ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারী দিবসে WEA’র পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৬ মার্চ ২০১৮

নারী দিবসে WEA’র পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান

আন্তর্জাতিক নারী দিবস অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীর অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের এক মহিমান্বিত কাল পর্ব। একজন নাগরিকের সব ধরনের মৌলিক চাহিদা অর্জন করে নিজেকে সমাজে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার মধ্যেই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। দিনটির গভীর তাৎপর্য। রক্ষণশীল সমাজের সমস্ত অপসংস্কারের দায় বর্তায় অসহায় ও দুর্বল অংশ হিসেবে নারীর ওপর। আর সেই বঞ্চনার করুণ আখ্যান শুরু হয় একবারে পরিবার থেকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এক পরিসংখ্যানে বের হয়ে আসে কোন বালিকা প্রথম অত্যাচারিত হয় তার মায়ের কাছ থেকে। ভাই-বোনের ফারাক করতে চেয়ে সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ অর্জন জোটে সংসারের পুত্র সন্তানের। আর সেখানে দরিদ্রতার নির্মম কষাঘাতে পারিবারিক দীনতায় অধিকার হরণের বোঝা এসে পড়ে অবোধ কন্যাসন্তানটির ওপর। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিয়মের আবর্তে পড়ার কারণে বাপের বাড়িতে মেয়েদের বঞ্চনার কাহিনী সেভাবে উঠেও আসে না। তবে বিয়ের পর নারী-নির্যাতনের ঘটনা যেভাবে সাড়া জাগায় তার শুরু তো হয় আরও আগ থেকেই। কারণ বিয়েটাই তো একটা মেয়েকে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মাঝপথে শিক্ষা জীবনের ছন্দপতন ঘটে যার পুরো দায় বর্তায় বালিকাটির বাবা-মার ওপরই। উন্নয়নের ছোঁয়ায় সারাদেশ যখন নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই মাত্রায় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানও বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ার সেই ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতা আরও গতিশীলতায় রূপ নিচ্ছে। তার পরও নারী তাদের অধিকারও দাবি আদায়ে আজ অবধি লড়াই করে যাচ্ছে। পরিবারের ক্ষুদ্র গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে মেয়েদের অংশগ্রহণ যতই দৃশ্যমান হচ্ছে তাদের ওপর সহিংসতার চিত্র সেই মাত্রায় সামনেও চলে আসছে। ঘরের নিভৃত কোণে যে নির্যাতন নারীদের বাকরুদ্ধ করে রেখেছিল সময়ের দাবিতে আজ সেই অবিচারের বিরুদ্ধে তারা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নিজের অধিকার আদায় করে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবল ইচ্ছে থেকেই নারীরা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সেভাবে সফলতাও নিয়ে এসেছে। নিজের উদ্যোমে ভেতরের নিরবচ্ছিন্ন তাগিদ থেকে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে পেশার ক্ষেত্রেও আপন বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল রেখেছে। এমনই কয়েক নারীকে সামনে নিয়ে এসেছে Women Enterpreneurs Association আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে। এই WEA-এর শুভযাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। বেসরকারী ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এই নারী উদ্যোক্তা তৈরি বিষয়ক সংস্থাটি বিভিন্ন কর্মোদ্যোগের সঙ্গে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে এসেছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিকেও। বিজ্ঞাননির্ভর আধুনিকতায় নারীরা যদি সম্পৃক্ত হতে না পারে তাহলে বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনার সঙ্গে নিজেদের তাল মেলাতে কঠিন হবে। সঙ্গত কারণে সময়ের দাবি থেকেও ছিটকে পড়তে পারে। বিভিন্ন পেশার নারীদের উদ্যোগী করার অদম্য স্পৃহা থেকে এই নারীবান্ধব সংগঠনটি গত ২৫ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে আসছে। শুধু তাই নয় সারা বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতির ব্যাপারে বিশেষ নজরও রাখছে। সেই অগ্রসরমান নারীদের মধ্যে থেকে ৪ বিশিষ্ট নারীকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য সম্মাননা প্রদান করেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য, বেগম রোকেয়া নামে একজন সফল কর্মোদ্যোক্তা নারী যিনি বাল্যবিয়ের আবর্তে পড়েও অসম সাহসিকতা ও প্রচ- মনোবল নিয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়ার মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবা-মার মনোনীত পাত্রের সঙ্গে বিবাহ হয়ে যায়। বিয়ের আগে শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি হয় মায়ের কাছে। সংসার জীবনে প্রবেশ করার পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি দুই সন্তানের মা হয়ে যান। বাল্যবিয়ে আর অকাল মাতৃত্বের দুর্বিপাকে পড়া এই লড়াকু নারী নতুন করে তার শিক্ষাজীবনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন ভেতরের অকৃত্রিম বোধ থেকেই। এক সময় মাধ্যমিক পাস করে নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্ত করলেন। তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে বাকি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় স্নাতক ডিগ্রীও অর্জন হয়। শুধু তাই নয়, রাজনীতি সচেতন এই অদম্য নারী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রকোনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নারীদের জন্য যা যা করণীয় সাধ্যমত সেটাই করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে দুটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে রোকেয়া তার উদ্যোক্তার জীবনের পথ চলা শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানে অন্যান্য নারীর অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠানটি তাঁর ব্যবসায়িক কর্মযোগ এগিয়ে যেতে থাকে। ‘স্বাবলম্বী উন্নয়ন সংস্থা’ নামক সংগঠনটি আরও পেশাজীবী নারী তৈরিতে বিশেষ অবদানও রেখে আসছে। এই সফল নারীকে ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। WEA -এর পক্ষ থেকে। এই সংস্থার সভানেত্রী নিলুফার আহ্মদ করিম এই বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠানটিকে সফল করায় আগত অতিথিদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আর এক সম্মাননা পদকপ্রাপ্ত নারী শারমিন আক্তার। বাড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবাকেন্দ্রের এই প্রশিক্ষক শারমিন স্বল্প আয়ের পিতার সংসারের অভাব-অনটনকে মোকাবেলা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করেছেন। মাত্র উচ্চমাধ্যমিক ডিগ্রীধারী শারমিন তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা প্রদর্শন করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই স্বাধীনচেতা নারী নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। এক সময় প্রযুক্তিগত বিজ্ঞান সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেছেন। সেখানে পারদর্শিতা অর্জন করলে নিজেই তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেন। শিক্ষানবিস থেকে এখন তিনি একেবারে প্রশিক্ষকই শুধু নন একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাকেও বাছাই করা হয়েছে সম্মাননা প্রদানের জন্য। মিলন চিশিম ময়মনসিংহের গারো আদিবাসী পরিবারের সন্তান। তবে মেধাবী এই মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে তিনি নিজের এলাকায় ফিরে যান। তার তৈরি করা হালুয়াঘাটে একটি গারো বস্ত্র বুনন এবং সাধুপাড়াতে বাঁশজাত পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু আছে। যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী। এই নারী-ঘনিষ্ঠ দেশজ শৈল্পিক কারুকার্যে অনেক স্বাবলম্বী মেয়েরা আজ কর্মী হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। সুশিক্ষিত এই নারী শুধু গারো আদিবাসীদের মধ্যেই নয়, সারা বাংলাদেশের নারী জাতির পথিকৃৎ হিসেবে এই দুর্লভ সম্মাননার অংশীদার হন। কৃষি খাতে অনবদ্য অবদান রাখার জন্য ফাতেমা জোহরাকে সম্মাননা প্রদান করে ডঊঝ সংস্থা নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত দেন। ফাতেমা ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা এক অদম্য নারী যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অর্থনীতির বিশ্লেষক, গবেষক এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সুবর্ণ সময় কাটালেও কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিশেষ বিবেচনায় তার যাপিত জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়েছেন। কৃষিতে পরিবেশ ঘনিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যবান্ধব ফলন উৎপাদনে তার অবিস্মরণীয় কর্মযোগ সবার কাছে দৃষ্টান্ত। ‘শ্যামল বাংলা কৃষি খামার’ নামে এক শস্য উৎপাদন প্রকল্পের যাত্রা শুরু করে কৃষি অর্থনীতিতে অনবদ্য অবদান রাখার কারণে শ্রেষ্ঠ কৃষক হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারে অভিষিক্ত হন। ডঊঅ সংস্থাও এই বিশিষ্ট কৃষিবিদকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন। এই মহতী অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শারমিন জাহান।
×