ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জীবনযোদ্ধা আনোয়ারা বেগম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১৬ মার্চ ২০১৮

 জীবনযোদ্ধা আনোয়ারা বেগম

দারিদ্র্য হার মানাতে পারেনি তাকে। সামাজিক কুসংস্কারের কোন গন্ডি থামিয়ে রাখতে পারেনি তার জীবন চলার পথকে। জীবনের প্রয়োজনে তোয়াক্কা করেননি সমাজের মোড়লদের রক্তচক্ষু। দেখিয়েছেন শত কষ্টের মধ্যে স্বল্প পুঁজি দিয়ে সৎ উপায়ে কিভাবে জীবন চালানো যায়। নিজের পরিশ্রমার্জিত অর্থ দিয়ে ছোট ছোট তিন সন্তানের মুখে তুলে দিয়েছেন অন্ন। বলছি জীবন সংগামে জয়ী এক নির্ভীক, পরিশ্রমী নারীর কথা। আনোয়ারা বেগম। বয়স ৫৫ বছর। তিন সন্তানের জননী তিনি। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। কম বয়সে সংসারি হয়েছিলেন। স্বামীর ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। সংসারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আয়ের জন্য স্বামীকে সাহায্য করেছেন মেঘনা ঘাটে পানি বিক্রিতে। বড় সন্তানের বয়স যখন আট হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার স্বামী। তার ভাষায়, ‘সে অসুখ খেয়ে নিল আমার স্বামীকে।’ জগৎজুড়ে নেমে এলো আঁধার। নিজের এবং তিন সন্তানের খাবারের ব্যবস্থা হবে কী করে? ছোট সন্তান তখন দুধের শিশু। দিশেহারা হয়ে পড়লেন। চারদিকে অভাব আর অভাব। আত্মীয়-স্বজনের সহানুভূতি কেবল সান্ত¦নার বাণীতে সীমাবদ্ধ। উদরে উনুন জ্বলে। উচ্চশিক্ষা নেই যে ভাল চাকরি করবেন আবার এত বেশি পুঁজিও নেই যে ভাল কোন ব্যবসা করবেন। বিধবা মহিলা ঘরের বাইরে এসে কিছু করবে তা মেনে নেয়ার মতো সামাজিক পরিস্থিতিও ছিল না। ভবিষ্যত অনিশ্চিত জেনেও ভেঙ্গে পড়েননি। শক্ত হাতে ধরেছেন জীবনযুদ্ধের হাল। সন্তানদের এবং যৎসামান্য যে অর্থ ছিল তা সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন ঢাকাতে। সে অর্থে ফুটপাথে খোলেন ছোটখাটো খাবারের দোকান । আর এ থেকে উপার্জিত অর্থে কোনরকমে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন দিন। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসা, সন্তানরাও বড় হয়। এ ব্যবসার অর্থেই বিয়ে দিয়েছেন দুই মেয়েকে। আজ নাতি-নাতনি নাতজামাই সবই হয়েছে তার। সেদিনের সে অভাব আর কষ্ট থেকে আজ অনেকটা দূর চলে এসেছেন তিনি। চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল তার জন্য কণ্টকাকীর্ণ। তাকে সহ্য করতে হয়েছে সমাজের চোখ রাঙানি আর অবজ্ঞা। তারপরও চালিয়ে গেছেন তার ব্যবসা। শুধু তিনিই নন তার এক মেয়ে, নাতি, এক নাতনিও পেশা হিসেবে এই ব্যবসাকে বেছে নিয়েছেন। আজিমপুর এতিমখানা মোড়ে রয়েছে তার ভাতের দোকান বা খোলা ভাত খাওয়ার হোটেল। সকাল ছ’টা থেকে শুরু করে রাত এগারো’টা পর্যন্ত খোলা থাকে তার এ দোকান। দিনমান হাসি মুখে সকলকে খাবার পরিবেশন করে চলেছেন। এ পথে চলাচল করা সব রিক্সা, ভ্যান চালক, বাস শ্রমিক, সাধারণ পথচারী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ছাত্র সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তার কাষ্টমার। রোজ সকালে নিজেই বাজার করেন। মাছ, মাংস, তরিতরকারি নিজের তত্ত্বাবধানে ধোয়া এবং রান্না নিজেই করেন। বয়স হয়েছে সন্তান, নাতি-নাতনি সাহায্য করলেও ব্যবসার হাল এখনও ধরে রেখেছেন নিজ হাতে। এ বয়সেও কারও মুখাপেক্ষী নন তিনি। কোন অভিযোগও নেই কারও প্রতি। কেবল একটি আক্ষেপ-অভাবের কারণে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে পারেননি। আক্ষেপের সুরে যখন বললেন, ‘জীবনের সব ইচ্ছা তো পূরণ হয় না মা’ মনে হচ্ছিল জীবনের সারসত্যটা উনি ভালই জানেন। এই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর শহরের ফুটপাথে টিকে থাকার নির্মম সংগ্রামে জয়ী আনোয়ারা বেগমের জীবনের গল্প বলে দেয় নারীরাও পারে।
×