ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর হঠাৎ ঢাকায় তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৮ মার্চ ২০১৮

জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর হঠাৎ ঢাকায় তৎপর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হঠাৎ করেই ঢাকায় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনেকটা প্রকাশ্যেই জঙ্গী সংগঠনটি তৎপরতা চালাচ্ছে। গত তিন মাস ধরে জঙ্গী সংগঠনটি বেশি তৎপর। মাসখানেক ধরে প্রতি শুক্রবারেই জঙ্গী সংগঠনটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল করছে। প্রায় প্রতিদিনই এর কোন না কোন সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে। গত শুক্রবারসহ টানা চার দিনে জঙ্গী সংগঠনটির পাঁচ সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। মোহাম্মদপুরে সংগঠনটির তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের ছেলে হিযবুত তাহরীরের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা রিসাদ কামাল খানের হাত রয়েছে কি না সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। ঢাকার অন্যান্য জায়গায় জঙ্গীদের গোপন তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্য মোতাবেক ঢাকায় জঙ্গীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুক্রবার র‌্যাব-২ মোহাম্মদপুর থেকে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হামিদুর রহমান ওরফে বাপ্পিকে (৩৬) গ্রেফতার করে। তার পিতার নাম মৃত হারুন-অর রশিদ। বাড়ি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন কৃষ্ণপুর ছয়গড়িয়া গ্রামে। বাপ্পী মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটির খ ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর এম এ কাদের পাটোয়ারী ও মিসেস নূরজাহান বেগমের বাড়িতে ভাড়ায় থাকত। র‌্যাব-২ এর মিডিয়া বিভাগের সহকারী পরিচালক এএসপি মোঃ ফিরোজ কাউছার গ্রেফতারকৃত বাপ্পীর বরাত দিয়ে জানান, বাপ্পী দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য হিসেবে গোপনে তৎপরতা ও দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। বাপ্পী বাংলাদেশের অখ-তা, সংহতি, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশের সদস্য হয়েছে। জঙ্গী সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একটি জঙ্গী মামলা চলমান রয়েছে। সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনটির লিফলেট বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে গত ১৪ মার্চ র‌্যাব মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগ লাগোয়া বছিলার ওয়েস্ট ধানম-ি হাউজিং এলাকা থেকে রিয়াদ হোসেন (২৪), জিহাদুল ইসলাম (১৯) ও শরীফ হোসেন (২৩) নামে হিযবুত তাহরীরের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। তার একদিন আগে বছিলা এলাকা থেকে আরও এক হিযবুত তাহরীর সদস্য গ্রেফতার হয়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে জঙ্গীবাদের তৎপরতা থাকার তথ্য জানা গেছে। এরমধ্যে হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা কিছুটা বেশি। তিন মাসের মধ্যে মাসখানেক ধরে হিযবুত তাহরীর শুক্রবারে আচমকা এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে ঝটিকা মিছিল করে পালিয়ে যাচ্ছে। কর্মী সংগ্রহ ও দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখার অংশ হিসেবে জঙ্গী সংগঠনটির এমন তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এজন্য ঢাকায় জোরালো অভিযানও চলছে। গ্রেফতারও হচ্ছে। জঙ্গীদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সর্ম্পকে তিনি আগাম কোন কিছু জানাতে অনুসন্ধানের স্বার্থে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। জঙ্গীদের তৎপরতা সর্ম্পকে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীদের তৎপরতা থেমে যায়নি। তবে আগের তুলনায় কমে গেছে। জঙ্গীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ, কর্মী সংগ্রহ, দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে ঝটিকা মিছিল, লিফলেট বিতরণসহ অন্যান্য কর্মকা- চালানোর চেষ্টা করে। সম্প্রতি হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জঙ্গীরা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি জায়গায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিকল্পনাকারীদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। অনেককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। জঙ্গীরা যাতে নতুনভাবে কোন নাশকতা করতে না পারে, এজন্য তারা তীক্ষè নজরদারি করে যাচ্ছেন। দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থার একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লেখা সম্বলিত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানোর সময় খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলের ছেলে রিসাদ খান তার বন্ধু ফয়সালসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী লেখা সম্বলিত হিযবুত তাহরীরের বিশাল বিশাল আকারের পোস্টার উদ্ধার হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায় হিযবুত তাহরীর সম্পর্কে। রিসাদ ইংরেজী মাধ্যমের ছাত্র। গ্রেফতারকৃত রিসাদের বন্ধু ফয়সাল ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস। সূত্রটি বলছে, তারা বর্তমানে জামিনে রয়েছে। খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর জঙ্গী সংগঠনটির তৎপরতা বেশি হারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা বেশি। এর পেছনে রিসাদ খানের হাত থাকতে পারে। রিসাদ খানের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের নেপথ্যে কারা মদদ দিচ্ছে সে বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৩ সালে পূর্ব জেরুজালেমের সাবেক বিচারক তাকিউদ্দিন আল-নাবানী হিযবুত তাহরীর গঠন করেন। বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালে বিদেশী অর্থায়নে পরিচালিত একটি এনজিওর উত্তরা কার্যালয়ে জঙ্গী সংগঠনটির ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠক থেকে দেশে জঙ্গী সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। একমাস পর মার্চ থেকেই কার্যক্রম শুরু হয়। দলটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই সহায়তা করে আসছে বিএনপি-জামায়াত-শিবির। সংগঠনটি জঙ্গী সংগঠন বলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের পরেও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেটি নিষিদ্ধ করেনি। পাকিস্তানে ২০০৮ সালে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরে সরকার ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। জঙ্গী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর বর্তমানে বিশ্বের ৫৩টি দেশে সংগঠনটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে।
×