ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রহসন শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ মার্চ ২০১৮

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রহসন শুরু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্য থেকে যেখানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে চরম মিথ্যাচার করে জানান দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার রাখাইন মুসলিম মংডুর উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে এসেছে। এছাড়া পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অঙ্গীকার করে এখন রীতিমতো প্রহসনমূলক তৎপরতা শুরু করেছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের পরিচয় ও ঠিকানা নিবন্ধিত হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের ১২ আশ্রয় কেন্দ্রে অনিবন্ধিত অবস্থায় রয়েছে আরও দেড় লক্ষাধিক। এসব ছাড়াও গত বছরের ২৫ আগস্ট গভীর রাত থেকে সেনা অভিযানে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার কারণে এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে যেখানে বাধ্য হয়েছে, সেখানে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নতুন করে বলছে, আরসার (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) হামলার ভয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর এসব সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ মানবতাবিরোধী নানা কর্মকা- শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সাহায্য ও দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে রোহিঙ্গারা জাতিগত নিধনের শিকার। এছাড়া ওপারের বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেনা অভিযানে ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এদের অনেককে গণকবর দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে দশটির সন্ধান মিলেছে। একটি উদ্ঘাটিত হয়েছে সেনাতদন্তে। বিশ্বব্যাপী এ ঘটনাটি তোলপাড় সৃষ্টি করার পর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। প্রত্যাবাসনে স্বাক্ষরিত হয়েছে সমঝোতা স্মারক। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর হওয়ার পর তারা সে তালিকা থেকে ৩৭৪ জনকে রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি হাস্যকরও বটে। সর্বশেষ রাখাইন রাজ্য সচিব টিন মং সোয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, গত বছরের ২৫ আগস্টের আগে রাখাইনে প্রায় ১০ লাখ পাঁচ হাজার মুসলিম (রোহিঙ্গা) ছিল। এখনও রাখাইন রাজ্যে প্রায় চার লাখ ৭০ হাজার মুসলিম রয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ সরকার যে হিসাব দিচ্ছে, তার তুলনায় পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের হিসেবে প্রায় দেড় লাখ কম। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন হলেও জাতিসংঘ ও সরকারী হিসেবে ৬ লাখ ৯২ হাজারের তালিকা তথ্য দেয়ায় মিয়ানমার এ সুযোগ গ্রহণ করে অন্য রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিতে ফন্দি আঁটছে বলে জানিয়েছে সচেতন মহল। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেছেন, গত ছয় মাসে বাংলাদেশে কত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ সরকারই হিসাব করেনি, বরং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থাও হিসাব করেছে এবং সবাই ৬ লাখ ৯২ হাজার শরণার্থীর বিষয়ে একমত। এখানে ৬ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেহেতু ১১ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছে। আরও অনেকে অনিবন্ধিত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনুপ্রবেশ করছে নতুন নতুন রোহিঙ্গা পরিবার। সকল রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করে ত্বরিত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রকাশ করা না হলে মিয়ানমার ওই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গড়িমসি করতে পারে বলেও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের গণহত্যা প্রতিরোধ বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা আদামা দিয়েং বাংলাদেশে সফরকালে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন অবস্থার অবসান ঘটিয়ে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সমাধানের জন্য আমাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমি যা শুনেছি ও দেখেছি তা থেকে স্পষ্ট যে অধিকাংশ রোহিঙ্গাই দেশে ফিরে যেতে চায়। তবে তা হতে হবে নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে। রোহিঙ্গারা সেখানে সেদেশের নাগরিকের ন্যায় মৌলিক অধিকার নিয়ে বসবাস করতে চায়। জাতিসংঘের এই বিশেষ উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। দেশটির সরকারের উচিত, রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য সেখানে যথার্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং অন্য নাগরিকদের মতো একই অধিকার দেয়া। তিনি আরও বলেন, ‘কক্সবাজারে আমি যা দেখলাম, তা এক মানবিক বিপর্যয়। আর এতে মিয়ানমারের দায় সুস্পষ্ট। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর দায় এড়াতে পারে না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জীবিত দগ্ধ ও অপদস্ত করা হয়েছে।’ এর আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তাদের ওপর সংঘটিত লোমহর্ষক অত্যাচারের বিবরণ শোনেন আদামা দিয়েং। এদিকে, বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রচার হয়েছে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলো ধংস করে মাটিচাপা দিয়ে সেখানে নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বসবাসের জন্য একাধিক পল্লী। ফলে বিষয়টি এখন নিশ্চিত যে, যেসব রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নেয়া হবে তারা নিজেদের ভিটেমাটি আর ফিরে পাবে না। থাকতে হবে আশ্রয় শিবিরে। যা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বন্দী শিবিরতুল্য। আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতাদের পক্ষে আরও জানানো হয়েছে, মিয়ানমার সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করেছে এবং তা সম্পন্ন করার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল বান্দরবান সীমান্ত এলাকা থেকে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের লোভে ফেলে রাখাইন রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতাও প্রণীত নীলনক্সার অংশ বলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের হামলায় ২ উপজাতি আহত ॥ রোহিঙ্গাদের হামলায় ২ উপজাতি আহত হয়েছে। রোহিঙ্গারা উপজাতীয়দের প্রায় ১শ’ একর কলাবাগান কেটে সাবাড় ও আদা, হলুদ ক্ষেত নষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া উপজাতি সম্প্রদায়ের বসতি ১০-১২টি বাড়ি ভাংচুরও করেছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। শনিবার সকালে উখিয়ার তেলখোলা চাকমা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। হামলায় আহত চৌখিনু চাকমা ও খ্যতু চাকমাকে বর্তমানে উখিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। স্থানীয় মৌজা প্রধান বাউনু হেডম্যান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, শনিবার সকালে তেলখোলা থেকে আধা কি.মিটার দূরের তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রায় ২-৩ হাজার রোহিঙ্গা এ ঘটনায় অংশ নেয়।
×