ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্যা ও সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৯ মার্চ ২০১৮

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্যা ও সম্ভাবনা

বৈমানিকদের মধ্যে একটা পুরনো কৌতুক চালু আছে। তাহলো আদর্শ ফ্লাইট ক্রু হচ্ছে একটা কম্পিউটার, একজন পাইলট ও একটা কুকুর। কম্পিউটারের কাজ বিমান চালানো। পাইলটের কাজ কুকুরকে খাওয়ানো। আর কুকুরের কাজ হলো পাইলট কম্পিউটারকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে তাকে কামড়ে দেয়া। জটিল দায়িত্ব সম্পাদন করা কম্পিউটারের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম ক্ষেত্র মেশিন লার্নিংয়ে যে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে তাতে কম্পিউটারগুলো এমন সব সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে যা আগে পারা তাদের পক্ষে ছিল সাধ্যাতীত। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে এমন জোয়ার এসেছে যে কম্পিউটার চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে বীমা এবং স্বচালিত গাড়ি পর্যন্ত সবকিছুর ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এ ব্যাপারে অবশ্য এক অপ্রত্যাশিত বাধা বা ঝামেলাও আছে। মেশিন লার্নিং কম্পিউটারকে তার নিজেকেই নিজে ট্রেনিং দেয়ার সক্ষমতা প্রদান করে কাজ করে। ফলে কম্পিউটার তার হাতে ন্যস্ত দায়িত্বের সঙ্গে তাদের প্রোগ্রামিংকে খাপ খাইয়ে নেয়। কম্পিউটার কাজ করার সময় এই স্বলিখিত প্রোগ্রামগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে বুঝতে মানুষকে বেশ বেগ পেতে হয়। এলগোরিদমগুলো যখন দাবা খেলা কিংবা কোন ছায়াছবি দেখবার জন্য সুপারিশ করার মতো মামুলি ধরনের কাজ করে তখন এই ‘ব্ল্যাক বক্স’ সমস্যা স্বাচ্ছন্দ্যে উপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু এলগোরিদম কখন কাকে ঋণ দেয়া যাবে, কাউকে প্যারোলে ছাড়া যাবে কিনা কিংবা জনাকীর্ণ শহরের মধ্য দিয়ে কিভাবে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে সেই বিষয়গুলো নির্ধারণ করেন তখন সেগুলোর ক্ষেত্রে ক্ষতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সর্বোত্তম এলগোরিদমের ক্ষেত্রেও ভুলত্রুটি অনিবার্য রূপেই হতে পারে। আর সেই ভুলত্রুটি হলে গ্রাহকরা, নিয়ন্ত্রকরা এবং আদালতও কেন সেই ত্রুটি হলো জানতে চাইবে। কিছু কিছু মানুষের বেলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাশ টেনে ধরার এটা একটা কারণ। যেমন ফ্রান্সের ডিজিটাল অর্থনীতি মন্ত্রী মৌনির মাজুরি বলেছেন সরকারের এমন কোন এলগোরিদম ব্যবহার করা উচিত নয় যেগুলোর সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে তাঁর এই মন্তব্যকে অতি প্রতিক্রিয়া বলে আখ্যায়িত করা যায়। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও বুদ্ধিমান কম্পিউটারের সৃষ্ট সমস্যাবলী নজিরবিহীন নয়। মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান তো আর কিছু নয়। সমস্যা সৃষ্টিকারী বুদ্ধিমান মানুষদের নিয়ে সমাজের বিচিত্র অভিজ্ঞতার আর শেষ নেই। এর সঙ্গে বুদ্ধিমান কম্পিউটার যোগ করা হলে সমস্যা সৃষ্টি হবে ঠিকই তবে সে সমস্যা অনতিক্রম্য হবে না। মানুষকে দিয়েই শুরু করা যাক। কম্পিউটার প্রোগ্রামের তুলনায় মানুষকে বুঝতে পারা আরও কঠিন। বিজ্ঞানীরা অতি ব্যয়বহুল ব্রেন স্ক্র্যানিং মেশিন ব্যবহার করে যখন তাদের মস্তিষ্কের ভিতর দৃষ্টিপাত করেন তখন তাদের দেখতে পাওয়া অনেক কিছুই ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। মানুষ তাদের নিজেদের আচরণের ব্যাখ্যা দিতে পারে ঠিকই তবে সেগুলো যেসব সময় সঠিক হয় তা নয়। অনেকে নিজেদের আচরণের যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে মিথ্যা কথা বলেন। কিন্তু তারাও জানেন না তাদের অবচেতন মনে কি চলে। এমনকি সৎ মানুষদেরও এই অবচেতন মনে জগৎটাকে জানার সুযোগ খুবই সীমিত, আসলে মস্তিষ্কের ভিতরকার প্রক্রিয়াগুলো অতি জটিল ও দুর্জেয়। এর কোন সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। মানুষ যদি নিজ নিজ ভাবনার প্যাটার্নগুলো ব্যাখ্যা করতে