ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চৈত্রের সেতার বাজছে

দ্বাদশ মাসে পুরনো বিদায়, নতুন সাজে প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৯ মার্চ ২০১৮

দ্বাদশ মাসে পুরনো বিদায়, নতুন সাজে প্রকৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ ফাল্গুন ফুরিয়েছে। এসেছে চৈত্র। কবিগুরুর ভাষায়- চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্ত বাহার/বাতাসে বাতাসে ওঠে তরঙ্গ তাহার...। সেই তরঙ্গ এখন শোনা যাচ্ছে। আজ সোমবার মাসের পঞ্চম দিন। এরই মাঝে বেশ বদলে গেছে প্রকৃতি। পুরনোকে বিদায় দিয়ে সাজছে নতুন করে। রাজধানী শহরের বিবর্ণ গাছপালা ধারণ করেছে চিরহরিৎ রূপ। গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতিকেও নানাভাবে প্রভাবিত করছে চৈত্র। চৈত্র বাংলা সালের দ্বাদশ ও সমাপনী মাস। সেই সঙ্গে চৈত্র মাস পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। এই মাসে অতীতের বেদনা ভুলে নতুন করে বাঁচার, স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। এক সময় চৈত্র মাসকে বিবেচনা করা হতো অভাবের মাস হিসেবে। শেষ মাসে এসে কৃষকের গোলা ভর্তি ধান শেষ হয়ে যেত। টাকা পয়সা হাতে থাকত না। বাড়তি খরচের কথা এ সময় ভাবতেই পারতেন না তারা। শুধু কী তাই? চৈত্র মাসে বিয়েশাদি পর্যন্ত বন্ধ থাকত। সবাই অপেক্ষা করে থাকতেন বৈশাখের। এ সময় নতুন ফসল উঠত ঘরে। আর তখন শুরু হতো উৎসব। এ বিবেচনায় চৈত্র ছিল নতুন স্বপ্ন বোনার মাস। তবে এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। সারা বছরই কোন না কোন ফসল হয়। এই কিছুদিনের মধ্যে রোপণ করা হবে গ্রীষ্মের শাকসবজি। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি যথারীতি সচল থাকবে। চৈত্র মাসের গরমের কথা না বললেই নয়। এ সময় প্রচন্ড দাবদাহ দেখা দেয়। শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায় মাঠ। বৃষ্টিও এ সময় নিয়মিত হয় না। ফলে শেষ সময়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বোরো ধানের আবাদ। গ্রামে গ্রামে তাই বৃষ্টির জন্য চলে প্রার্থনা সঙ্গীত। চৈত্রে প্রকৃতিতেও দেখা যায় ব্যাপক পরিবর্তন। এরই মাঝে সবুজ পত্রপল্লবে ভরে ওঠে বৃক্ষ শাখা। রাজধানী ঢাকায় সামান্য গাছপালা। বিবর্ণ চেহারার কারণে সেগুলোও তেমন দৃশ্যমান হয় না। এখন উল্টো। একটু চোখ মেলে তাকালে অবাক হতে হয়। প্রায় সব গাছেই সবুজের সমারোহ। রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসলে মন ভরে যায়। সবুজ উদ্যানের প্রতিটি গাছে ভরপুর প্রাণ। কত রকমের ফুল ফুটে আছে! বহু গাছে শুধু পাতা। সেই পাতার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে রাখে। এমনকি ঢাকার সড়ক বিভাজকের উপরে যত গাছ ধুঁকছিল সবই এখন দারুণভাবে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। গাছের নতুন কঁচি পাতা বাতাসে কী যে সুন্দর দোল খাচ্ছে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কবিগুরু এমন দৃশ্য দেখেই হয়ত লিখেছিলেন, কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়,/ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চম্কে-চাওয়ায়।/হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী কার সোহাগের স্মরণখানি/ আমের বোলের গন্ধে মিশে/কনকনে আজ কান্না পাওয়ায়...। মুকুল এসেছে আমের ডালেও। আর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট ছোট আমের দেখা মিলবে। এই আমে গ্রামের ঘরে ঘরে ডাল রান্না হবে। আর কাঁচা আমের ভর্তার কথা তো বলাইবাহুল্য। চৈত্রের শেষ দিন ৩০ চৈত্র বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের দিন চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমানকাল থেকে নানা লোকাচার উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উৎসবটি পালন করে আসছে বাংলাদেশের মানুষ। মূল আয়োজন গ্রামে হলেও নগর সংস্কৃতিতে এর কদর এখন যথেষ্ট। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করেন। চৈত্রসংক্রান্তির আরেকটি বড় উৎসব চড়ক। গোটা চৈত্র মাসে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্নভোজন প্রভৃতি নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তাঁরা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝোলেন। আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটেন। ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত দেখতে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ জড়ো হন। আনন্দে মাতেন। এ আয়োজনের সঙ্গে আরও চলে গাজনের মেলা। এ মাসের হাত ধরেই আসে বৈশাখ। পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরে পৌঁছে দেয় চৈত্র। সব মিলিয়ে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মাস। উপভোগ্যও বটে।
×