ছে কি সময়? ০৫. সকালে হুট করে পরিবারের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার ব্যাপারটায় হকচকিয়ে যায় সবাই। হলো কি আবুল হাসানের? কিন্তু তা আর জানা সম্ভব হলো না। বিস্ময়, প্রশ্ন, উদ্বেগ, কান্না সব কিছু মনেই থেকে গেল সবার। কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আবুল হাসান। সবাইকে চলে যেতে বলে শুধু মারুফকে কাছে টেনে নেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘শোন মারুফ। কেন যেন মনে হচ্ছে- আজ এই ষোলো জুন আমার জন্য একটা ব্লাক ডে। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। যখন তখন যে কারও জীবনে এমন একটি দিন আসতে পারে। হয়তো আমারও সে দিনটি এসে গেছে। ওরা শুনে খামোখা হাউ মাউ করবে। তাই ওদের সরিয়ে দিয়েছি। তুমি আমার ছেলের মতো। অস্থির হবে না। শোন, আজ যদি আমি বেঁচে যাই তো গেলাম। আর যদি চলে যেতেই হয়, তাহলে মকবুল হুজুরকে খবর দেবে। ওনাকে সব বলা আছে। যা করার উনিই করবেন। তুমি আজ ছুটি নাও। আজ আমি কারও সঙ্গে কোন কথা বলবো না। কেউ যেন আমার ঘরে না আসে, ডিস্টার্ব না করে- সেটা তুমি দেখবে। আমি না থাকলে রুনার বিয়ের ব্যবস্থা সব তুমিই করবে। টাকা পয়সা ক্যাশ করে আমার লকারে রেখেছি। আম্মাকে বললেই পেয়ে যাবে। যা বললাম সব গোপন রাখবে। ওকে?’ ‘কিন্তু আব্বা। আমার মনে হচ্ছে আপনি মিছেমিছি এসব ভাবছেন। থানায় জিডি করেছি। আমার র‌্যাব পুলিশের বন্ধুরা ওদের রেগুলার ডিউটিতে অলরেডি ব্যাপারটাকে ইনক্লুড করেছে। একটা টিকটিকিও ঢুকতে পারবে না বাসায়।’ আবুল হাসান মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন। কিন্তু মারুফ মন খারাপ করবে ভেবে শুধু বললেন, ‘এসবের কোন দরকার ছিল না বাবা। আল্লাহর ফায়সালার ওপরে কারো কোন হাত নেই। যাও, যা বললাম কর।’ সকালেই গোসল সেরে নিলেন আবুল হাসান। ধোপদুরস্ত সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা আর সাদা গোল টুপি পরে জায়নামাজে বসে পড়লেন। সারাদিন মসজিদেও গেলেন না। ঘরেই নামাজ আদায় করলেন। নামাজের ফাঁকে ফাঁকে সিজদায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন আর জীবনের সমস্ত গুনাহর কথা মনে করে আল্লাহর দরবারে মাফ চাইতে থাকেন। সময় গড়াতে থাকে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। রাত আসে। আবুল হাসান বুঝতে পারেন-দরোজার ওপাশে মেরিনা, মেয়ে, কাছের কিছু মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেউ কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। মারুফের কড়া নিষেধ। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। এর মধ্যে মারুফ এসে শ্বশুরের কানে কানে বলে গেছে- ‘কোন চিন্তা নাই আব্বা। র‌্যাব পুলিশের বন্ধুরা টেকনিক্যালি পুরো বাড়িটা ওয়াচে রেখেছে। বাড়ির গার্ডকে ম্যানেজ করে সিসিটিভিতে সারাক্ষণ নজর রাখতে বলেছি। এমনকি বাড়ির ছাদেও আমার নিজস্ব লোকজন চারপাশে লক্ষ্য রাখছে। কারও বাবার ক্ষমতা নেই যে কিছু করবে।’ আবুল হাসানের তাতে কোন ভাবান্তর হলো না। রাত বারোটার দিকে সেই যে তিনি সিজদায় মাথা রেখেছেন, আর তুলছেনই না। ঘণ্টাখানেক ধরে একেবারেই চুপচাপ। কারো ডাকেই সাড়া দিচ্ছেন না। রাত তখন দুটোর কাছাকাছি। মারুফ এবার আর অপেক্ষা করে না। অনেকটা আনন্দ ধ্বনি দিয়েই বলতে থাকে- ‘হুর রে আব্বা! মাথা তুলুন। বারোটা পার হয়ে গেছে। দ্যাট হরিব্ল সিক্সটিন ইজ ওভার! নাউ নো প্রবলেম আব্বা!’ আবুল হাসানের নিথর শরীরটা এবার একটু নড়ে ওঠে। মাথাটা জায়নামাজ থেকে একটু উঠিয়ে কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকেন মারুফের দিকে। তারপর খুব ধীরে খুব ঠা-া গলায় বললেন- ‘আজ কয় তারিখ বাবা?’ ‘সেভেনটিন আব্বা! লাকি সেভেনটিন! য়ু আর নাউ ফ্রি ফ্রম ডেঞ্জার! আমি ফেসবুকে অলরেডি পোস্ট দিয়ে বন্ধুদেরকে বলে দিয়েছি- আমাদের প্রিয় আব্বাজান ভয়াবহ এক বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তোমরা যে যেখানে আছো চলে এস আমাদের বাসায়। একসঙ্গে সেহরি খেয়ে আনন্দটাকে সেলিব্রেট করবো। সবাই আসতেও শুরু করেছে আব্বা।’ ‘আলহামদুলিল্লাহ! হৈ চৈ করো না। আমি আরও কিছুক্ষণ সিজদায় থাকতে চাই বাবা। সেহরির সময় শেষ হওয়ার মিনিট পনের আগে ডেকো।’ ‘কিন্তু আব্বা, একটা জরুরী কথা। চৌদ্দ পনেরজন ভদ্রলোক সেই রাত দশটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বলেছি- আব্বা বারোটার আগে কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। সমস্যা আছে। এখন তো তাঁরা...’ তড়াক করে জায়নামাজ থেকে লাফিয়ে ওঠেন আবুল হাসান। যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। ‘কি বল, প-নে-র জন! চল চল, দেখি কারা।’-দ্রুত এগোতে থাকেন আবুল হাসান। তাঁকে অনুসরণ করে শুধু মারুফ। ড্রইংরুমে ঢুকতেই অপেক্ষমাণ লোকজন আবুল হাসানের সম্মানে দাঁড়িয়ে যান। সালাম দেন। তাদের মধ্যে শুধু একজনকে চিনতে পারেন আবুল হাসান। নোমানুর রহমান। ‘কি ব্যাপার নোমান সাহেব, এত রাতে?’ ‘কি আর বলবো স্যার, অনেকদিন দেখা নেই। তাছাড়া হামিদ মিয়ার মুখে শুনলাম আপনি নাকি সবার কাছে গিয়ে খামগুলো ফেরত দিচ্ছেন। আমরা কি অপরাধ করলাম স্যার। একটু মনেও করলেন না। তাই..’ ‘কিন্তু আমি তো ওসব শেষ করেছি নোমান সাহেব। আপনারটাই শুধু বাকি থাকতে পারে। কিন্তু ওরা..’ ‘ওরাও দিয়েছিল স্যার। আপনার হয়তো মনে নেই। সেজন্যে ওরা কোন্ কাজের জন্য কয়টা খাম সব লিখে এনেছে। দেখলেই আপনার মনে পড়ে যাবে।’ ভড়কে যান আবুল হাসান। হতেও পারে ব্যাপারটা সত্যি। সব কি আর মনে থাকে? কিন্তু হাতে তো তেমনটা আর নেইও। কি করা যায়। একটা উপায় মাথায় নিয়ে মারুফের দিকে তাকান আবুল হাসান। কিছু বলতে চাইছিলো মারুফ কিন্ত শ্বশুরের ইশারায় বেরিয়ে যেতে হলো। আবুল হাসান সবাইকে কাছে ডেকে বললেন, ‘দেখুন, ভীষণ এক ঝামেলায় ছিলাম, আসতে পারিনি। স্যরি। সেহরির সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। জামাই এর র‌্যাব পুলিশের বন্ধুরা সেহরির দাওয়াতে আসছে। ওদেরকে সময় দিতে হবে। তাই বলে আপনাদের খালি হাতে ফেরাবো না। সবাইকে দিয়ে থুয়ে হাতে সামান্য যা আছে তা নিয়েই যদি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে মাফ করে দেন, তাহলে চেষ্টা করতে পারি।’ সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। ফিসফাঁস করেন। যে কারণেই হোক দ্রুতই রাজি হন তাঁরা। আবুল হাসান চট জলদি ঘরে গিয়ে পনেরোটি খাম নিয়ে ফিরে আসেন। খামগুলো নিয়েই সালাম দিতে দিতে বেরিয়ে যান তারা। আবুল হাসান ভেবেছিলেন-যাক খামের ইস্যুটা থেকে অন্তত বাঁচা গেল। কিন্তু তা আর হলো কই? ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লেন অনেক পুরনো এক আদরের অতিথি। শিক্ষিকা শিরিন বেগম। ‘আরে শিরিন! তুমি এত রাতে! কি ব্যাপার?-বিষ্ময়ে হতবাক আবুল হাসান। অতিথির চোখে চোখ রেখে ভাবেন-আহা, এই শিরিন তার কিই না ছিল। শুধু স্ট্যাটাস মিললো না বলে বিয়েটা হলো না। কপাল পুড়লো শিরিনেরও। বছর দেড়েকের একটা ছেলেকে নিয়ে সেই যে বিধবা হলো- আর বিয়েই করলো না। তারপরও এখনও কি টান টান শরীর ওর! পঁয়তাল্লিশ পার হয়েও যেন বত্রিশের গনগনে আগুন! অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিস্থিতিতেও চোখ সরাতে পারেন না আবুল হাসান। ‘হ্যাঁ এলাম। আমার জন্যে রাতই কি, আর দিনই কি? কারো সাহস আছে নাকি আমার সামনে আসার? শুনলাম-তুমি চুপে চুপে খাম ফেরত দিয়ে বেড়াচ্ছো সবাইকে। খুব ভালো কথা। তো আমি আর বাদ যাই ক্যানো। আমার খামটা কই?’ ‘তোমার আবার খাম কিসের? ওই রকম কিছু তো নেইনি তোমার কাছ থেকে।’ ‘নাও নি মানে? সবচেয়ে দামিটাই তো নিয়েছ।’ ‘সেটা আবার কি?’ ‘কেন, আমার এই শরীরের নতুন টসটসে খামটা? ওটা ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে কে? এখন ভুলে থাকার ভান করছো, তাই না? ছিলে ছিবড়ে খেয়ে ফেলে দিতেও তো দ্বিধা করনি। কাওয়ার্ড কোথাকার!’ আবুল হাসান এবার মাথা নিচু করেন। শিরিন বেগম আবারও ঝলসে ওঠে- ‘শোন আবুল হাসান, তবুও তোমার মতো এক অথর্বের কাছে এসব বলতে আমি আসতাম না। বাট যখন শুনলাম তুমি জান্নাতের পথ ক্লিয়ার করতে দু’হাতে খাম ফেরত দিতে শুরু করেছ তখন আর থাকতে পারলাম না। আমাকে জাহান্নামের আগুনে রেখে তুমি যাবে জান্নাতি বালাখানায়? এত্ত সোজা? নো, সবাইকে যখন ফেরত দিচ্ছো আমারগুলোও দিতে হবে। যা যা নিয়েছ সবটা চাই। সব। আমার খামটাই হবে সবার চেয়ে ভারি আর হেলদি। বুঝেছ সোনার চাঁন?’।-আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে যেন শিরিনের মুখ থেকে। রাগে কাঁপতে থাকে সে। ‘ওগুলো তো যা হবার হয়ে গেছে শিরিন। ফেরত দেব কিভাকে। প্লিজ শিরিন, ওসব নিয়ে সিনক্রিয়েট করো না। ঘর ভর্তি মেহমান। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। প্লিজ শিরিন।’ জোড়া হাত সামনে বাড়ান আবুল হাসান। ‘কিসের মাফ? কোন মাফ নেই। আমাকে শেষ করে দিয়েছ তুমি। এখন কড়ায় গ-ায় ফেরত চাই। কিভাবে দেবে আমি জানি না। বাট না নিয়ে আমি যাচ্ছিও না। মাইন্ড ইট।’- ধুপ করে সামনের সোফায় বসে পড়ে শিরিন। ‘তা-ই!!’ হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাতেই স্ট্যাচু হয়ে যান আবুল হাসান। মেরিনা বেগমের হিংস্র চোখ একবার আবুল হাসানের দিকে, আরেকবার শিরিনের দিকে ছোটাছুটি করছে। ঘাড়টা আর ঘোরাতে পারেন না আবুল হাসান। শক্ত হয়ে যাচ্ছে ঘাড়ের রগগুলো। কে যেন হা করে গিলে খাচ্ছে সমস্ত আলো। মুঠোটাও আলগা হয়ে যাচ্ছে। হাতের সাদা তসবিহটা হঠাৎ পড়ে যায় মেঝেতে। পাড় ভাঙা নদীর এক চাপ মাটির মতো। ঝুপ্ করে। (শেষ)
×