ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

অভিমত ॥ অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৮ মার্চ ২০১৮

অভিমত ॥ অগ্নিঝরা মার্চ

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেসব রাজনীতিবিদ জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে তাদের অনেকেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের ভিন্নতর প্রত্যাশা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। এমনই পরিস্থিতিতে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিচিত ও প্রবীণ নেতাদের ভিড়ে যে ক’জন নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, স্বল্প সময়ে সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ হিসেবে যাঁর নাম এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সংগ্রামী ও সাহসী নেতৃত্বের ‘ইমেজ’ নিয়ে যিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র, তিনিই হলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনের এক বিশাল অংশ কেটে যায় ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে, পরাধীন ভারতবর্ষে। তারপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৪ বছর কেটে যায় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার মানুষের এবং বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। ১৯৭১ সালের মার্র্চের ১ তারিখে আকস্মিক এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দল-মত-নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ, প্রতিটি বাঙালী গণঅভ্যুত্থানে শামিল হয়ে পড়ে। শহর, নগর, বন্দরে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত, বিক্ষুব্ধ মিছিলের দৃপ্ত পদভারে পাকিস্তানের ভিত কেঁপে ওঠে। বাঙালী জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কী নির্দেশ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে। সেখান থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নতুন এক অভিযাত্রা। ৭ মার্চ নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভে উত্তাল রেসকোর্সের লাখো জনতার সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। হৃদয়ে তাঁর বাঙালীর হাজার বছরের লালিত আকাক্সক্ষা স্বাধীনতা। এদিকে চলছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর দমন পীড়ন ও নির্যাতন। এমনি এক সংকটাপন্ন অবস্থায় তিনি ১৮ মিনিটের হৃদয়ছোয়া সংক্ষিপ্ত অথচ মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন। অসাধারণ এ বক্তব্য যেমনি সারগর্ভ, যুক্তিযুক্ত তেমনি তির্যক ও দিক-নির্দেশনাপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালীদের অবস্থান ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালীদের বিরোধের স্বরূপ তুলে ধরা, শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচী ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম, শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যেকোন উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে ঘোষণা করেন- ‘ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দলিল যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণোদনাময়ী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হলো। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লক্ষ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোনসহ আমাদের সকলের জন্য এটি এক মহাআনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলেই জানেন এবং বোঝেন আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ এরপর পাকিস্তানী শাসনামলের ২৩ বছরে বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস, বাংলার মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ’৫৮-এর সামরিক শাসন ’৬৬-এর ছয় দফা ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণেই। তাইতো এই ভাষণ হৃদয় ছুঁয়েছে, মর্মে মর্মে অনুরণিত হয়েছে ৭ কোটি বাঙালীর। এ ভাষণ বাঙালীর জাতীয় জীবনে যে জাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটে এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×