ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

নগরায়ণ বদলে দিচ্ছে গরিব বিশ্বের কৃষি

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৮ মার্চ ২০১৮

নগরায়ণ বদলে দিচ্ছে গরিব বিশ্বের কৃষি

বাংলাদেশের একটি গ্রাম মাথাবাড়ি। এর গোটা দৃশ্যপট বদলে গেছে। ২০ বছর আগে প্রথমটি ছিল ধানী এলাকা। মাঠের পর মাঠজুড়ে শোভা পেত উজ্জ্বল সবুজ ধানক্ষেত। এখন বেশিরভাগ জমি পানিতে ছেয়ে আছে। পুকুরের পর পুকুর। সেগুলো মাটির বাঁধ দিয়ে আলাদা করা। পুকুরে চাষ হচ্ছে কার্প, পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া। খ- খ- কিছু শুকনো জমি অবশ্য চোখে পড়বে। তবে, সেগুলোতে লম্বা লম্বা শেড আছে। পোলট্রির শেড। মুরগি পালন করা হচ্ছে ওগুলোতে। মাথাবাড়িতে মাছ চাষ শুরু করা প্রথম খামারগুলোর অন্যতম সোহেল মৎস্য খামার। এটি একটি আধুনিক খামার, ৭০ একর জমি নিয়ে এই খামার। পানিতে অক্সিজেনের সরবরাহ রাখতে বিদ্যুত চালিত প্যাডেল হুইল আছে। মাছের খাবার তৈরি করতে ফিড মিল আছে। খামারের মালিক ২০০২ সাল থেকে এখানে মৎস্য চাষ শুরু করেন। আস্তে আস্তে জায়গা বাড়ান। প্রথমদিকে খামারের প্রতি একর থেকে মাছ পাওয়া যেত প্রায় ৪০ টন। এখন চাষের উন্নত কৌশলের কারণে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৪০ টন। মাছ চুরি যাওয়া আগে একটা সমস্যা ছিল। এখন নেই। মাছ এত বেশি পাওয়া যাচ্ছে এবং দামও এত সস্তা যে চুরির কথা কেউ ভাবে না। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের খামারিরা ২২ লাখ টন মাছ উৎপাদন করেছিল। জেলেরা নদীÑখালে-বিলে-সাগরে যে পরিমাণ মাছ ধরে এটা আরও বেশি। আর চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম বাদে অন্য যে কোন দেশের মৎস্য খামারিদের উৎপাদিত মাছের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের মৎস্য খামার শিল্পের আকার ২০০৮ সালে যা ছিল তার তুলনায় এখন দ্বিগুণ হয়েছে এবং ১৯৮৪ সালের তুলনায় ১৯ গুণ বেড়েছে। মাছের চাষের এই ব্যাপক প্রসারের পেছনে অনেক কারণ আছে। তবে প্রধান কারণটা নগরায়নের প্রসার। কৃষি কাজ ও নগরায়ন দুইটি পৃথক মেরু। নগরায়নের প্রসার গ্রাস করে নেয় আবাদি জমি। তবে নগরায়ন চাষাবাদের রূপান্তরও ঘটিয়ে দিতে পারে। শহরের ভোক্তারা খাদ্যের এক ক্রমবর্ধমান বিশাল বাজার। এমনকি সেটা দেশের রফতানি বাজারের চেয়েও বড় হতে পারে। শহরবাসীর খাদ্য চাহিদার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। গ্রামবাসীর তুলনায় শহরবাসীর হাতে টাকার পরিমাণ বেশি। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য তাদের লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। তাই তারা দ্রুত রান্না করা যায় এমন মুখরোচক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি পছন্দ করে। তাদের ক্ষুধা মেটানো এক বিশাল কাজ। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এশীয় মৎস্য বিশেষজ্ঞ বেন বেলটনের হিসেবে বাংলাদেশের খামারজাত মাছের ৯৪ শতাংশ দেশের মানুষেরই খাওয়ার কাজে লাগে। জ্যান্ত ও মৃত এসব মাছ ট্রাকে করে বিশেষ ব্যবস্থায় শহরগুলোতে আনা হয়। বাংলাদেশের শহরবাসী গ্রামবাসীদের তুলনায় মাথাপিছু এক- তৃতীয়াংশ বেশি মাছ খায়। রাজধানী ঢাকাতেই তো দুই কোটি লোকের বাস। জাতিসংঘের হিসাবে এই নগরীর লোকসংখ্যা বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি করে বাড়ছে। তেমনি বাড়ছে এই নগরীর মাছের চাহিদা। