ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর আরেকটি পরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৮ মার্চ ২০১৮

মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর আরেকটি পরীক্ষা

মোঃ মামুন রশীদ ॥ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দেখা, কখনও পূর্ণিমা আবার কখনও অমাবস্যা দেখার অভিজ্ঞতা সম্ভবত তারই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ট্র্যাজিক কিছু ঘটনা তার নামের সঙ্গেই লেখা হয়েছে। সত্যিকারের একজন ট্র্যাজিক হিরো হয়ে উঠেছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। সর্বশেষ মর্মন্তুদ ঘটনাটি ছিল তার ২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে দলকে না জেতাতে পারা। সেই দুঃখটা ভুলেছেন তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়ে। ব্যাঙ্গালুরুর সেই ম্যাচে মাহমুদুল্লাহর সঙ্গী ছিলেন মুশফিকুর রহীম। মুশফিকও সেদিন পারেননি, তবে এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলমান নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম সাক্ষাতে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়ে। দু’জন আলাদাভাবে দু’দিন অবিস্মরণীয় জয় এনে দিয়েছেন। এবার এ দু’জনের সম্মিলিত লড়াইয়ে দারুণ কিছু করার সুযোগ। নিদাহাস ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে বাধা সেই ভারত। প্রথমবারের মতো সেই স্বাদ দেশকে উপহার দেয়ার মোক্ষম সুযোগ মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর। অনেক হিসেব-নিকেশের ম্যাচ ভারতের বিপক্ষে। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকেই মূলত সেই হিসেবের শুরু। সেবার ভুল আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়ে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল দুর্দান্ত খেলতে থাকা বাংলাদেশ। পরের বছর মার্চে দেশের মাটিতে টি২০ এশিয়া কাপের ফাইনালে এবং পরের মাসেই ভারতের মাটিতে টি২০ বিশ্বকাপে হেরে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। এসবের মধ্যে সবচেয়ে জ্বালাময়ী এবং আক্ষেপে পূর্ণ ঘটনা ছিল টি২০ বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুতে মাত্র ১ রানের পরাজয়। সেই ম্যাচে ৩ বলে প্রয়োজন ছিল ২ রানের। ক্রিজে ছিলেন মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক। কিন্তু দু’জনই ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে সাজঘরে ফিরে যান। আর জিততে পারেনি বাংলাদেশ দল। সেই আক্ষেপে পুরো দেশ কেঁদেছিল এবং ধিক্কার দিয়েছিল মুশফিক-মাহমুদুল্লাহকে। এমন তীরে এসে তরী ডোবানো, তাও আবার মর্যাদাপূর্ণ বিশ্বকাপের মতো একটি মঞ্চে মেনে নেয়াটা বেশ কঠিনই ছিল দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য। সেদিন খলনায়ক হয়ে যাওয়া এ দুই ক্রিকেটার প্রায় দুই বছর পরে হয়ে গেছেন মহানায়ক। মুশফিক ৩৫ বলে অপরাজিত ৭২ রানের অবিশ্বাস্য একটি ইনিংস খেলে চলমান নিদাহাস ট্রফির প্রথম ম্যাচে প্রায় একাই হারিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কাকে। উপমহাদেশের কোন দল হিসেবে সর্বাধিক এবং বিশ্বের ইতিহাসে টি২০ ক্রিকেটে চতুর্থ সর্বাধিক রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ তার এমন ইনিংসের জন্যই। মাত্র চারদিন পরই নিজের আক্ষেপ কবর দিলেন মাহমুদুল্লাহও। তিনিও বেছে নিলেন সেজন্য শ্রীলঙ্কাকেই। এবার আরও অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। ৪ বলে ১২ রানের প্রয়োজন ছিল, সঙ্গী হিসেবে ছিল না কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যানও। মাত্র ৩ বলেই প্রয়োজনীয় রান তুলে নিয়েছেন এবং ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে অবিস্মরণীয় জয় ছিনিয়ে ফাইনালে পৌঁছে দিয়েছেন। ১৮ বলে ৪৩ রানের হার না মানা এই টর্নেডো ইনিংসে আগের সব ক্ষত একেবারেই শুকিয়ে, দাগহীন করে ফেলেছেন। এখন সুপার হিরো মাহমুদুল্লাহ। তারজন্য এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১০ সালে আইডিয়া কাপেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সেই আসরে কোন ম্যাচ জিততে না পারলেও দলের শেষ তিন ম্যাচে ৬০, ২৪ ও ৬৪ রানের তিনটি অপরাজিত ইনিংস ছিল মাহমুদুল্লাহর। এরপর ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ রানের মধ্যে ২ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। এরপর মাহমুদুল্লাহর ১০৩ রানের ইনিংসে জয়ের সংগ্রহ পেয়েছিল বাংলাদেশ। একই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঠিক পরের ম্যাচেও ২৭ রানে ২ উইকেট হারায় দল। এমন সময় উইকেটে এসে অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস খেলে বিপদ কাটিয়েছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সর্বশেষ গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি অবিস্মরণীয় ম্যাচ। আসরে টিকে থাকতে জয় ছাড়া কোন পথ ছিল না বাংলাদেশের। এমন ম্যাচে ৮ উইকেটে ২৬৫ রান তুলেছিল নিউজিল্যান্ড। এর জবাবে ২৮ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে নিশ্চিত পরাজয় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু তখনই ব্যাট হাতে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন, সাকিবের সঙ্গে জুটি বেঁধে এখান থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন দু’জনই। ২০১৬ টি২০ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষেও ম্যাচ জেতানো ইনিংস রয়েছে তার। এ সবই মাহমুদুল্লাহর ম্যাচ জেতানো ইনিংস। এর বাইরে দলের ডুবন্ত ইনিংসকে তিনি বহুবার সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু বড় দু’টি ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রাণ মানুষ মাহমুদুল্লাহর কাছ থেকেই। ২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে তিনি দলকে জেতাতে পারেননি পাকিস্তানের বিপক্ষে, দেশের মাটিতে বাংলাদেশ শিরোপা হাতছাড়া করেছিল ২ রানে হেরে। এরপর ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই ১ রানের হার। সেই হারের পর থেকে যেন মুশফিক টি২০ ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। কিন্তু এবার নিদাহাস ট্রফিতে ফর্মের তুঙ্গে আছেন। ৪ ম্যাচে করেছেন দুটি অর্ধশতকসহ ১৯০ রান ৯৫.০০ গড়ে। অথচ ব্যাঙ্গালুরুতে ১১ রানে আউট হওয়ার পর তার ৫ টি২০ ইনিংস ছিল ০, ৮, ১৫, ১৩ ও ২। শেষ পর্যন্ত গত মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে সিরিজের প্রথম টি২০ ম্যাচে ৬৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ফর্মে ফেরেন মুশফিক। এরপর টানা ৬ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩ অর্ধশতক। ইনিংসগুলো ছিল ৬৬*, ৬, ১৮, ৭২*, ৭২* ও ২৮। এখন সেসব ইতিহাসের অতল গহ্বরে জমা পড়েছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বীরোচিত লড়াইয়ে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ সব ক্ষতই ঢেকে দিয়েছেন। আক্ষেপ নেই আর, তবে আফসোস কিংবা মনের কোণে খচখচানো একটি ভাব রয়ে গেছে। ভারতের বিপক্ষে এমন একটি জয় খুব প্রয়োজন পুরোপুরি পুরনো কষ্ট ভুলে যাওয়ার জন্য। সেই সুযোগ আজ বাংলাদেশ দলের। আর নায়ক হওয়ার সুযোগ মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর।
×