ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলের তলের সপ্তাশ্চর্য

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ১৬ মার্চ ২০১৮

জলের তলের সপ্তাশ্চর্য

‘সপ্তাশ্চর্য’ শব্দটার সঙ্গে পরিচয় আছে সবারই। ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ে এসেছি প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম সপ্তাশ্চর্যের কথা। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন তো, এর কোনটার অবস্থান কি সমুদ্রের গভীরে নীল জলরাশিতে ছিল? ছিল না। কেন? খুব সহজ উত্তর হলো, কারণ পানির নিচের বিস্ময়কর স্থানগুলোকে আলাদা একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সপ্তাশ্চর্যগুলোর নাম মুখস্থ থাকলেও পানির নিচের সপ্তাশ্চর্যের এই তালিকার কথা অনেকেরই জানা নেই। সেডাম ইন্টারন্যাশনাল (কনজার্ভেশন, এডুকেশন, ডাইভিং, এ্যাওয়ারনেস এ্যান্ড ম্যারিন রিসার্চ) নামক একটি সংস্থা প্রথম পানির নিচের বিস্ময়গুলোকে নিয়ে তালিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৮৯ সালে তারা পানির নিচের বিস্ময়গুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ‘সেভেন আন্ডারওয়াটার ওয়ান্ডার্স’ নামক একটি প্রজেক্ট শুরু করে। ড. ইউজেনি ক্লার্কসহ কয়েকজন বিজ্ঞানীর একটি প্যানেল সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক গুরুত্ব, গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্ব, সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পানির নিচের চমৎকার স্থানগুলো থেকে বেছে নেন সেরা ৭টি স্থান। এই ৭টি বিস্ময় জায়গা করে নেয় পানির নিচের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল এ্যাকুরিয়ামে এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক পানির নিচের সপ্তাশ্চর্যের গল্প। পালাউ : প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র পালাউ। প্রায় ৩৪০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে এই দেশটি। এই দেশটিকে ঘিরে থাকা সমুদ্র এবং সমুদ্রতীরকে রাখা হয়েছে সেডাম ইন্টারন্যাশনালের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। ডাইভিং-এর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থানগুলোর মধ্যে পালাউ অন্যতম। এছাড়াও পালাউ তার অসাধারণ প্রবাল প্রাচীরের জন্য নজর কেড়েছে পর্যটকদের। প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে গঠিত এই প্রবাল প্রাচীর মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। যদিও পালাউয়ের প্রবাল প্রাচীর বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা প্রবাল প্রাচীর নয়, এটি সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও রঙিন প্রবাল প্রাচীর। বিজ্ঞানীরা এখানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির প্রবাল এবং ১৫০০ প্রজাতির মাছ খুঁজে পেয়েছেন, যে কারণে অনেক বিজ্ঞানীই পালাউকে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের সব প্রবাল প্রাচীরের চেয়ে এগিয়ে রাখেন। পালাউ তার সামুদ্রিক হ্রদ এবং মিঠাপানির হ্রদের জন্য জনপ্রিয়। এখানে প্রায় ৮০টি সামুদ্রিক পানির হ্রদ রয়েছে, যার প্রতিটিতেই রয়েছে লুকিয়ে আছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যা বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। এরমধ্যে জনপ্রিয় একটি হ্রদ হচ্ছে জেলিফিশ লেক। এছাড়া ব্লু কর্নার এবং রক আইল্যান্ড পালাউয়ের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। বেলিজ ব্যারিয়ার রিফ : এই মনোমুগ্ধকর প্রবাল প্রাচীরের অবস্থান বেলিজের আটলান্টিক ক্যারিবিয়ান উপকূলে। এই প্রবাল প্রাচীর প্রায় ২৬০ কিলোমিটার লম্বা। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় লম্বা প্রবাল প্রাচীর। এটি মূলত মেসো আমেরিকান ব্যারিয়ার রিফ সিস্টেমের একটি অংশ। প্রায় ১০৬ প্রজাতির প্রবাল এবং ৫০০ প্রজাতির মাছ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে এখানে। এছাড়াও নানা ধরনের সামুদ্রিক পাখির বসবাস এই প্রবাল প্রাচীর এলাকায়। বেলিজ ব্যারিয়ার রিফের অন্যতম আকর্ষণ লাইটহাউস রিফ, যেখানে একটি জনপ্রিয় এবং বড় স্বচ্ছ নীল পানির গোলাকার গর্ত রয়েছে, যার নাম বুহোল। ডিপ সি ভেন্টস : ইকুয়েডরে অবস্থিত ডিপ সি ভেন্টস বা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টস। এখানে ভূ-শক্তির কারণে উষ্ণপ্রস্রবণ সৃষ্টি হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠে ফাটলের কারণে ভূ-শক্তির দ্বারা উত্তপ্ত পানি নির্গমন হয় হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে। সমুদ্রের গভীরে লবণাক্ত পানি ম্যাগমার সঙ্গে মিশে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই পরিবেশেও কিন্তু পাওয়া যায় প্রাণের অস্তিত্ব। গ্যালাপাগোস দ্বীপমালা : পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত গ্যালাপাগোস দ্বীপমালা। ইসাবেলা, ফার্নান্ডিনা, সান ক্রিস্টবাল, সান স্যালভাদর এবং সান্টা ক্রুজ নামক পাঁচটি দ্বীপই এই দ্বীপমালার প্রাণ। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে এখানে। গ্যালাপাগোস দ্বীপমালা ইকুয়েডরের একটি অঙ্গরাজ্য। এই দ্বীপমালার আয়তন ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই দ্বীপমালার খ্যাতির অন্যতম প্রধান কারণ হল, চার্লস ডারউইনের যেই ভ্রমণ তাকে তার বিবর্তন তত্ত্বের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিল, যেই ভ্রমণের অংশ ছিল গ্যালাপাগোসও। পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জীববৈচিত্র্যের অধিকারী অন্যতম একটি স্থান গ্যালাপাগোস দ্বীপমালা। নানা প্রজাতির পেঙ্গুইন, কচ্ছপ, ডলফিন এবং মাছ রয়েছে এই অঞ্চলে। এছাড়া হরেক রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদও গ্যালাপাগোসের অন্যতম আকর্ষণ। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, গ্যালাপাগোস পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যেখানে আপনি ডাইভিং করতে পারবেন পেঙ্গুইনের সঙ্গে! গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ : অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের উপকুলের গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কথা সবারই জানা। এই প্রবাল প্রাচীরে পৃথিবীর প্রায় সব প্রজাতির প্রবাল রয়েছে। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কোরাল ইকোসিস্টেম। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে রয়েছে প্রায় এক হাজার দ্বীপ, যেগুলোর চারপাশ ঘিরে আছে প্রবাল প্রাচীর। এই দ্বীপগুলো জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ, সঙ্গে রয়েছে ঘন বন। সুতরাং গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের অন্যতম আকর্ষণ এই দ্বীপগুলো। এখানে প্রায় ২ হাজার ৯০০টি একক প্রবালপ্রাচীর রয়েছে। এই রিফে প্রায় ৪০০ প্রজাতির প্রবাল ও ১ হাজার ৫০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে, সঙ্গে আছে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী। ১৯৮১ সালে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহাকাশ থেকেও দেখা যায় গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। বৈকাল হ্রদ : রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ পৃথিবীর গভীরতম মিঠাপানির হ্রদ। এই হ্রদ সাইবেরিয়ার ইরকুতস্ক শহরের কাছাকাছি অবস্থিত। তুর্ক ভাষায় বৈ অর্থ ধনী এবং কূল অর্থ হ্রদ। এই শব্দ দুটি থেকেই উৎপত্তি বৈকাল হ্রদের নামের। এই হ্রদের সর্বনিম্ন প্রস্থ ২৫ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ প্রস্থ ৭৯.৫ কিলোমিটার। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৬৩৭ মিটার, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে গভীর হ্রদের মর্যাদা দিয়েছে। এই হ্রদটি ৩১ হাজার ৭২২ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে। প্রায় ৩৩০টি নদী মিশেছে এই হ্রদে। বৈকাল হ্রদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর পানির স্বচ্ছতা। এখানকার পানি এতই স্বচ্ছ যে যে কোন কিছু পানিতে ফেললে প্রায় ৪০ মিটার নিচ পর্যন্ত তা স্পষ্ট দেখা যায়। এই হ্রদে প্রায় ২ হাজার ৬০০ প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদ পাওয়া গেছে, যার ৭০% পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। বৈকাল হ্রদ নিজেই একটি বিস্ময়, সঙ্গে এর চারপাশের পাথুরে পাহাড় ও বন একে করে তুলেছে আরও মনোমুগ্ধকর। নর্দার্ন রেড সি : অপার সৌন্দর্যের জন্য নর্দার্ন রেড সি-কে বলা হয় ‘আন্ডারওয়াটার গার্ডেন অব ইডেন।’ এই প্রাকৃতিক চ্যানেল প্রায় ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটার লম্বা। এর প্রস্থ ১০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার এবং গভীরতা ৫০০ কিলোমিটার। রেড এ্যালগির উপস্থিতির কারণে কখনও কখনও এখানকার পানি হাল্কা লাল দেখায়, যে কারণে এর নাম নর্দার্ন রেড সি। এখানে প্রায় ১ হাজার প্রজাতির মাছ, ৪০০ প্রজাতির প্রবালসহ বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক প্রাণী বসবাস করে। নর্দার্ন রেড সি- অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে প্রবাল, যা একে পানির নিচের স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে।
×