ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরেছেন আরও তিনজন বিমানবন্দরে কান্নার রোল

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৭ মার্চ ২০১৮

ফিরেছেন আরও তিনজন বিমানবন্দরে কান্নার রোল

আজাদ সুলায়মান ॥ ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত বাংলাদেশীদের মধ্যে শুক্রবার তিনজন ঢাকায় ফিরেছেন। তারা হলেন- মেহেদী হাসান ও তার স্ত্রী সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা এবং মেহেদির ভাবি আলমুন নাহার এ্যানি। বিকেল সাড়ে তিনটায় তারা বিমানের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ ছাড়া নেপালে আহতদের মধ্যে ইয়াকুব আলী ও ইমরানা কবীর হাসিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আপাতত তাদের কাঠমান্ডুতেই রেখে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাদের সেখানেই রাখা হচ্ছে। কাঠমান্ডুতে শুক্রবার আরও তিনজন দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে তারা আকাশ পথের চেয়ে স্থলপথে ফিরতে চান। শুক্রবার যারা ফিরেছেন তাদের বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটে রিসিভ করেন তাদের বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনরা। তারা হলেন- মেহেদী হাসানের বাবা তোফাজ্জল হোসেন, স্বর্ণার বাবা সৈয়দ আবুল হাসান, চাচি পারভিন আক্তার, মামি রাশিদা আক্তার ও বোন জুঁই। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েও তারা ফিরে আসায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। স্বর্ণার বাবা মেয়েকে জড়িয়ে অঝোরে শিশুর মতো কেঁদেছেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল। বিমানবন্দর থেকে বিকেলেই তাদের নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল বার্ন ইউনিটে। জানা গেছে, বাংলাদেশে নিয়ে আসা আহত শেহরিন আহমেদসহ মোট চারজন বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত নিয়ে আসার অনাপত্তি দিয়েছে কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ (কেএমসি)। তাদের মধ্যে থেকে বৃহস্পতিবার শেহরিন আহমেদকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এদিকে মেহেদী হাসান ও কামরুন্নাহার স্বর্ণার সঙ্গে আহত আলমুন নাহার এ্যানিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও তাকে রেখে আসতে হচ্ছে স্বামী ও সন্তানকে। কারণ তারা আর জীবিত নন। বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে তাদের এখন ঠাঁই পেয়েছেন নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি (টিইউ) টিচিং হাসপাতালের হিম ঘরে। ইউএস-বাংলার বিমানে গাজীপুরের শ্রীপুরের নগরহাওলা গ্রামের ফারুক ও মেহেদী হাসানের পরিবারের পাঁচ সদস্য ছিলেন। বিমানে থাকা দুই দম্পতির পাঁচ সদস্য হলেন- নগরহাওলা গ্রামের মৃত শরাফত আলীর ছেলে ফারুক আহমেদ (৩২) ও তার স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি (২৫) এবং তাদের একমাত্র সন্তান প্রেয়সী (৩)। এছাড়া নগরহাওলা গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মেহেদী হাসান (৩৩) ও তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা (২৫)। তাদের মধ্যে মেহেদী হাসান ও তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা বেঁচে আছেন। এছাড়া আলমুন নাহার এ্যানি নিজের জীবন ফিরে পেলেও হারিয়েছেন স্বামী ফারুক আহমেদ ও তাদের একমাত্র সন্তান প্রেয়সীকে। মেহেদী, স্বর্ণা, নাহার ও শেহরিনের বিষয়ে শুক্রবার কাঠমান্ডু মেডিক্যাল কলেজ (কেএমসি) কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিতে অনাপত্তি দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক কাঠমান্ডু সময় দুপুর দেড়টায় তাদের বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০০৭২ ফ্লাইটে তুলে দেয়া হয়। ফ্লাইটে তাদের তিনজনের সঙ্গে স্বর্ণার মা মোসাম্মৎ সালমাও ছিলেন।। কেএমসি হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও বিমান দুর্ঘটনার রোগীদের কো-অর্ডিনেটর ড. রাজিব রাজ মানান্দার আগের দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘স্বর্ণার পরিবারের ৩ জন বিমানে ভ্রমণ করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে স্বর্ণা বিমানে উঠতে খুব ভয় পাচ্ছে। তিনি সড়কপথে বাংলাদেশে ফিরতে চাইছেন। আমরা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, তার শরীরের অবস্থা সড়কপথে ভ্রমণের উপযোগী নয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশী ইমরানা কবির (৩০) এবং কবির হোসেনের (৫২) অবস্থা ভাল নয় বলে জানান তিনি। ইউএস-বাংলার জিএম কামরুল ইসলাম বলেন, ফেরত আসা মেহেদী হাসান, কামরুন্নাহার স্বর্ণা ও আলমুন নাহার এ্যানিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। সেই