ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জয়তু ডটার অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ১৯ মার্চ ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জয়তু ডটার অব বাংলাদেশ

বিমান দুর্ঘটনা সবসময়ই মর্মান্তিক। যতবার বিমানে চড়ি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি এই শেষ। একেকবার এমন হয় মনে হতে থাকে আর বুঝি মাটিতে নামা হলো না। আমরা যারা মাটির মানুষ আমাদের পা যেখানে আত্মাও সেখানে। আমাদের জীবন যে কত তুচ্ছ আর ছোট সেটা নানা সময় বুঝলেও মানুষ তো থেমে থাকার জন্য জন্মায়নি। বলছিলাম ইউএস বাংলার যে বিমানটি নেপালে ভূপাতিত হলো তা নিয়ে। এই মর্মান্তিক ঘটনার আসল ব্যাখ্যা আমরা জানি না। তবে এটা বুঝি এর পেছনে একক কেউ দায়ী হতে পারে না। এর একটা তদন্ত নিশ্চয়ই হবে। নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে সত্য। কিন্তু ত্রিভুবন বিমানবন্দর বা কর্তারা যেন কোন কারণে দায় এড়িয়ে যেতে না পারে সেটা দেখার দায় বাংলাদেশের। জটিল বিষয়ে সবার মাথা না ঘামানোই উচিত। আমরা শোকার্ত, আমরা ভয়ার্ত-এর বাইরে কি করার আছে আমাদের? কিন্তু আজকাল সামাজিক মিডিয়ার যুগে আমরা যা দেখি বা শুনি তাতে কলম বন্ধ রাখা দায়। যখন কোন মানুষ জীবনের ওপারে চলে যায় তখন সেসব হিসাব-নিকাশের ওপরে। তাকে নেবে মিথ্যা নিন্দা এমনকি তার সমালোচনা তো ধর্মেও নিষেধ আছে। আর আমরা কি দেখছি? বাংলাদেশের এক বিভ্রান্ত প্রজন্ম এরপরও চালাচ্ছে মিথ্যাচার। তাদের গুজবের ডাল-পালা নিয়ে যতটা মাথাব্যথা তার চেয়ে বেশি অবাক করে তাদের মানসিকতা। এরা কবে থেকে এমন হলো? কোন বিষয়কেই এরা ছাড় দিচ্ছে না আজকাল। বুঝলাম জাফর ইকবালের আদর্শবোধ আছে। তিনি অরাজনৈতিক মানুষ হলেও তাঁর লেখা বা কাজে রাজনীতি আছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের কল্যাণে উচ্চকিত। তাঁর ভেতর দ্বিধা নেই। তাঁকে রাজাকারের ছানাপোনারা পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। তাই তাঁর বেলায় না হয় আপত্তি থাকার পরও বুঝলাম। কিন্তু নিরীহ মানুষগুলো যারা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তাদের ভেতর যে মেয়ে কো-পাইলট তাঁকে নিয়েও এমন অযাচিত কথাবার্তা? কি তারা লিখেছে কেন লিখেছে আমরা তা জানি এবং বুঝিও। কিন্তু যে প্রশ্নটা আজ জাতির সামনে তা হলো, এই প্রক্রিয়া কি ঠেকানো যাবে না এর ধাক্কা আমাদের বইতে হবে? এর যে কুফল সেটা কিন্তু রাজনীতিকে ছেড়ে কথা বলবে না। আজ মনে নাহলেও একদিন এর জন্য আওয়ামী লীগকেই মূল্য দিতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও আদর্শের বিরুদ্ধে যারা তারা এখন এটা বুঝে গেছে এদেশে তাদের দুশমন আসলে নারীকুল। আমি হলপ করে বলতে পারি এক সময় খালেদা জিয়া নারীদের সমর্থন বেশি পেলেও এখন এটা পুরো বিপরীত। এখন মা-বোনেরা এটা বুঝে গেছেন শেখ হাসিনাই তাদের ভরসা। তিনি না থাকলে এদেশে তারা থাকতে পারলেও দাসী হওয়বার বিকল্প থাকবে না। বয়সী খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে সমাজবিরোধীরা যে খেলায় মেতে উঠবে তার টার্গেট নারীকুল। ফলে তারা আওয়ামী রাজনীতি অপছন্দ করলেও শেখ হাসিনাকে ভালবাসেন। তখন থেকেই মূলত ধর্মের নামে মিথ্যাচার আর নারী বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখছে এরা। যার সর্বশেষ নমুনা নেপালে দুর্ঘটনা কবলিত বিমানের কো-পাইলট