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাছ তথা প্রোটিনের চাহিদা কিন্তু সরকার মেটাচ্ছে না, সাহায্য সংস্থা বা বিদেশী কৃষি বিনিয়োগকারীরাও মেটাচ্ছে না। মেটাচ্ছে সাধারণ বাংলাদেশীরা। মাছের খামারের সঙ্গে শুধু মৎস্য চাষীরাই জড়িয়ে আছে তা নয়, আছে মাছের খাবার ব্যবসায়ী, ফিশ ফিড মিলের মালিক, হ্যাচারির মালিক ও তাদের কর্মচারী। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ফিশ ফিডের ডিলারের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তেমনি বেড়েছে ফিড মিল ও হ্যাচারির সংখ্যা। ভারত ও মিয়ানমারেও একই ধারা লক্ষ্য করা যায়। মৎস্য চাষ ঢাকার চারপাশের বিশাল এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে দেয়া ছাড়াও অনেক মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। একর প্রতি ধানচাষে যে পরিমাণ শ্রম দরকার তার দ্বিগুণ পরিমাণ শ্রম লাগে মৎস্য চাষে এবং এতে শ্রমের চাহিদা থাকে সারা বছর। অনেক শ্রমিক যারা দিনে কাজ করে দিনে আয় করত তারা এখন এক টানা মাসের পর মাস বেতনের ভিত্তিতে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশের কোন কোন ধান আবাদি এলাকায় মৌসুমী অভাব জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য হলেও জলাশয় বহুল জেলাগুলোতে এই অভাব অনেক কম। মৎস্য চাষীরা শহরবাসীর আমিষের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করছে বটে, তবে উৎপাদক পর্যায়ের লোকেরা নানা ধরনের সমস্যা কবলিত। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি তার একটি কারণ। বাজারে অতি সরবরাহেরও একটা সমস্যা আছে যে কারণে মাছের দাম আগের চাইতে কমেছে। উৎপাদক পর্যায়ের এই সমস্যা বাংলাদেশের একার নয়। এশিয়ায় যেমন মৎস্য চাষে জোয়ার এসেছে তেমনি আফ্রিকায় এসেছে পোলট্রি শিল্পের জোয়ার। এ ব্যাপারে নাইজিরিয়া একটা দৃষ্টান্ত। সেদেশে মাঝারি ও বড় পোলট্রি ফার্মের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজার। অথচ ১৯৯০-এর দশক ও ২০০০ এর দশকের বেশিরভাগ সময় এই সংখ্যা ছিল ৪শ’র মতো। পোলট্রির প্রসারের ফলে মুরগির খাবার ভুট্টার ব্যবহার বেড়ে গেছে। ২০০৩ সালে ভুট্টা লাগত ৩ লাখ টন। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ টনে। পোলট্রি শিল্পের প্রসার মন্থর হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। তারপরও নাইজিরীয়রা গড়ে বছরে মাত্র ২টি মুরগি খায়। কিছু কিছু দিক দিয়ে এশিয়ার মৎস্য শিল্পের প্রসারের সঙ্গে পশ্চিম আফ্রিকার পোলট্রি শিল্পের প্রসারের পার্থক্য আছে। এশিয়ার মৎস্য খামারিরা প্রায় ক্ষেত্রেই আগে ছিল ধানচাষী। আফ্রিকার পোলট্রি খামারিরাও প্রায় ক্ষেত্রেই আগে ছিল ধানচাষী। কিন্তু আফ্রিকার পোলট্রি খামারিরা প্রায় ক্ষেত্রেই বিত্তশালী ও প্রভাবশালী শহুরে লোকজন। এওডি ফার্ম নামে এক বিশাল পোলট্রি খামারের মালিক এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নাইজিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ওয়াসানজোর