ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লজ্জার বিষয় নয়, ঘরে বসেই পরীক্ষা করতে পারে নারী

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৭ মার্চ ২০১৮

লজ্জার বিষয় নয়, ঘরে  বসেই পরীক্ষা করতে পারে নারী

সমুদ্র হক ।। বিষয়টি মোটেও লজ্জার নয়, স্রেফ জ্ঞান ও সচেতনতার- যা বাঁচাতে পারে ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের। কিশোরী, তরুণী বা যে কোন বয়সের নারী ঘরে বসে নিজেই পরীক্ষা করে বুঝতে পারে তার ব্রেস্টের (স্তন) ভেতরে এমন কিছু আছে কিনা যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রোগে উপশমের করণীয় বিষয়গুলোও নারী জানতে পারে এই জ্ঞান দিয়ে। শিক্ষা একেকজনের, জ্ঞান সকলের। যা হাতে কলমে শিখিয়ে দিচ্ছে একটি মেডিক্যাল মিশন। যে টিম এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে এই টিম মেডিক্যালের শিক্ষার্থী ও নার্সদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে। যা যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে রোটারি ক্লাব অব ঢাকা, বিশ্ব স্বাস্থ্যের পার্টনার মেভরিকস। বগুড়ায় তাদের সঙ্গে আছে রোটারি ক্লাব অব করতোয়া। এই মিশনের টিম লিডার ডাঃ এলিজাবেথ ম্যাকলিলন বললেন, বাংলাদেশের নারী খুব সহজেই ব্রেস্ট ক্যান্সারে সচেতন হতে পারে। তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হচ্ছে কি না তা ঘরে বসে নিজেই জানতে পারে দেহের উপরিভাগে পরীক্ষা করে। যা খুবই সহজ। শুধু লজ্জার কারণেই তারা সহজ পরীক্ষাটি করতে চায় না। এই সহজ বিষয়গুলো তারা প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রকল্পের কোঅর্ডিনেটর সুস্মিতা খান বললেন, তারা যখন প্রথমে নারীদের শেখাতে চান তখন প্রায় সকলেই লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে। তাদের সহজ ও স্বাভাবিক করে নিতে একটু সময় লাগে। যখন তারা বুঝতে পারে শরীরের উপরিভাগে এই পরীক্ষাটি খুবই সহজ তখন নিজেরাই পরীক্ষা করে। ক্যান্সারের ডাটাবেজ তৈরি করেন ডাঃ আশ্বিন মহাদেভন। বললেন, পিরিয়ড (মিনিস্ট্রেশন) শুরু হওয়া কিশোরী থেকে যে কোন বয়সী নারী নিজেই এই পরীক্ষা করতে পারে। প্রতিমাসে অন্তত একবার নিজেই এই পরীক্ষা করা ভাল। তবে তা করতে হবে পিরিয়ড শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর। কারণ এই সময়ে ব্রেস্ট নরম থাকে। মেয়েরা আয়নার সামেন দাঁড়িয়ে ব্রেস্টের রং চকচকে, নিপলের পরিবর্তন দেখেও আঁচ করতে পারেন। তারপর পরীক্ষা করতে হয় এভাবে- মেয়েদের গলার নিচে ও দুই বগলের নিচ থেকে ডান ও বায়ের দুই ব্রেস্টের সম্পূর্ণ এরিয়ায় (অংশ) নিজেই হাতের দুই আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে দেখতে পারে ভেতরে কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে কিনা। যদি টের পাওয়া যায় ছোট বা বড় গোটার মতো শক্ত বা কোন দানাদার কিছু তখন পরবর্তী পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ব্রেস্টের ভেতরে গোটার মতো কিছু মনে হলেই তা যে ক্যান্সার তাও ঠিক নয়। অন্য কারণে এমনটি হতে পারে। তবে এ অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দেখানোই ভাল। চিকিৎসক প্রাথমিক পর্যায়ে একটি সুচের মাধ্যমেও বায়োপসি পরীক্ষা করতে পারেন। যদি প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পরে তা দ্রুত সারিয়ে তোলা যায়। তারা লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারীর ক্যান্সার শনাক্ত হয় তৃতীয় অথবা চতুর্থ পর্যায়ে। যখন ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পরে। সুস্মিতা খান জানালেন, এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ ক্যান্সার। যার ৬০ শতাংশই ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী সহজেই ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। এ জন্য প্রথমেই দরকার নারীদের ঘরে বসে পরীক্ষার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া। রিচিং দ্য আনরিচড মেডিক্যাল ভিশন প্রকল্পটি গত বছর থেকে বাংলাদেশে ঘুরে ঘুরে নারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে। মার্কিন এই টিমটি বগুড়া টিএমএসএস মেডিক্যাল কলেজে ৫ দিনের জন্য এসেছে বৃহস্পতিবার। শুক্রবার তাদের সঙ্গে কথা হয়। প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে ৫টি করে ব্যাচে দুই শিফটে ৩শ’ মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ও নার্সদের প্রশিক্ষিত করছে। এই প্রশিক্ষিতরা তাদের পরিবারের সদস্য আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী পরিচিতজন বন্ধু-বান্ধবদের ঘরে বসে ব্রেস্ট পরীক্ষা শিখিয়ে দেবে। টিমের লিডার ডাঃ এলিজাবেথ ম্যাকলিওনের সঙ্গে আছেন পামেলা উইলিয়াম। তিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির বিছানায় টানা শুয়ে থেকে পিঠে ঘা (সোর) কমাতে কি করতে হবে। ডাঃ জেনিন গোরহান ও কেসি ফিল্ডরুক রোগের প্রাথমিক পরিচর্যা শেখাচ্ছেন। গাইনি ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সার্জন ডাঃ বিল কাটজ, ডাঃ অরুল মহাদেভন, স্বপ্নিকা মালিপেডি নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রশিক্ষিত করছেন। কয়েকটি ক্লাস্টারে এই প্রশিক্ষণ চলছে। এর মধ্যে আছে আগুনে পোড়া, ক্ষতের সৃষ্টি হওয়া, হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ), ডায়াবেটিস, নিজে নিজে ব্রেস্ট পরীক্ষা, ক্লান্তি অবসাদে যা করণীয় ইত্যাদি। পামেলা উইলিয়াম বললেন সাধারণত নার্সদের ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সেবা দিতে হয়। এই কাজে ক্লান্তি অবসাদ দূর করাও দরকার। কিভাবে তা সম্ভব তাও জানানো হচ্ছে। বিষয়গুলো জেনে উপকৃত হয়েছেন এবং অন্যদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন এমন কয়েকজন- ডাঃ মনোয়ারা, ডাঃ মনিরা বারী, ডাঃ সুলতানা জাহানের কথা: ব্রেস্ট ক্যান্সার হচ্ছে কি না তা নারী নিজেই বুঝতে পারে এমন সহজ পরীক্ষা থাকার পরও শুধু লজ্জার কারণে নারীরা প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারছে না। এই লজ্জা দূর করার এখনই সময়। প্রজন্মের তরুণীদের এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে মা বোনসহ পরিবারের নারী স্বজনদের এগিয়ে আসা দরকার।
×