ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৮ মার্চ ২০১৮

মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে

‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কি আর মৃত্যুদিনই বা কি? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনো মহিমা। যখনি কারো ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের জীবনের কোনো নিরাপত্তাই তারা রাখেনি। জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কি? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক।’ ১৭ মার্চ ১৯৭১, বুধবার ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু যখন তার বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করছিলেন তখন একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। তবে ৫৩তম নয়। পত্রিকায় ভুল ছাপা হয়েছে, আজ আমার ৫২তম জন্মদিন।’ জনৈক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন। জন্মদিনের উৎসবের কোনো অনুষ্ঠান আজ আপনার হয়নি? মোমবাতি জ¦ালিয়ে জন্মদিনের কেক সাজানো হয়নি? আপনি একেক করে সেই মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলার পর শুভেচ্ছা জানিয়ে কেউ গান গেয়ে ওঠেনি? বঙ্গবন্ধু বললেন, “জন্মদিনের উৎসব! আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করিনি। আমার এই দুঃখিনী বাংলায়...” যখন এ কথাগুলো বলছিলেন আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছিল। বিদেশি সাংবাদিকরা এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৫২তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানালে তিনি বলেন, ‘১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ আমার জন্মদিন। আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখনও তাদের মরতে হয়।’ গভীর দীর্ঘনিঃশ^াস ত্যাগ করে শেখ মুজিব আরও বলেন, ‘আমার আবার জন্মদিন কি, মৃত্যু দিবসই বা কি? আমার জীবনই বা কি? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।’ পরে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে এক ঘরোয়া সাক্ষাৎকালে শেখ মুজিব বলেন, ‘সাত কোটি মানুষ যখন পাহাড়ের মত আমার এবং আমার দলের পশ্চাতে একতাবদ্ধ হয়েছে, তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কে হতে পারে?’ প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ-আলোচনায় তার (শেখ মুজিব) মন ভার হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমার মন ভার হতেই পারে না। জনসাধারণেরও মন ভার হয় নি। তারা লক্ষ্য অর্জনের জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ বঙ্গবন্ধুর গৃহে গতকাল (১৭ মার্চ, ১৯৭১) জন্মদিনের উৎসব পালিত হয়নি। কিন্তু জনগণ তাকে জানাতে গেছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অনেকে সাথে করে নিয়ে গেছেন শুভেচ্ছা সামগ্রী। শুধু তাই নয়, প্রিয় সংগ্রামী নেতার মঙ্গলময় জীবন কামনা করে শহরের বিভিন্ন স্থানে দোয়া-খায়ের হয়েছে। প্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে শুভেচ্ছা বাণী। নিখিল পাকিস্তান ইসলামী পরিষদের উদ্যোগে গতকাল বায়তুল মোকাররমে আছর নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবসে গতকাল বুধবার স্থানীয় একটি গ্রামোফোন রেকর্ড প্রতিষ্ঠান গত ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রেসকোর্সের ভাষণের রেকর্ড বের করেছে। ঢাকা রেকর্ডের জনাব সালাহউদ্দিন ও নবনির্বাচিত এমএনএ জনাব আবুল খায়ের বাজারে রেকর্ড ছাড়া উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটি রেকর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন। পরদিন ১৮ মার্চের ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘আমি জন্মদিনের উৎসব পালন করি না : এই দুঃখিনী বাংলায় জন্মের আজ নেই কোন মহিমা’। সেই প্রতিবেদন থেকে কিছুটা অংশ এখানে উপস্থাপন করা হলো। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমায় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এই শেখ মুজিবের জন্ম। রাম জন্মের আগে যেমন রামায়ণ লেখা হয়েছিল তেমনি বাঙালি জাতির দিশারী হিসেবে জন্ম নিয়েছিল তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮০ বছর বয়সে লিখেছিলেন ‘সভ্যতার সংকট’। ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে।’ ব্রিটিশ শাসনে বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের মনোযন্ত্রণার ভীষণ কারণ ছিল। কিন্তু তিনি আশা ছেড়ে তবু আশা রেখে দিয়েছিলেন। বাঙালি জাতির এক ভবিষ্যৎ নেতাকে দেখেছিলেন। ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ^াসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। যদি বলি সেই পরিত্রাণ কর্তার নাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান’।’ চল্লিশের দশকে একজন মনিষী এসএম ওয়াজেদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের এমন একটা অজপাড়াগাঁয়ে তিনি জন্মাবেন। বাঙালি জাতিকে মুক্ত করে ছাড়বেন। যিনি সবাইকে মুক্ত করবার জন্যে জন্মালেন। তিনি তো কখনই শান্তিতে থাকতে পারেন নি।’ ‘ছেলেমেয়েদের জন্যে যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ আমরা লক্ষ্য করি টুঙ্গিপাড়ার বালক খোকা পরিবারের চেয়ে প্রতিবেশীর কথা, নিজের চেয়ে সহপাঠীদের প্রয়োজন নিয়ে ভাবে বেশি। আর পরিণত বয়সে সমগ্র জাতির জন্যে ভাবনা-চিন্তা। শেখ মুজিবই হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতিসত্তার এক মহান নির্মাতা। এই জন্যেই বোধহয় ইউরোপিয়ানরা বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করে থাকে ‘ফাউন্ডিং ফাদার অব্ দ্য নেশন’। বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাতা তিনিই। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল তার ‘ধূমকেতু’র পথে’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের সকলের মধ্যে নিরন্তর এই ফাঁকির লীলা চলেছে। আর বাঙলা হয়ে পড়েছে ফাঁকির বৃন্দাবন। কর্ম চাই সত্য, কিন্তু কর্মে নামবার বা নামাবার আগে এই শিক্ষাটুকু ছেলেদের, লোকদের রীতিমত দিতে হবে যে, তারা যেন নিজেকে ফাঁকি দিতে না শেখে, আত্মপ্রবঞ্চনা করে নিজেকেই পীড়িত করে না তোলে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এই সন্তান কাজী নজরুলের মতো বুঝতেন ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুটলী বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না।’ ১৮ মার্চে ১৯৭১ ‘দৈনিক আজাদ’-এর ৫৩তম (সেই দিনের পত্রিকায় ভুল লেখা ছিল) জন্মদিবসে বঙ্গবন্ধু ‘আমি তোমাদেরই লোক’Ñ ‘গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে আমি যখন শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে প্রবেশ করি, তখন তাহার মুখে রবীন্দ্রকাব্যের উপরোক্ত চরণ কয়টি ঘুরিয়া ফিরিয়া বারবার উচ্চারিত হইতেছিল। গতকাল ছিল শেখ মুজিবের তেপ্পান্নতম জন্মদিন। কিন্তু এই জন্ম বত্রিশ নম্বর রোডের কালো পতাকা শোভিত এই বাড়িতে ছিল না কোনো বিশেষ আয়োজন। শেখ মুজিবের কথায়, ‘বাংলাদেশের মানুষের জন্মদিনই বা কি, আর মৃত্যুদিনই বা কি! যখন কেহ তাহাদের মারিতে উদ্ধত হয়, তখন তাহারা মরে। আর আমি তো সেই জনগণেরই একজন’।’ জন্মদিবস সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকদের নিকট এ রকম মনোভাব প্রকাশের পাশাপাশি ভক্ত-অনুরাগীদের বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জন্মদিবসের একমাত্র বক্তব্য- লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলিতে থাকিবে। সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। জয় আমাদের অনিবার্য।’ শেখ মুজিবের মুখে এই সংগ্রামের আহ্বান ও বিজয়ের বাণীই গতকাল মুখ্য হইয়া উঠে। আর এই বাণী শোনার প্রস্তুতি লইয়াই গতকাল কেহ বা ফুলের তোড়া, কেহ বা কেক লইয়া প্রিয় নেতার বাসভবনে ভিড় জমায়। একপর্যায়ে জনৈক ছাত্রনেতাকে সঙ্গীদের বলিতে শুনি, ‘জন্মদিনে সবাই তো ফুল কিংবা শুভেচ্ছা লইয়া আসিতেছে। আমরা নেতাকে কি দিব? হাতবোমা না রিভলবার?’ নেতার জন্মদিনে শ্রমিকরাও আসিয়াছে মিছিলের মুখে শুভেচ্ছার ডালি লইয়া। বিনিময়ে নেতার নিকট হইতে পাইয়াছে একই সংগ্রামী আহ্বান। শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে উদ্দীপক বক্তৃতাদানের পর শেখ মুজিব লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে আবার যখন ‘লনে’ শুভানুধ্যায়ীদের নিকট ফিরিয়া আসেন, তখনও তাঁহার মুখে ছিল কবিতা- “বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত; যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভুমে রণিবে না ॥” লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×