ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওষুধ রফতানিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৮ মার্চ ২০১৮

ওষুধ রফতানিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, একাত্তরের স্বাধীনতার কিছুদিন পর বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। তখন এ শিল্প এতটা উন্নত ছিল না। শুরুতে মোট চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ বাংলাদেশ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল, আর ৮০ ভাগই নির্ভর করত বৈদেশিক আমদানির উপর, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। ওষুধের তীব্র সঙ্কটের সময়, শুরুতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রি করতে বিভিন্ন অজুহাতে অনীহা দেখায়। এরপর পূর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরির ওষুধ সংস্থা ইগিস, গেইডেন, রিখটার, কাইরন ও মেডিম্পেস পণ্যের বিনিময়ে (পাট ও অন্যান্য কাঁচামাল) বাংলাদেশে ওষুধ সরবরাহে রাজি হয়। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশের প্রায় ৭০ ভাগ বাজার আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া দখলে ছিল। ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে দেশীয় ওষুধ শিল্প মুক্তি পায় এবং আস্তে আস্তে বাজার সম্প্রসারণ শুরু করে। ২০০১ সালে বাংলাদেশে ওষুধ কারখানার সংখ্যা ছিল ১৫০টি এবং হাতেগোনা কয়েকটি দেশে ওষুধ রফতানি করা হতো। ২০১৪ সালে সে তালিকা দাঁড়ায় ৮৭টি দেশের। রফতানির পরিমাণ ৩১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৬০৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়, আর ওষুধ তৈরির কাঁচামাল রফতানি বাড়ে এক কোটি ১০ লাখ টাকা থেকে ১৬ কোটি ছয় লাখ টাকা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে, এর মধ্যে ১৬৪টি কারখানা নিয়মিতভাবে ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, সর্বমোট ২৬৯টি এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে বছরে ২৪ হাজার রকমের ১২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করে। সরকার অনুমোদিত বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ও কাঁচামাল এনে উৎপাদন ও বাজারজাতকৃত জেনেরিক ওষুধের (এ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা এক হাজার ২০০টি। প্রায় ২৫ হাজার নাম (ব্র্যান্ড) নাম ব্যবহার করে এসব ওষুধ প্রস্তুত করছে প্রায় ৯০০টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন, বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ওষুধ বিদেশে রফতানি-সবখানেই এই খাতের সাফল্য এখন আকাশছোঁয়া। প্রতিবছরই ওষুধ শিল্পখাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন আর বিস্ময়কর সব সাফল্য আসছে। ওষুধ রফতানির দেশের সংখ্যাও একের পর এক বেড়ে চলেছে। ওষুধ আমদানিও কমে আসছে। এসবই সম্ভব হয়েছে এই খাতের মেধাবী উদ্যেক্তা, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট, বায়োকেমিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের নিরলস পরিশ্রম এবং সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ধারাবাহিক সহযোগিতার কারণে। একসময় কারও কল্পনাতেও ছিল না যে ইউরোপ, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুুধ কিনে খাবে। অথচ সত্যটা হলো-বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ এখন আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। সেদেশের মানুষ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ব্যবহার করছে। ওষুধ শিল্পখাতের জন্য এটি নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় সাফল্য। সম্প্রতি এ খাতের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো-গুণগত মান অক্ষুণœ রেখে আমেরিকাসহ বিদেশের বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করা। বিদেশের বাজারে প্রতিনিয়ত আমাদের উৎপাদিত ওষুধ রফতানি হচ্ছে, যার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গর্বের সঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় আগে অনেক ওষুুধ বাজারে পাওয়া যেত না, বাইরের দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো, কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। আমাদের দেশে এখন অনেক উন্নত মানের ও উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ তৈরি হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে বহুবিধ পরিবর্তন ও নতুনত্বও আসছে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো এখন শুধু ওষুুধ উৎপাদনেই নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেনি, আন্তর্জাতিক বাজারকে সামনে রেখে নিজেদের বিভিন্নভাবে বিস্তৃত করছে। বায়োহাইজিন ইকুইপমেন্ট তৈরি করা থেকে শুরু“করে ওষুধের কাঁচামাল তৈরিতেও মনোযোগী হয়েছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২০টি দেশে মোট ৮১২ কোটি ৫১ লাখ টাকার ওষুধ, কাঁচামাল ও মেডিকেল ডিভাইস রফতানি করা হয়েছে। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৭টি দেশে এ রফতানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৪৭ কোটি ৫ লাখ টাকায়। এ হিসাবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ওষুধ রফতানির পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৪১টি কোম্পানির তৈরিকৃত ওষুধ বিশ্বের ১২৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশ রয়েছে ৩৭টি। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার ২১টি, আফ্রিকার ৩৪টি, উত্তর আমেরিকার ৪টি, ইউরোপের ২৬টি ও অস্ট্রেলিয়ার ৫টি দেশে নিয়মিত ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত ওষুধ রফতানি হয়েছে মোট ৮৩৬ কোটি ৮২ লাখ টাকার। এর মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মা ওষুধ রফতানি করেছে ১৫৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকার। আর ইনসেপ্টা ৮৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ও স্কয়ার ফার্মা ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ওষুধ রফতানি করে। বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে এছাড়া রয়েছে দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, এ্যারিস্টো ফার্মা, রেনেটা, এসকেএফ ফার্মা বাংলাদেশ, এসিআই, পপুলার, বায়োফার্মা, অপসোনিন, গ্লোবফার্মা, বীকনফার্মা, ড্রাগস ইন্টারন্যাশনাল, হেলথকেয়ারফার্মা, ওরিয়নফার্মা, জেসন, নাভানা, জেনারেল, ডেল্টা, গ্লাস্কো, ইবনে সিনা, রেডিয়ান্ট, নভো হেলথকেয়ার ফার্মা, নিপ্রো জেএমআই, ইডিসিএল, এ্যামিকো ল্যাবরেটরিজ, গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস, টেকনো ড্রাগস, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস, এ্যাক্টিভ ফাইন কেমিক্যাল লিমিটেডসহ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি। ওষুধ শিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশে রফতানি হয় এমন ওষুধের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইনজেকশন ও ইনহেলার উল্লেখযোগ্য। তবে এর অধিকাংশ ওষুধই জেনেরিক নামে রপ্তানি হচ্ছে। কিছু কোম্পানি নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে ওষুধ রফতানি করলেও তার সংখ্যা এখনও কম, যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এদিকে ক্যান্সার, মস্তিষ্কজনিত সমস্যা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ভ্যাকসিনসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ এখনও আমদানিনির্ভর বলা যায়। তবে সম্প্রতি দেশের কয়েকটি কোম্পানি ভ্যাকসিন ও ক্যান্সারের ওষুধ তৈরিতে এগিয়ে এসেছে। এছাড়া মেডিক্যাল ডিভাইস উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। প্রায় ৯৮ শতাংশ মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে উন্নত মানের ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার স্বীকৃতিও পেয়েছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। সম্প্রতি বেক্সিমকো ফার্মা ও স্কয়ার এফডিএর অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া এফডিএর অনুমোদনের প্রতীক্ষায় রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
×