ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ আইনের কাঠগড়ায় তিনি

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৯ মার্চ ২০১৮

অভিমত ॥ আইনের কাঠগড়ায় তিনি

আইনের সুশাসনের কাঠগড়ায় খালেদা জিয়া- এ কথাটি ভাবতেই বিএনপির নেতা-কর্মীর সঙ্গে খোদ খালেদা জিয়াও আজ অবাক, বিস্মিত! কারণ তিনি নিজেও আইনের সুশাসনের বিপরীতমুখী অবস্থান তৈরি করেছে। খুন করা যাবে, লুটপাট করা যাবে, ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ করা যাবে, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করা যাবে, জাতির পিতাকে নিষ্প্রাণ করা যাবে, শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেনেড ছোড়া যাবে; কিন্তু অপরাধের বিচার করা যাবে না! অপরাধীর শাস্তি হবে না- এই মনোবৃত্তির মাঝে আজ দেশে বিচার হচ্ছে, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে জাতি মুক্তি পাচ্ছে, তাই অপরাধবোধ না হলেও খালেদা জিয়ার মাঝে আশ্চর্যবোধ সৃষ্টি হয়েছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও বিচারহীনতার সেই ‘ইনডেমনিটি’ ধরে রাখতে পারেনি তারা। আর এ রায়কে ঘিরে খোদ খালেদা জিয়াসহ বিএনপি সিনিয়র নেতাদের নানা ধরনের বক্তব্য অনেকটা আদালতকে চ্যালেঞ্জ বা হুমকি-ধামকির মতো হলেও আদালত স্বাধীনভাবে মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অবশেষে ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ে ফৌজদারি দ-বিধির ৪০৯ ধারায়, ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ কারণে বিএনপির চেয়ারপার্সন ‘বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ-’ শোনাতে সফল হয়েছেন। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবেও সাব্যস্ত করেছে। এখানে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএনপির সিনিয়র নেতা-আইনজীবী ও দলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরাম মামলার মোটিভ, তথ্য-উপাত্ত এবং ঠিকানাবিহীন এতিমখানার সব বিষয়ের চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে রায়ের আগেই বুঝতে সক্ষম হয়েছে- এতিমখানা দুর্নীতি মামলা থেকে তিনি রেহায় পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়া একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। তাই সুকৌশলে রায়ে আগেই বিএনপির গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে তার দলীয় সদস্য পদ রাখার ব্যবস্থা করল। বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারায় দলের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতার বিষয়ে বলা ছিল, ‘কেউ দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি দলের সদস্য থাকতে পারবেন না।’ ওই ধারার (ক)-তে আছে, ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতি আদেশ নং ৯-এর বলে দ-িত ব্যক্তি, (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি দলের সদস্য হতে পারবে না। শুধু বিএনপির গঠনতন্ত্রই নয়, বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় দাঁড়াইল মৌজায় প্রায় ৯ বিঘা জমির ওপর পঁচিশ বছরের পুরনো মরিচা ধরা সাইনবোর্ডটি রাতারাতি সরিয়ে নতুন সাইন বোর্ড পর্যন্ত সুকৌশলে সাঁটানো কাজও করেছে! জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার ক্ষেত্রেও জেনারেল জিয়াউর রহমানের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও পরবর্তী বেগম খালেদার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি অব্যাহত রাখার জন্য খোদ খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতাকর্মী হেন চেষ্টাা নেই যে করেনি। আর এটি যে বিএনপির নতুন কৌশল তা কিন্তু নয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা বিচারহীনার অপসংস্কৃতির সূচনা করেছে। জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা; ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায়। আর সে হত্যাকা-ের বিচার করা যাবে না মর্মে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারির মাধ্যমে আইনের শাসনকে নিষিদ্ধ করেছিল। খুন করা যাবে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যাবে, কিন্তু অপরাধের বিচার করা যাবে না- এই অপসংস্কৃতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সৃষ্টি। এমনি করে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে ছোট-বড় ২২টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান কায়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সেনা কর্মকর্তা ও সিপাহীকে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করেছে। ১৯৮২ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া খুন হওয়ার সময় ৫০ জন ব্রিগেডিয়ার এবং মেজর জেনারেলের মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধার পোশাক, স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তরালে জিয়াউর রহমান প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের আদর্শ ধারণ করে পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের আদর্শ এবং তার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক হন তার স্ত্রী বেগম খালেদা। বিএনপির চেয়ারপার্সন হয়েও বেগম খালেদা তাঁর স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার করেনি। শুধু তাই নয়, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কারা এবং কেন হত্যা করা হয়েছে এই ধরনের কোন বক্তব্য-বিবৃতি পর্যন্ত দিতে দেখা যায়নি। বরং তিনিও তাঁর স্বামীর মতো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে, সেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সংসদকে অপবিত্র করেছে। পাকিস্তানী এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেগম খালেদাও তাঁর স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতন কাজ করেছে। কখনও কখনও ত্রিশ লক্ষ শহীদ, কয়েক লাখ ধর্ষিত নারী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি বাস্তবায়ন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে পাঁচ-পাঁচবারের মতো দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে দেশ ও জনগণের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এমনি করে- বাংলা ভাইদের উত্থান, গাছের ডালে উল্টো ঝুলিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা, ধর্মীয় মতবাদের নামে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি, আওয়ামী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করতে ঘরে ঘরে ঢুকে লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ; জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। শুধু এখানেই নয়, সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ছিল কিশোর, যুবতী ও মায়ের বয়সী নারীর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে নারীদের ধর্ষণের পৈচাশিক অত্যাচার-নির্যাতন; ভাইয়ের সামনে বোন, বাবার সামনে মেয়ে, স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণযজ্ঞ আবার সেই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বর্বর পাকিস্তানীদের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। এমনি করে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা শীলের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সদ্য কৈশোরে পা পড়া পূর্ণিমার বাড়িতে রাতের অন্ধকারে হানা দেয় বিএনপি-জামায়াতের একদল হায়েনা। নৌকা মার্কায় ভোটদানের অভিযোগ এনে তারা প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিশোরী পূর্ণিমা রানীর ওপর। পূর্ণিমার বাবা-মা শঙ্কিত। অসহায় অভিভাবক নীরব-নিথর হয়ে পড়ে। বিএনপি-জামায়াতের একদল পশুর হিংস মূর্তি দেখে পূর্ণিমার মা তখন তাদের বাধ্য হয়ে অনুরোধ করে বলেছিল, ‘বাবা আমার মেয়েটা ছোট। তোমরা একজন-একজন করে এসো, মরে যাবে।’ সেদিন পূর্ণিমা না মরলেও মরে গিয়েছিল তার বিশ্বাস। মরে গিয়েছিল তার কৈশোর। মরে গিয়েছিল রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান। আজ অবাক হলেও সত্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার শেষ করতে মোট ২৬১ কার্যদিবস আদালত বসেছে। এর মধ্যে ২৩৬ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। আর আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন ২৮ কার্যদিবস। যা এই মামলা প্রায় ১০ বছর ধরে চলেছে। দীর্ঘ এই বিচার প্রক্রিয়ায় মামলা থেকে রেহাই পেতে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেছেন বার বার। তার অনাস্থার কারণে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে তিনবার এ মামলার বিচারক বদল হয়। শুনানিতে হাজির না হওয়ায় তিনবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করে আদালত। এত কিছু করেও আইনের সুশাসনের কাঠগড়া থেকে বাইর হতে পারেনি খালেদা জিয়া। বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- হয়েছে। বিচারিক আদালত বেগম খালেদা ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে রায় প্রদান করেছে। ইতোমধ্যেই হাই কোর্টের চার মাস জামিনের আদেশ স্থগিত করে এর মধ্যে লিভ টু আপীল করতে বলে আপীল বিভাগ। আইনের সুশাসন থেকে খালেদা জিয়া যে খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পারছেন না, তা নাশকতার আরেক মামলায় কুমিল্লার একটি আদালত তাকে গ্রেফতারের আবেদন গ্রহণ করায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিরোধীদলীয় বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে দেশের অসহায় এতিমের টাকা যেখানে নিরাপদ নয়, সেখানে দেশ ও জাতি কীভাবে নিরাপদ থাকবে? এটা জাতির জন্য সত্যিই লজ্জাজনক। এই লজ্জাজনক ও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধীর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঔদ্ধত্য সৃষ্টি হবে। কারণ অপরাধ সংঘটিত ব্যক্তির পরিচয় অপরাধী হিসেবে এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব অপরাধীর অপরাধের দ-িত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; এটাই জাতির প্রত্যাশা। লেখক : সভাপতি, বোয়াফ
×