ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা ॥ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে বাধা কোথায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৮ মার্চ ২০১৮

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা ॥ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে বাধা কোথায়

(শুক্রবারের পর) ‘এর আগে জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ‘.... খতমে নবুয়ত’ ওয়ালারাও প্রকাশ্য জনসভায় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে ‘পাক সার জমিন ...’ লেখার জন্য হুমকি দিয়েছে। মুক্তচিন্তার লেখক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মৌলবাদী ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামী ও তাদের দোসরদের এ ধরনের হুমকি ও বিষোদ্গার দলের ঘাতকদের ভেতর যৌক্তিক কারণেই হত্যার উন্মাদনা সৃষ্টি করছে। এই উন্মাদনার কিছু চিত্র হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসেও বর্ণিত হয়েছে। মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর এ ধরনের জিঘাংসু আচরণ আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করি ১৯৫৩ সালে লাহোরে নিরীহ আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষকে হত্যার ঘটনায়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আরও বৃহত্তর পটভূমিতে আরও পরিকল্পিতভাবে জামায়াতীরা গণহত্যা ও নারী ধর্ষণসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে। আলবদর, আলশামস নামের ঘাতক বাহিনী তৈরি করেছে তাদের তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যার জন্য। ’৭১-এ তারা পরাজিত হয়েছিল। ইসলামের নামে যাবতীয় হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেও জামায়াতীরা তাদের মাতৃ-পিতৃভূমি পাকিস্তানের ভাঙন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধ করতে পারেনি। এ কারণেই ’৭১-এর ত্রিশ বছর পর বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতায় এসে ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে জামায়াতীরা। ‘পাক সার জমিন ....’ উপন্যাসে এই উন্মাদনার অতি সামান্য অংশ বিধৃত হলেও জামায়াতীরা তাতে কী পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয়েছে তার পরিচয় তারা জনসভায় দিয়েছে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দিয়েছে, যার সমাপ্তি ঘটেছে হুমায়ুন আজাদের উপর তাদের হুকুম বরদার ঘাতকদের চাপাতির উপর্যুপরি আঘাত ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়। টেলিভিশনের পর্দায় হুমায়ুন আজাদের রক্তাপ্লুত শরীর দেখে আমাদের ক্রোধ বিশাল আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়েছে, বেদনায় বিদীর্ণ হয়েছে প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষের হৃদয়। ৫৭ বছরের এক অসামান্য প্রতিভাবান লেখক, গবেষক, অধ্যাপক- যার একমাত্র অপরাধ হচ্ছে যে সত্য তিনি জেনেছেন অসংকোচে তা প্রকাশ করেছেন। ‘খালেদা-নিজামীর জোট সরকার কী বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার দায় এড়াতে পারবে? তাকে সামরিক হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে ভেবেছে হুমায়ুন আজাদের পাঠক-শুভাকাক্সক্ষী-জনতার রুদ্ররোষ থেকে তারা পরিত্রাণ পাবে, যেভাবে গত আড়াই বছর ধরে পেয়েছে। হুমায়ুন আজাদের কালজয়ী উপন্যাস ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’-এর মতো তার লেখার অনুরাগী পাঠক ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইন্টারনেটে গত দু’দিনে শত শত উদ্বেগভরা চিঠি পেয়েছি বাঙালী অধ্যুষিত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ‘নিয়ম নেই’ এই এক কথা বলে সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরণাপন্ন হুমায়ুন আজাদকে দেখতে না দিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনাসহ বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যে ধৃষ্টতামূলক আচরণ প্রদর্শন করেছেন তাতে এই সত্যটি আরও স্পষ্ট হয়েছে যারা হামলা করেছে তারা চার দলীয় জোটেরই শরিক। সরকার স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে পারত সঙ্গে সঙ্গে বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়ে এবং প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রচার করে। কোন রকম তদন্তের আগেই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যথারীতি হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন এবং জোট সরকারের অঘোষিত মুখপত্র ‘ইনকিলাব’ খোদ হুমায়ুন আজাদকেই দায়ী করেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারী নির্দেশের দোহাই দিয়ে মুখে তালা দিয়েছেন। পৃথিবীর বহু হাসপাতালে আইসিইউ-তে রাখা গুরুতর অবস্থার