ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উনিশ শতকের মিষ্টি প্রেম, কয়েকটি দোকান ধরে রেখেছে ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৮ মার্চ ২০১৮

উনিশ শতকের মিষ্টি প্রেম, কয়েকটি দোকান ধরে রেখেছে ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে টাঙ্গাইলে গিয়েছেন, সে যে কাজেই যান না কেন, ফেরার সময় কয়েক কেজি মিষ্টি থাকবে হাতে। থাকতেই হবে। আনন্দের কোন উপলক্ষ নেই? পোড়াবাড়ির চমচম কেনাটাই আনন্দ। খাওয়ার আলাদা মজা। শুধু স্বাদ নয়, সুনাম নয়, বহুকালের পুরনো ঐতিহ্য। ঐতিহ্যের টানেও অনেকে ছুটে যান। দোকান খুঁজে বের করেন। এত যে প্রসিদ্ধ, কেন? খেতে খেতে রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করেন। এভাবে প্রচার বাড়ে। বাড়তে থাকে। ময়রাদের লোক চেতনা, প্রাচীন চর্চা, নিজস্বতার বোধ এবং হাতের নৈপুন্য বাঁচিয়ে রেখেছে পোড়ামাটির চমচম। চাহিদার কারণে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে বিশেষ এই মিষ্টি। পাঠানো হচ্ছে বিদেশেও। অবশ্য পোড়াবাড়ির কথা বলা হলেও, গ্রামটি আর আগের মতো নেই। ধলেশ্বরীর তীরে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ময়রাদের বড় সমাবেশ ঘটেছিল। তারাই উপহার দেয় পোড়াবাড়ির চমচম। বর্তমানে তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে টাঙ্গাইল শহরের মিষ্টি দোকানগুলো। পোড়াবাড়ির কারিগররাই কাজ করছেন এসব দোকানে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও চমচম তৈরি হয়। আছে নানা নাম ও জাত পাত। এই যেমনÑ ক্ষীর চমচম, পোড়া চমচম, শিব চমচম, ছোট চমচম, বড় চমচম ও রাজ চমচম। তবে টাঙ্গাইলের চমচমের কাছে আর সব ম্লান হয়ে যায়। মৌচাক চমচম মুখে দিলে অন্য স্বাদ পুরনো হয়ে যায়। যে কোন ভোজে টাঙ্গাইলের চমচম রাখা মানেই বিশেষ ঘটনা। অন্যরকম উদ্যাপন। টাঙ্গাইল শহরে পা রাখতেই চোখে পড়ে অগণিত মিষ্টির দোকান। রসগোল্লা, সন্দেশ, আমৃতি, রসমালাইসহ চেনা মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো। তবে মূল আকর্ষণ চমচম। টাঙ্গাইলের পোড়ামাটির চমচম আকারে বড়। ডিম্বাকৃতি। বাহিরের অংশটি, খুব লক্ষ্য করে দেখা গেল, পোড়ামাটির মতোই। আগুনে পোড়া মাটি যে রং ধারণ করে, সেই লালচে রং। গা মসৃণ বটে, উপরিভাগটা বালির মতো। দানা দানা। কারিগরদের সঙ্গে কথা জানা গেল, মাওয়ার গুঁড়া কিংবা দুধ জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে সেই গুঁড়া চমচমের ওপর ছিটিয়ে দেয়া হয়। এতে চমচম দেখতে আরও আকর্ষণীয় হয়। স্বাদটাও বাড়ে। হাতে নিলে রস চুইয়ে পড়ে না। ভেতরে জমা থাকে ঠিকই। মিষ্টি খুব বেশি নয়। আবার কমও নয়। সবই পরিমাণমতো। মুখে পুড়তেই অন্যরকম তৃপ্তি। আদি ঘ্রাণ। গৃহস্তের বাড়িতে বসে মিষ্টি খাওয়ার অনুভূতি হয়। মিষ্টির ভেতরের অংশের রং রসগোল্লার মতো। সাদা বা বাদামী। আর যে বৈশিষ্ট্যটির কথা না বললেই নয়Ñ এর ভেতরের অংশ মৌচাকের মতো। ছিদ্রযুক্ত। ফাঁপা অংশ রসে ভর্তি। সব দোকানে আসল চমচম পাওয়া যায়, এমন নয়। কিছু দোকান শুধুই দোকান। বড় বড় দোকানের আকর্ষণীয় নাম। রঙিন সাইনবোর্ড। উজ্জ্বল আলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকে প্রায়শই মনে হয়েছে সাধারণ মিষ্টি। নতুন মালিকরা ব্যবসায় টিকে থাকতে নানা অসদুপায় অবলম্বন করছেন বলে অভিযোগ। দুধের গুণ মান নিয়ে ভাবেন না তারা। এখানে গ-গুল হওয়ায় মান নষ্ট হয়ে যায় চমচমের। এ অবস্থায় একটু খোঁজ খবর নিয়ে চমচম কিনলে প্রকৃত স্বাদটা পাওয়া যায়। আসলের স্বাদ পেতে হলে যেতে হয় পাঁচআনী বাজার। ছোট গলির ভেতরে ১৫ থেকে ২০টির মতো দোকান। শহরে প্রবেশ করার পর থেকেই কানে আসছিল গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারের নাম। সবচেয়ে পুরনো আর বিখ্যাত দোকান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। নিজেরাই চমচম তৈরি করেন। পূর্ব পুরুষের ব্যবসা। ছোট পরিসর দোকান বটে। ব্যাপক ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, উৎসবের আমেজ। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ এসেছেন বলে মনে হয় না। মনের ক্ষুধা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ পিরিচে মিষ্টি তুলে নিয়েছেন। কাটা চামচ দিয়ে কেটে একটু একটু করে খাচ্ছেন। তারও বেশি মানুষ আছেন অপেক্ষায়। কারও ২ কেজি চাই। কারও ২০ কেজি। অর্ডার অনুযায়ী প্যাকেট করায় ব্যস্ত দোকানের কর্মীরা। সুদেব নামের এক কর্মী জানান, ৭টি বড় চমচম তুললেই এক কেজি হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত ছোটটি নিলে পাওয়া যায় ১২ থেকে ১৩টি। শুধু খাওয়া বা কেনা নয়, এখানে মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়াটিও দেখা যায়। আর তখন চমকিত হতে হয় শুধু। দোকানের পাশেই আরেকটি ঘর। সে ঘরে বিশালাকার পাঁচটি চুলো পাতা। যত বড় চুলো ততো বড় কড়াই। উত্তপ্ত কড়াইয়ে ডুবু তেল। খইয়ের মতো ফুটছে। সেখানে জাল দেয়া হচ্ছে চমচম। প্রদীপ চন্দ্র ঘোষ নামে এক কারিগর চিনি গলিয়ে সিরা করছিলেন। পরে সেই সিরা ঢালছিলেন পাশের কড়াইতে। ৩০ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি। বললেন, চমচম প্রচুর জ্বাল দিতে হয়। কয়েকটি পর্যায়ে শেষ হয় ভাজার কাজ। সাদা মিষ্টি পোড়ামাটির রং ধারণ করার আগে পর্যন্ত জাল দেয়ার কাজ অব্যাহত থাকে। জানা যায়, এই দোকানের শুরুটা করেছিলেন রাধা বল্লভ দাস। ৭২ বছর বয়সী দোকান ১৯৪৬ সালে চালু করা হয়। বর্তমানে পৈত্রিক পেশা চালু রেখেছেন তার পুত্র গোপাল দাস। তারও বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝে দোকানে বসেন। এদিন জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মিষ্টি তৈরি করতেন। তারা ছিলেন অসমের। সেখান থেকে জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন টাঙ্গাইলে। প্রথমে চাল মুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করতেন। পরে তারা মিষ্টি তৈরি শুরু করেন বলে জানান তিনি। গোপাল দাসের দায়িত্ব ছাড়ার আগেই নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন তার ছেলে কৃষ্ণ দাস। ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অন্য অনেক কিছুই করা যেত। কিন্তু এটি আমাদের কাছে শুধু ব্যবসা নয়। বাবা ঠাকুরদাদের ঐতিহ্য। এ কারণেই মিষ্টির দোকানে বসি। প্রতিযোগিতার বাজারেও অত্যন্ত সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে জানান তিনি। পুরনো দোকানগুলোর আরেকটি ‘জয়কালী।’ এটিরও খুব সুনাম। দেকানের লম্বা আকার। সামনের অংশে মিষ্টি সাজানো। পেছনের অংশে চলছে মিষ্টি তৈরির কাজ। এই দোকানের শুরু হয়েছিল খোকা ঘোষের হাতে। এখন দেখা শোনা করছেন তার পুত্র স্বপন ঘোষ। গত ৪০ থেকে ৪৫ বছর ধরে ব্যবসাটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। পিতার পেশাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, নানা কারণে পোড়াবাড়ির চমচম তার জৌলুস হারিয়েছে। ময়রাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন। বাকিরা চলে এসেছেন টাঙ্গাইল শহরে। পাঁচআনীতে এসে নতুন করে কাজ শুরু করেছেন তারা। আমাদের দোকানেও অনেক পুরনো কারিগর আছেন। দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন। মূলত তাদের হাত ধরেই বেঁচে আছে ঐতিহ্য। পোড়াবাড়ির চমচম বলতে তাদের তৈরি চমচমকেই বোঝায়। এত যে স্বাদ, কেন? জানতে চাইলে একটা তৃপ্তির হাসি হাসেন তিনি। বলেন, আমরা চমচমে কোন ধরনের রং বা কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। চমচম তৈরির উপকরণ বলতে শুধুই দুধের ছানা আর চিনি। ছানার ময়ান এবং চিনির শিরা তৈরিতে পানির প্রয়োজন হয়। চমচম মূলত কারিগরদের দক্ষতা ও দীর্ঘকালের চর্চার ফল বলে জানান তিনি। এদিকে পোড়াবাড়ির চমচমের পেছনের ইতিহাস একেকজন একেকভাবে বলে থাকেন বলে মনে হয়েছে। একটি বক্তব্য অনেকের মুখেই শোনা গেল। সে অনুযায়ী, পোড়াবাড়িতে সর্বপ্রথম যিনি চমচম তৈরি করেন তার নাম ছিল দশরথ গৌড়। আসাম থেকে টাঙ্গাইলে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। ধলেশ্বরীর তীরে বাস করতেন। নদীর সুস্বাদু পানি ও দেশী গাভীর ঘন খাঁটি দুধ দিয়ে বিশেষ এই মিষ্টি তৈরি করেন। সাফল্য দেখে পরে অন্যরাও অনুসরণ করেন তাকে। এভাবে পোড়াবাড়ি গ্রামটিই চমচমের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখন শুকনো মরা ধলেশ্বরী। নদীবন্দর নেই। বাজারে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান। আশার কথা যে, পাঁচআনী বাজারের কিছু দোকান ধরে রেখেছে ঐতিহ্য। ঐতিহ্যের টানে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা ছুটে আসেন। ঢাকা থেকে ছুটে থেকে আসা এক দম্পতির সঙ্গে কথা হয় পাঁচআনী বাজারে। ১০ কেজি চমচম কিনেছিলেন হাবিবুর রহমান ও সাজিদা খানম দম্পতি। হয়ত কোন উৎসব অনুষ্ঠান আছে। আসলেই কি? জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, উৎসব অনুষ্ঠান কিছু নেই। টাঙ্গাইলে আসলে সব সময়ই বেশি করে চমচম কিনি। আত্মীয় পরিজনের বাসায় বিলাই। এই আনন্দ টাকা বিলিয়ে পাওয়া যায় না, যোগ করেন পাশে বসে থাকা সাজিদা। স্থানীয় ক্রেতাদের সঙ্গেও কথা হয় চমচম নিয়ে। আমিন নামের এক তরুণ অর্ধকেজির মতো চমচম নিয়ে বসেছিলেন। খাচ্ছিলেন মজা করে। এত খাওয়া যায়? জবাবে তিনি বললেন, কোন ব্যাপার না। মিষ্টি না খেলে খাবেন কী? কথা থেকে বোঝা হয়ে যায়, টাঙ্গাইলের চমচম বাঁচিয়ে রাখার পেছনে ভূমিকা আছে স্থানীয় মিষ্টিপ্রেমীদেরও। এই প্রেম বেঁচে থাকুক। ছড়িয়ে যাক।
×