সঙ্গে তাদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করবে ইউএস-বাংলা। এদিকে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস আহত বাংলাদেশীদের পরিদর্শন শেষে কেএমসি-তে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন- আহত ইয়াকুব আলীকেও নেপাল থেকে স্থানান্তর করা হচ্ছে না। নেপালে তার যে চিকিৎসা হচ্ছে অন্য দেশেও একই চিকিৎসা হবে। তাই নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইয়াকুব আলীকে সরানো হবে না। ইমরানা কবীর হাসির দেবর সামির বলেন- ভাবিকে নেপালের হাসপাতাল থেকে স্থানান্তরের অনুমতি দেয়নি মেডিক্যাল টিম। তার অবস্থা এখনও সঙ্কটাপন্ন। তাই এখন সরানো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেয়েছিলাম ভাবিকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে দিল্লীতে নিতে। কিন্তু তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল ও আনস্টেবল হওয়ায় মেডিক্যাল টিম সায় দিচ্ছে না। কাঠমান্ডু গেলেন আরও তিন স্বজন ॥ এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশী দুই যাত্রীর তিন স্বজনকে নেপালের কাঠমান্ডু পাঠানো হয়েছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের তত্ত্বাবধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শুক্রবার তারা কাঠমান্ডু যান। ইউএস-বাংলার জিএম কামরুল ইসলাম বলেন, বিধ্বস্ত বিমানের নিহত যাত্রী পিয়াস রায়ের বাবা সোহেন্দু বিশ্বাস রায় এবং বিলকিস আরার ভাই মাসুদ ও তার স্বামীকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে শুক্রবার কাঠমান্ডু পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা’র একটি বিমান ৬৭ যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ জন নিহত হন। এর মধ্যে ২৬ বাংলাদেশী। ১০ বাংলাদেশী আহত হন। ইউএস বাংলাদেশের বিমান আহত ১০ বাংলাদেশীর মধ্যে সাতজনকে অনাপত্তিপত্র দেয়া হয়। তাদের একজনকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে নেপাল থেকে শেহরিন আহমেদ বৃহস্পতিবার ঢাকায় পৌঁছান। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তিনজনের কেউই শঙ্কামুক্ত নয়- ডাঃ সামন্ত লাল ॥ তিনজনের কেউই শঙ্কামুক্ত নয়। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। শনিবার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। যখন তাদের হাসপাতাল থেকে সুস্থ করে ছেড়ে দিতে পারব, তখন বলব শঙ্কামুক্ত। শুক্রবার বিকেলে তিনজনকে ঢামেকে আনার পর এমনটাই বললেন বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত একই পরিবারের তিনজনকে শুক্রবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে হজরত শাহজালাল (র.) বিমানবন্দর থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের কেবিনে নেয়া হয়েছে। আহত তিনজন হলেন, একই পরিবারের স্বর্ণা, মেহেদি ও এ্যানি। সামন্ত লাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাদের চিকিৎসার বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছেন। কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে যেকোন সময়ে তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নেপাল থেকে জানানো হয়েছে, আরও তিনজনকে পাঠানো প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আগামী রবিবার আরও তিনজনকে ঢাকায় আনা হবে। ওইদিন মেডিক্যাল বোর্ড বসবে। এছাড়া নেপালে আরও দুইজন থাকবে। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অন্য আরেকজনকে তাদের স্বজনরা সিঙ্গাপুরে নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। তিনজনের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনজনের কেউই পুড়ে যায়নি। এদের বিভিন্নস্থানে আঘাত লেগেছে। এদের মধ্যে এ্যানির পায়ে আঘাত আছে। সে মানসিকভাবেই একটু অসুস্থ। এ্যানির বুকে কালো ধোঁয়া প্রবেশ করেছে। কাশিতে কালো কফ আসছে। তার মানসিক চিকিৎসার জন্য একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ ডাকা হবে। স্বর্ণার এফডোমিনে আঘাত পেয়েছে। মেহেদির হাতে ও পায়ে আঘাত লেগেছে। তিনি বলেন, তাদের দেখে মনে হয়েছে, তারা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছে। এদের সুস্থ হতে সময় লাগলেও একসময় ঠিক হয়ে যাবে। তাদের সুস্থ হতে ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে। এ্যানির স্বামীর বন্ধু ইজাজ আহমেদ। তিনি দুর্ঘটনার পর নেপালে যান। তাদের সঙ্গে আবার আসেন। এই দুর্ঘটনায় এ্যানির মেয়ে ও স্বামী মারা গেছে। এজাজ জানান, বার বার এ্যানি তার স্বামী আর মেয়ের কথা জানতে চাইছে। তাকে বলা হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। তারা যে মারা গেছেন তা তাকে জানানো হয়নি।
×