পারত তাহলে সেগুলোর সরাসরি অনুকরণ করে মেশিনের প্রোগ্রাম করতে পারত। মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ যে এক জটিল প্রক্রিয়া মেশিন লার্নিং থেকেই তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। মানুষের ভাবনার ধারাগুলোকে অনুকরণ করে কম্পিউটার প্রোগ্রাম করতে পারা সম্ভব নয় বলেই তারা মেশিন লার্নিয়ের ভুলভ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে নিজেদের শেখাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টির চেষ্টা নানাভাবে হোঁচট খেতে খেতে আজ এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, একে আর অস্বীকার করার তো জো নেই বরং এর দ্রুত প্রসার ঘটে চলেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে। স্পিচ ট্রান্সক্রিপশন থেকে শুরু করে অন্ধত্বের আগাম লক্ষণগুলো নির্ণয়, কলকারখানায় মাননিয়ন্ত্রণ এবং ড্যাটা সেন্টারগুলোর কুলিং সিস্টেম পরিচালনা করে। সরকার আশা করে যে সন্ত্রাসবাদীদের প্রচার প্রচারণার সাইটগুলো চিনতে এবং সেগুলোকে ওয়েব থেকে মুছে ফেলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়োগ করা যাবে। আজ স্বচালিত যানবাহন তৈরির চেষ্টার মুখ্য বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিশ্বের সবচাইতে মূল্যবান কোম্পানি হিসেবে উল্লিখিত ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৭টি কোম্পানি জানিয়েছে যে, ডিপ-লার্নিংভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তাদের কার্যক্রমের মূল শক্তিকে পরিণত করার পরিকল্পনা তাদের আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মেশিনের ক্ষমতার পরিধিকে সর্বক্ষণ প্রসারিত করে চলেছে। মেশিন মানুষের চেয়ে কখনও ভাল হয় কিনা সে প্রশ্নের জবাব বলতে হয় অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই। যেমন ওয়েব সার্চের কথাই ধরা যাক। র‌্যাঙ্কব্রেইন হলো একটি মেশিন লার্নিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবের কঠিনতম প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে বের করে। এটি শব্দ বা শব্দমালার অর্থ বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী সবচেয়ে নিকটতম উত্তরটি খুঁজে পরিবেশন করে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে মানুষ যেখানে অনুমান করে উত্তর বের করতে ৭০ শতাংশ সময় নেয় সেখানে র‌্যাঙ্কব্রেইনের সাফল্যের হার ৮০ শতাংশ। দ্বিতীয়ত গভীর মহাকাশ, সাগরের তলদেশ কিংবা তেজস্ক্রিয় রিএ্যাক্টরের ভেতর ভাগের মতো স্থানগুলোতে যেখানে কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন রোবোট দিব্যি টিকে থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, ডিপ লার্নিং কৌশলের প্রয়োগ করে দেখা গেছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোবোট মানুষের চাতুর্য ও ক্ষিপ্রতার সমকক্ষ হতে পারে। তৃতীয়ত: বহু ভাষায় অনুবাদ করার সক্ষমতা। এতদিন যা কল্পনায় ছিল আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। গুগল ট্রানশ্লেট এ্যাপ নিমেষের মধ্যে যে কোন বিষয়কে ২৭টি ভাষায় অনুবাদ করে দিতে পারে। এই সক্ষমতা ক্রমাগতই বাড়ছে। চতুর্থত: চিকিৎসা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির পূর্বাভাস দানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর মেশিনের প্রচলন হয়েছে। এটি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ সিমুলেট করতে জানায় মস্তিষ্কের বৈকল্য নির্ণয় ও পর্যবেক্ষণে এর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক জনপ্রিয় প্রয়োগ হলো রেডিও সার্জারি। আশপাশের টিস্যুর ক্ষতিসাধন না করে টিউমার অপারেশনে রেডিও সার্জারির সফল প্রয়োগ চলছে। পঞ্চমত: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে কম্পিউটার গেমিংয়ে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবোটই হলো প্রতিপক্ষ। আমরা যে চাল দিচ্ছি তার জবাবে কৃত্রিম বুদ্ধি পাল্টা চাল দিয়ে আমাদের ঘায়েল করার চেষ্টা করে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি জনপ্রিয় খেলা হলো ‘গো গো’। এই খেলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমনভাবে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে যে কম্পিউটার নিজেই নিজেকে খেলা শিখিয়ে দক্ষতা অর্জন করে। অনেক সেরা খেলোয়াড়ের এই খেলায় কম্পিউটারের কাছে হেরে যাওয়ার নজির আছে। ষষ্ঠত: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ড্যাটা সুবিন্যাস্ত ও ম্যানেজ করার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধির ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে। স্মার্ট কার্ডভিত্তিক ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা জালিয়াতি নির্ণয় করা হচ্ছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে অসুবিধা ও সমস্যাও আছে প্রচুর। এগুলো অত্যন্ত জটিল ধরনের মেশিন বলে তৈরির খরচ অনেক পড়ে যায়। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতও এক বিশাল ব্যয়বহুল ব্যাপার। তাছাড়া পরিবর্তনশীল পরিবেশ ও প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মেশিনগুলোর সফটওয়্যার প্রোগ্রাম ঘন ঘন আপগ্রেড করতে হয়। বুদ্ধিমত্তা হলো প্রকৃতির দান। মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রতিরূপ সৃষ্টি করা যায় কি-না তা নিয়ে নৈতিক যুক্তিতর্কের অবকাশ আছে। মেশিনের কোন আবেগ অনুভূতি ও নৈতিক মূল্যবোধ নেই। তাদের যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় সেভাবেই কাজ করে। অপরিচিত পরিবেশ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজ বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষতা ঘটায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেভাবে নিজের উৎকর্ষতা ঘটাতে পারে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপুল পরিমাণ ড্যাটা মজুত রাখে। কিন্তু যেভাবে সেই ড্যাটার মূল্যায়ন ও ব্যবহার করা হয় তা মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে একেবারেই আলাদা। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মেশিন সমর্থ নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে সর্বান্তকরণে বা আবেগগতভাবে কাজ করার মতো কিছুই নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিভাষায় যতœ বা ভাবনা বা উদ্বেগের কোন অস্তিত্ব নেই। নিজস্বতাবোধ, একাত্মতাবোধ বা মানবিক স্পর্শ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি ও অদক্ষ ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য টানতে পারে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি নেই। এটি অনেক কিছুই করতে পারে। তারপরও মানব মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতার সঙ্গে এর কোন তুলনা হয় না। এর কোন মৌলিকতা ও সৃজনশীল মন নেই। মানুষ অতিমাত্রায় আবেগ অনুভূতিসম্পন্ন স্পর্শকতার। তারা দেখে, শোনে, চিন্তা করে, অনুভব করে। তাদের ভাবনাগুলো অনুভূতি দ্বারা চালিত যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানব মস্তিষ্কের অন্তর্নিহিত ইনটুইশনের ক্ষমতার প্রতিরূপ মেশিনে আনা সম্ভব নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার সমাজে বড় ধরনের বেকারত্ব ঘটাতে পারে। বেকারত্ব সমাজের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। যাদের কিছুই করার নেই তারা তাদের সৃষ্টিশীল মনকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেদার ব্যবহার করার ফলে মানুষ মেশিনের ওপর অহেতুক অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে। তখন তারা নিজেদের সৃজনশীল শক্তি হারিয়ে ফেলবে এবং অলসও হয়ে পড়বে। আর কৃত্রিম বুদ্ধি যদি দুষ্টের হাতে গিয়ে পড়ে তাহলে তো সেটা সামগ্রিকভাবে মানবজাতির প্রতিই গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টি সম্ভবত: মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা। যদি গঠনমূলকভাবে এর ব্যবহার ও বিকাশ ঘটানো যায় তাহলে এদিয়ে দারিদ্র্য ও বুভুক্ষা মুছে ফেলাসহ অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। প্রশ্ন হলো আমরা একে কিভাবে কাজে লাগাব। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×