বড় পোলট্রি ব্যবসা আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। বিদেশী বিনিয়োগও আছে এই শিল্পে। সিঙ্গাপুর তালিকাভুক্ত একটি বহুজাতিক কৃষি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত সেপ্টেম্বর নাইজিরিয়ায় দুটি বিশাল ফিড মিল খুলেছে যার একটিতে মাছের খাবারও তৈরি হয়। তবে এশিয়ার মৎস্য খামারের সঙ্গে আফ্রিকার পোলট্রি শিল্পের পার্থক্যের চাইতে সাদৃশ্যটাই বেশি লক্ষণীয়। বাংলাদেশের মৎস্য খামারের মতো নাইজিরিয়ার পোলট্রি শিল্প দ্রুত বর্ধিষ্ণু সর্ববৃহৎ নগরীর চারপাশে গজিয়ে উঠেছে। নাইজিরিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী লাগোসের অধিবাসীর সংখ্যা সোয়া কোটি থেকে দেড় কোটি। লাগোস থেকে মোটরে ২ ঘণ্টার দূরত্ব ওগেরে। সেখানে আছে এওডি ফার্ম। এই খামারের ৭০ ভাগ চালান ট্রাকে করে চলে যায় লাগোসে। বাংলাদেশ ও নাইজিরিয়া দু’দেশেই মৎস্য ও পোলট্রি শিল্পের মালিকরা অধিকতর পেশাদার হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশী মৎস্য খামারিরা ক্রমবর্ধমান হারে ভাসমান ফিশ ফিড ও ওষুধ ব্যবহার করছে। নাইজিরিয়ার পোলট্রি ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে পিলেট ও ওষুধ। চূড়ান্ত সাদৃশ্যটা হলো নাইজিরিয়া ও বাংলাদেশ উভয়ের খামারিরাই বাজারে অতি সরবরাহের তীব্র অভিযোগ করে থাকেন। নাইজিরিয়ার পোলট্রি খামারিদের অভিযোগ, দেশীয় বাজার বিদেশী বিনিয়োগকারী ও বিদেশী মুরগিতে সয়লাব হয়ে গেছে। নাইজিরিয়ার পোলট্রি সমিতি জানিয়েছে দেশে যত পোলট্রি খাওয়া হয় তা প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে বেআইনীভাবে আমদানি করা। অবশ্য এমএস লিভারপুল টাসি নামে এক কোম্পানি এই বক্তব্য খ-ন করে বলেছে যে, আমদানি হয় মাত্র ১৫ শতাংশ পোলট্রি। খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণেই সম্ভবত মুরগি খামারিদের মুনাফার অঙ্ক বেশ কমে যায়। পোলট্রি ও মৎস্য খামারিরা যে ধনী দেশগুলোতে তাদের উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে বাড়তি মুনাফা করবে সেটাও শুধু প্রত্যয়ন ব্যবস্থার অভাবের কারণে। ধনী দেশগুলোর ক্রেতারা মৎস্য বা মুরগির খাবার কোথা থেকে আসে ও কিভাবে তৈরি করা হয় তা জানতে চায়। এ ব্যাপারে আদর্শ কোন মান না থাকায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। অভিযোগ আছে, মাছ ও মুরগিকে যে খাবার খাওয়ানো হয় তাতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকে। নানাবিধ চাপের কারণে খামারিরা উদ্ভাবনশীল হয়ে উঠছে। ময়মনসিংহ শহরের এক পণ্যাগারে শামসুল আলম নামে এক খামারি আটটি বড় বড় চৌবাচ্চা স্থাপন করেছেন। সেখানে তিনি চাষ করছেন শিং ও মাগুর মাছ। পুকুরে প্রতি কিলো পাঙ্গাশ মাছ চাষ করে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায় তার চারগুণ পাওয়া যায় শিং-মাগুর চাষ করে। আলম তার চৌবাচ্চার পানি পরিষ্কার করেন কানাডা থেকে আনা মেশিন দিয়ে। ঘরের ভেতর মাছ চাষের এই কৌশলটি। কারিগরি দিক দিয়ে জটিল ও ব্যয়বহুল। তথাপি, এটা বেশিরভাগ প্রচলিত মাছের টানা কম দাম সমস্যা মোকাবেলারও একটা উপায়। সূত্র : টাইম
×