ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

আর করুণার পাত্র নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৯ মার্চ ২০১৮

আর করুণার পাত্র নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের সবকিছু ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আরও উন্নত করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশের পথ ধরে বাংলাদেশ আগামীতে আরও দ্রুত উন্নত-সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশকে এক কদম সামনের দিকে এগোতে দেয়নি। কারণ একাত্তরের গণহত্যাকারী ও পঁচাত্তরের খুনীরা একই বৃন্তের ফুল। এদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এরাই ক্ষমতায় থেকে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। যারা বাংলাদেশকে করুণার চোখে দেখত, বটম লেস বাস্কেট (তলাবিহীন ঝুড়ি) বলত, তাদের আমরা দেখিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, উন্নয়নশীল দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনে উৎফুল্ল প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতিসংঘের এ স্বীকৃতি জাতির জন্য এক বিরাট অর্জন ও গৌরবের। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর বাংলাদেশ এ স্বীকৃতি পেল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে ১৯৭৫ সালে প্রথম বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তবে পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ এবং ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন। আগামী ২৬ মার্চ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করব। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমাদের একটাই প্রতিজ্ঞা, এ দেশকে নিজেদের সবকিছু ত্যাগের বিনিময়ে হলেও উন্নত সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলব। রবিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, আশা-আকাক্সক্ষা কিংবা পদের জন্য নয়, দেশের জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। আর এটাকে আমি কর্তব্য বলেও মনে করি। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা দেশকে গড়ে তুলছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমনন্ত্রী বলেন, সারাবিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। মানুষের জন্য আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে যে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হয় আমরা তা প্রমাণ করেছি। ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই দেশ উন্নত হচ্ছে, সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কো তাদের ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতির পিতার জন্মদিনে এর থেকে বড় সুখবর আর হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা দীর্ঘ ২১টি বছর ক্ষমতায় ছিল তারা এ অর্জন আনতে পারল না কেন? কারণ তারা স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার-আলবদর, একাত্তরের গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বানিয়ে তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। এরা তো দেশের স্বাধীনতাই চায়নি। এরা কোনদিনই চাইবে না বাংলাদেশের মানুষ দু’বেলা খেয়ে ভাল থাকুক, দেশের উন্নত হোক, অর্থনৈতিকভাবে দেশ স্বাবলম্বী হোক। ক্ষমতায় থেকে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়েছে আর বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে যা যা করার তার সবই করেছে। এই দীর্ঘ সময় তারা দেশকে একদমও সামনের দিকে এগোতে না পারে সেই চেষ্টাই করেছে। কিন্তু ৩৭ বছর পর হলেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছে। আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের দু’বোনকে ৬ বছর বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থাকতে হয়েছে। ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি তখনও প্রতি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। দলের উপরের দিকে (নেতা) কিছুটা টালমাটাল হলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা কখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। বাবা-মা, ভাইসহ সবাইকে হারিয়ে দেশে ফিরে এসে দেশের জনগণের কাছ থেকেই আমি বাবা-মা’র ¯েœহ-ভালবাসা পেয়েছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন, বছরের অধিকাংশ সময় কারাগারে থাকতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা একটাই লক্ষ্য দেশের জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন করা, সেই কর্তব্য পালনেই দেশের জনগণের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশে এখন কুঁড়ে ঘর নাই বললেই চলে। আমরা দেশের একটা মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। ওই সময়ের মধ্যে আমরা দেশকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই বাঙালী জাতি স্বাধীনতা, স্বাধীন রাষ্ট্র ও বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এসব হতো কি না সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। তিনি বলেন, বাঙালী জাতির সমস্ত অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুই শুরু করেছিলেন। তখনও অনেক নেতা ছিলেন যারা পাকিস্তানের একটু ডাক পেলেই ছুটে যেতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির স্বাধীনতার প্রশ্নে কখনও মাথানত করেননি, বঙ্গবন্ধুকে কোন লোভ দেখিয়ে কেউ কিনতে পারেনি, তার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। তিনি বলেন, বাঙালী জাতির বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকারও দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশে যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুই এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের দলের অনেক বড় বড় নেতা ক্রাইসিসের সময় মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার পর তাদের অনেক খেলাই দেখেছি। ৬ দফা না ৮ দফা হবে এ নিয়েও অনেক খেলা হয়েছে। কিন্তু বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সত্তরের নির্বাচনের সময়ও অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু সত্তরের নির্বাচনটাও ছিল বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের অংশ। অনেকে নির্বাচনে না গিয়ে ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর এমন স্লোগানও দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের নেতা কে হবেন- এটা নির্ধারণের জন্যই বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, কিন্তু বাঙালীর হাতে পাকিস্তানীরা শাসনভার দেবে না। যুদ্ধ করেই দেশকে স্বাধীন করতে হবে। এই লক্ষ্য নিয়েই বঙ্গবন্ধু পুরো বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু ৫ ডিসেম্বর এ দেশের নাম বাংলাদেশ, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা সবকিছুই ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা তুলে ধরে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন দেখে আমাদের একাত্তরের গণহত্যার কথাই মনে পড়ে। পাকিস্তানের হানাদাররা এদেশের রাস্তা-ঘাট চিনতো না। কিন্তু আমাদের দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার আলবদর-আলশামসের নামে হানাদারদের পথ চিনিয়ে গণহত্যা চালাতে সাহায্য করেছে। তখন তাদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। কিন্তু বাঙালীকে কেউ কখনও দমাতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে বাঙালী জাতি যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। বিলম্ব হলেও দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। এর পথ ধরে বাংলাদেশ আগামীতে আরও উন্নত-সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যারা একসময় আমাদের দিকে করুণার চোখে তাকাত, একটা ঋণ নিতে গেলে কিংবা এটা প্রজেক্ট করতে গেলে, হাজার রকম শর্ত জুড়ে দিত। আর দুর্নীতি না করলেও দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে প্রজেক্টের টাকা বন্ধ করা যেমন পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু তারা এখন আর এসব করতে পারবে না। সেই সাহস আর পাবে না। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের ঋণ পেতে কোন অসুবিধা হবে না। হয়ত একটু সুদ বেশি দিতে হবে। তাতে কিছু যায় আসে না। এইটুকু আমরা দিতে পারি। কিন্তু আজকে আমরা ঋণ নেয়া, প্রজেক্ট নেয়া এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং দেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া-আমাদের যে মূল টার্গেট, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে সেই লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে পারব।
×