পৃথুলার বেলায় বেরিয়ে এলো নগ্ন হয়ে। এই বিদ্বেষ অপরিকল্পিত কিংবা অরাজনৈতিক নয়। আমাদের দেশের মানুষ এখনও এত নোংরা আর বদলে যায়নি যে, একটি অকালে ঝরেপড়া নারীকে নেবে বাজে কথা বলবে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের মনে আজ করুণ এক দুঃখবোধ। শোকে মূহ্যমান জাতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তাদের এই বেদনা এড়িয়ে আরেকদিকে যারা মাতম করছে এরা তারা যাদের মূল উদ্দেশ্য দেশ ও জাতিকে অন্ধকারে ফিরিয়ে নেয়া। এই অপরাজনীতি এখন আইনের মুখোমুখি না হলে এরা আমাদের সমাজকে কুঁড়ে কুড়ে এক সময় শেষ করে দেবে। এমনিতেই বিভ্রান্তির শেষ নেই। এখন শুরু হয়েছে অপপ্রচার। ধর্মের নাম ভাঙিয়ে একজন মহিলা পাইলটকে এবং মৃত ব্যক্তিকে অপমান করার শাস্তি দিতে না পারলে কেউই রেহাই পাব না আমরা। এখন এটা সামাজিক রোগ। যার অপপ্রভাব বিদেশেও দেখি। সিডনিতেও এমন সব লোক আছে যাদের কাছে জামায়াত বা যুদ্ধাপরাধীরা নিরাপদ হলেও আমরা সংখ্যালঘু বলে অনিরাপদ। এদের ভাষা ব্যবহার আর জীবন এত নোংরা শুনলেও শরীর খারাপ করে। তবে ভরসা এই বিদেশে আইনের আওতায় আনলেই এরা সাইজ হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের বেলায় সরকারের কঠোরতা আর মানুষের সচেতনতা ছাড়া আর কোন পথ দেখছি না। এই নোংরামি আর অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে সবাই মিলে। তবে মানতেই হবে পৃথুলাই আমাদের বীরকন্যা। মানুষ তাকে বুকে ধারণ করে আছে। এসব অপনোংরামি তাকে কোনদিন ও ছুঁতে পারবে না। পারবে না বীর পাইলট আবিদকে। নেপালী-বাংলাদেশী চাইনিজ মালদ্বীপের যেসব নাগরিকরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদের স্মৃতি ও চলে যাবার বেদনা বাংলাদেশ যেভাবে ধারণ করেছে তা কল্পনাতীত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুর সফর ছোট করে চলে এসেছেন দেশে। এই আমাদের আসল চেহারা। তাই নির্ভয়ে বলি, বীরকন্যা পৃথুলা তুমি জান, তোমার চেয়ে ভাল আর কে জানে, মানুষকে ওপর থেকে কত ছোট কত ক্ষুদ্র দেখতে লাগে। যত ওপরে যাওয়া যায় ততই ছোট হয়ে আসে পার্থিবতা। ততই তুমি পাখি, তত মেঘ তত নীল। তুমি তো জানই এদেশে কোটি কোটি ভাল মানুষ বাস করে। এরা আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন। আবার এই দেশে মৌমাছির সঙ্গে বিষ্ঠাভোগী মাছিও আছে। আছে মানুষরূপী জানোয়ার। এরা জন্ম থেকে মৃত্যু সবকিছুতেই পাপ আর নারীর দোষ খুঁজে বেড়ায়। এসব অভিশপ্ত মানুষের তোমার মার্জনা করারও দরকার নেই। তুমি এখন যেখানে-সেখানে দেবদূত থাক বা না থাক রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি তোমায় গেয়ে শোনাবেন, সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার, আকাশ তোমায় শয্যা পেতে দিয়েছে। হাওয়া তোমার চোখে-মুখে বুলিয়ে দিচ্ছে শীতল পরশ। আকাশকুসুম মাটি থেকে উঠে আসা ঘাসের শীতলতা তোমার কানে কানে প্রশ্ন রাখছে, খুব কি কষ্ট হয়েছিল তোমার? তুমি কি শ্বাস নিতে পারছিলে না মা? মেঘরাজ মেঘদূত নিজে গন্ধরাজ কামিনী গোলাপের মালা পরিয়ে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। নিজে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছ বলে। ডটার অফ বাংলাদেশ তুমি পশুতে নও মানুষে বেঁচে থাকবে চিরকাল। তারার দেশে তারা হয়ে যাওয়া পৃথুলা তুমি কি জীবনে কি মরণে সদাই তারায় তারায় খচিত। তোমারে করি গো নমস্কার।
×