রোগীদের বিশেষ ব্যবস্থায় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের যে দেখানও যেতে পারে এটা না জানার মত মূর্খ আমরা নই। প্রধানমন্ত্রী যাবেন না বলে বিরোধী দলের নেতাদের দেখতে দেয়া যাবে নাÑ এ ধৃষ্টতা বাংলাদেশের কোন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের থাকতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে বলেছেন ২৪ ঘণ্টার ভেতর কিছু বলা যাবে না, তারপর বলেছেন ৭২ ঘণ্টার ভেতর কিছু বলা যাবে না, তারপর ধারণা করতে পারি এই সময় দীর্ঘতর হতে থাকবে যদি হুমায়ুন আজাদ চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ হন। সরকার ও সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভাবছেন এভাবেই সময়ের ব্যবধানে হুমায়ুনকেন্দ্রিক ক্ষোভ ও উত্তেজনা প্রশমিত হবে। ‘অথচ আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি এ ক্ষোভ ও বেদনা প্রশমিত হওয়ার নয়। হুমায়ুন আজাদের রক্তাপ্লুত দেহ, মাণিক সাহার বোমাবিদীর্ণ খণ্ড বিখণ্ড শরীর, গোপালকৃষ্ণ মুহুরীর মাথা থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া মগজ এবং এ রকম হাজার হাজার লাশ খালেদা-নিজামীদের রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তাড়া করে ফিরবে। ‘পাঁচ বছর আগে কবি শামসুর রাহমানকে চাইনিজ কুড়াল নিয়ে হত্যা করতে গিয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন হরকতুল জেহাদের ঘাতকরা। কবির স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাধার কারণে ঘাতকরা তাকে হত্যা করতে পারেনি। শামসুর রাহমানের হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ৪৮ জনকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ আমলে ওদের কয়েকজন জামিন নিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, বাকিরা বেরিয়েছে জোট সরকারের জমানায়। হরকাতুল জেহাদ এবং জামায়াতের অন্যান্য সহযোগীরা গত আড়াই বছর ধরে চাপাতি আর চাইনিজ কুড়াল শান দিয়েছে আর নিজামী-সাঈদীরা ’৭১-এর মতো নাম উল্লেখ করে বলেছেন কাদের তারা হত্যার যোগ্য ‘মুরতাদ’ মনে করেন। ‘আওয়ামী লীগ ও এগার দলসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিকে বলবার কথা একটিইÑ আড়াই বছরে কি যথেষ্ট রক্ত ঝরেনি, হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ কি যথেষ্ট পরিমাণে সংঘটিত হয়নি? এখনও তারা কোন রাজনৈতিক বিবেচনায় একজোট হয়ে জোট সরকারের সন্ত্রাস ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছেন না? ‘বেগম খালেদা জিয়াকে বিনীতভাবে শুধু একটি প্রশ্নই করতে চাইÑ আপনার জোট সরকারের রক্ততৃষ্ণা মেটানোর জন্য আর কত হুমায়ুন-মানিক-মুহুরি-ইমাম-জ্ঞানজ্যোতি-রাধারাণী-সুবল-পিরেন-তালামাইদের রক্ত লাগবে?’ (‘বাংলাদেশে আমরা এবং ওরা’, অনন্যা, বইমেলা ২০০৫) বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের ধাত্রীমাতা বেগম খালেদা জিয়া তার সরকারের আমলে যতগুলো মৌলবাদী সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সব কিছুর জন্য আওয়ামী লীগ এবং ভারতকে দায়ী করেছেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে হরকত-উল-জিহাদ ময়মনসিংহের কয়েকটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে বহু মানুষকে হতাহত করেছিল। তারা এর দায় স্বীকার করলেও ঘটনার কয়েক ঘণ্টার ভেতর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক-যুদ্ধাপরাধী অধ্যুষিত জোট সরকার আমাকে ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন সাংবাদিক এবং সাবের হোসেন চৌধুরী ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ের শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছিল। আমাদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছেÑ এই বোমা হামলা আওয়ামী লীগ ও ভারত করেছে, এই মর্মে লিখিত বক্তব্য প্রদানের জন্য। মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে, হরকত-উল-জিহাদের ঘাতকরা মহাউৎসাহে আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ গোটা হাই কমান্ডকে নিশ্চিহ্ন করবার পরিকল্পনা করেছে তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনে বসে। ২০০৮ সালে নির্মিত আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘জিহাদের প্রতিকৃতিতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে জামায়াত, বিএনপি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দল ফ্রিডম পার্টির শীর্ষ নেতারা কীভাবে হামলার পরিকল্পনা করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন হরকত-উল-জিহাদের প্রধান নেতা মুফতি হান্নান। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা করা কেন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ সে কথাও মুফতি হান্নান বলেছেন, যিনি এই লেখকদের কোনো লেখা পড়েননি। হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুর পরও মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের প্রতিহিংসা থেকে মুক্তি পাননি। ২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামের দাবির কারণে পাঠ্যপুস্তক থেকে হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। জামায়াত এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগীরা ইসলামের নামে যে ঘৃণা ও সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটাচ্ছে সমূলে উৎপাটন করা না হলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অস্তিত্ব থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গী দমনে আন্তরিক হলেও জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসের রাজনীতি ও দর্শন নির্মূলে সরকারের আগ্রহ দৃশ্যমান নয়। আমরা গত ২৬ বছর ধরে বলছি, বঙ্গবন্ধুর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করে জামায়াত ও জঙ্গীবাদ নিষিদ্ধ করা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নিষিদ্ধ করা যায়, এমনকি বর্তমান সরকার জাতিসংঘের সহযোগিতায় যে সন্ত্রাস দমন আইন প্রণয়ন করেছে সে আইনেও সাম্প্রতিককালের যাবতীয় সন্ত্রাসের জন্য জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যায়। জাফর ইকবাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য লেখক। হামলার খবর পেয়েই তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত লেখককে দেখতেও গিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের বাধা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা তাঁর সহপাঠী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে কুশল জানার জন্য হেঁটে সামরিক হাসপাতালে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জাফর ইকবালের ওপর হামলার জন্য ধর্মান্ধতাকে দায়ী করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরা বলতে চাই- ধর্মান্ধতা সৃষ্টির যাবতীয় প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ নিরাপদ রেখে কিভাবে আমরা মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনব? হেফাজত বলেছে তারা কওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারী স্বীকৃতি চায় কিন্তু তাদের তামসিকতাপূর্ণ পাঠ্যসূচিতে সরকার নাক গলাতে পারবে না। শুধু হেফাজতের কওমী মাদ্রাসা নয়, সরকারের আলিয়া মাদ্রাসাতেও যে মওদুদীবাদী সন্ত্রাসী দর্শন পড়ানো হয় এ তথ্য আমরা সরকারী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা থেকে জেনেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে হেফাজতের আহমদ শফী কওমী মাদ্রাসার অন্ধত্ব সৃষ্টিকারী পাঠক্রম ও সনদের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন। এই ধর্মান্ধরা এখন দলে দলে সরকারী চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে। প্রশাসন ও রাষ্ট্রে ধর্মান্ধতার অন্ধকার বিস্তার লাভ করছে। গত মাসে (ফেব্রুয়ারি ২০১৮) আমি ভারতের কেরালায় গিয়েছিলাম সেখানকার ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য। অনেকেই জানেন না মহানবীর জীবদ্দশায় তার সাহাবীরা কেরালায় এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। কেরালার ত্রিসুর জেলার কড়ুঙ্গালুরে ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ (চেরামান জুমা মসজিদ) প্রতিষ্ঠা করেছেন সুফী সাধক মালিক দিনার ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে কেরালার উত্তরের জেলা কাসারগড়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন মালিক দিনার মসজিদ, যেখানে তাঁর মাজারও রয়েছে। মালিক দিনার মসজিদ কমিটি ২০০১ সালে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। কেরালা সফরকালে সেখানে সুফী ইসলামের মানবিকতার প্রভাব দেখেছি যা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। মালিক দিনার একাডেমীতে দেখেছি চতুর্থ শ্রেণীতে সমাজ বিজ্ঞানে আইনস্টাইনের জীবনী পড়ানো হচ্ছে। মাদ্রাসার ছাত্ররা জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, কম্পিউটার শিখছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। অথচ আমাদের কওমী মাদ্রাসায় বিজ্ঞান শিক্ষা কিংবা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হারাম। এমনকি সাধারণ বিদ্যালয়ে ডারউইন পড়াবার জন্য স্কুলের শিক্ষককে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ধর্মান্ধতা শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায় না, অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ওহাবি সালাফিবাদের মাধ্যমেও ছড়ায়। হেফাজতিদের বাধার কারণে বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে গঠিত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত বিজ্ঞানসম্মত মানবিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এই কমিশন সুপারিশ করেছিল মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য। বলা হয়েছিল প্রথম পর্যায়ে ৫ম শ্রেণী এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত মাদ্রাসায় সাধারণ পাঠক্রম অনুযায়ী পড়ানো হবে, পৃথক কোন পাঠক্রম থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছিল কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে। হেফাজতের আপত্তির কারণে এসব কিছুই হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে একটি যুগান্তকারী নারীনীতি প্রবর্তন করেছিল যা যুক্তিসঙ্গত কারণে পরবর্তী খালেদা জিয়ার সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। হেফাজতিদের বাধার কারণে ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারীনীতি হিমঘরে পড়ে আছে। অন্যদিকে হেফাজতপ্রধান আহমদ শফীর নারীদের প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক, অশ্লীল ও বিকারগ্রস্ত বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে ধর্মান্ধদের নারী নির্যাতনে উৎসাহিত করছে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে গত ৭ মার্চের আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ উপলক্ষে নারীদের যৌন হয়রানি এবং পাশবিক আচরণের জন্য যারা দায়ী তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে হেফাজতপ্রধানের তেঁতুলতত্ত্বের ফতোয়ায়। জামায়াত-হেফাজতি হুজুরদের ওয়াজের সিংহভাগ থাকে মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিষোদগার এবং নারীদের সম্পর্কে চরম অশ্লীল ও বিকারগ্রস্ত মন্তব্য। তাদের এসব বক্তব্য সমাজে শুধু ধর্মান্ধতা নয়, পাশবিকতা ও উন্মাদনা ছড়াচ্ছে, মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনছে। আমাদের অনেক বলার পরও ওয়াজের নামে এসব সন্ত্রাসী ঘৃণ্য বক্তব্যের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামীর জন্য বিরাট আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে বার্মা থেকে বাংলাদেশে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত গণহত্যার ভিকটিম ৭ লাখের ওপর রোহিঙ্গা বার্মা থেকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে যারা এসেছিল তাদের সংখ্যা যোগ করলে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি। জামায়াত এবং তাদের সহযোগী মৌলবাদীরা তাদের জঙ্গী জিহাদী বলয়ে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার জন্য কিভাবে কাজ করেছে এ নিয়ে গত ২৬ বছর ধরে লিখছি। হালে জামায়াতের ছত্রছায়ায় শতাধিক দেশী-বিদেশী এনজিও ত্রাণসাহায্য প্রদানের নামে রোহিঙ্গাদের ভেতর উগ্র জিহাদী মতবাদ ও ধর্মান্ধতা প্রচার করছে। শিক্ষার নামে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শত শত মাদ্রাসা স্থাপন করে ওহাবিবাদ ও সালাফিবাদের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে যে দুর্বল কূটনীতি অনুসরণ করছে তাতে দশ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের ঘাড় থেকে আদৌ নামবে কি না বলা কঠিন। আমরা এ নিয়ে নাগরিক কমিশন গঠন করেছি, বার বার সরকারকে বলেছি রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার বার্মা ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজকে এবং দুই দেশের প্রবাসীদের এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য। সরকার আমাদের এসব পরামর্শের প্রতি কর্ণপাতের প্রয়োজন বোধ করে না। পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের মদদে দশ লক্ষ রোহিঙ্গার ভেতর জামায়াত-হেফাজতিরা যেভাবে জঙ্গী মৌলবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে তা আমাদের জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জামায়াতিরা কিভাবে রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকায় ঢোকাচ্ছে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে। সরকার রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তুলে ধরার ক্ষেত্রে যতটা তৎপর তাদের ভেতর জঙ্গী প্রবণতার বিস্তার সম্পর্কে আদৌ সচেতন বলে মনে হয় না। আগামীতে এর মাশুল শুধু সরকারকে নয়, গোটা জাতি ও দেশকে দিতে হবে। দশ লাখ রোহিঙ্গার ভেতর এক লাখও যদি জামায়াত-হেফাজতের কারণে জঙ্গীবাদী হয়, মহাজোট সরকারের মহাউন্নয়নের চাকা উল্টো দিকে ঘুরবে। জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। এটি মূলত রাজনৈতিক ও আদর্শিক সমস্যা, যা রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এই মোকাবেলা কখনও সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত জঙ্গীবাদের দুর্গগুলো নিরাপদ ও অক্ষত থাকবে। (সমাপ্ত) ১৫ মার্চ, ২০১৮
×