ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর মহাজাগরণের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২০ মার্চ ২০১৮

বাঙালীর মহাজাগরণের নেপথ্যে

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা। পৃথিবীর বহু দেশ তখনও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ইংরেজদের দখলে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেসব রাজনীতিবিদ জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে তাঁদের অনেকেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের ভিন্নতর প্রত্যাশা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি। এমনই পরিস্থিতিতে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিচিত ও প্রবীণ নেতাদের ভিড়ে যে কয়েকজন নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, স্বল্প সময়ে সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ হিসেবে যাঁর নাম এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সংগ্রামী ও সাহসী নেতৃত্বের ‘ইমেজ’ নিয়ে যিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র, তিনি হলেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার সেই নিভৃত জনপদ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের এক বিশাল অংশ কেটে যায় ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে পরাধীন ভারতবর্ষে। তারপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৪ বছর কেটে যায় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার মানুষের এবং বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি আমরা এমনি এমনি পাইনি। এই দেশটি পাওয়ার একটি সুদীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। এক সময় আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। একটি দেশের দুই টুকরো দুই জায়গায় মাঝখানে হাজার কিলোমিটার দূরত্ব। সেটিই ছিল পাকিস্তান। জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথচ সম্পদের বড় অংশ ভোগ করত পশ্চিম পাকিস্তান। পুরো দেশটি যে ছিল ষড়যন্ত্রের জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা একটি সেটি বুঝতে বাঙালীদের মাত্র বছর কয়েক সময় লেগেছিল। যখন পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিয়ে গেলেন উর্দু এবং শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বাহান্ন সালে ভাষা আন্দোলন হলো। রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হলো। চুয়ান্ন সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার নেতারা প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করলেন। কিন্তু বছর শেষ হওয়ার আগেই সেই সরকারকে বাতিল করে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু তাঁর বুঝতে বাকি রইল না যে, পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তিলাভের একটিমাত্র উপায়, সেটি হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি ছয় দফার আন্দোলন শুরু করেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ছয় দফা আসলে একটিমাত্র দফা, যার অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা। পাকিস্তানে তখন আইউব খানের সামরিক শাসন। বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সহকর্মীরা বেশিরভাগ সময়ই জেলখানায় থাকেন। রাজনৈতিক নেতাদের বলতে গেলে কেউ বাইরে নেই। ছাত্ররা আন্দোলন করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনল। ঊনসত্তরের বিশাল গণআন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হলো। ক্ষমতা দেয়া হলো সর্বকালের নৃশংস দানব ইয়াহিয়া খানের কাছে। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাঙালীরা তাঁকে একটা অভূতপূর্ব বিজয় উপহার দেয়। বাঙালীরা প্রথমবার এই দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে, পাকিস্তানী মিলিটারির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ১৯৭১ সালের ১ মার্র্চ আকস্মিক এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। তাদের বিশাল ষড়যন্ত্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা নির্বাচনের রায় অস্বীকার করা মাত্রই সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাঁর নির্দেশে এই অঞ্চল চলতে শুরু“করল। বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালী জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কী নির্দেশ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে। ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ এই বলে হৃদয়ছোঁয়া মর্মস্পর্শী এক ভাষণ শুরু করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চ ১৯৭১ বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তৎকালীন পাকিস্তানের জনগণই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেন। ঢাকায় তখন দেশী-বিদেশী সকল সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেদিন ছিল এক অন্তিম মুহূর্ত। অপরদিকে, স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালী জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানী শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান। এর পটভূমিতে ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বাঙালী জাতিকে সমূলে নির্মূল করার নীলনকশা। এর প্রতিবাদে একদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন, অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সুদীর্ঘ বছরগুলো অতিক্রম করে জাতিগত নিপীড়ন থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় বাঙালী জাতি দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ছায়াতলে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ, রবিবার, রমনা-রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। এদিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ব্যক্ত করেছিলেন স্বাধীনতার অভিপ্রায়। এই ভাষণটিতে নিহিত ছিল রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বাঙালী জাতির কয়েকটি শতক। শুরু হয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নতুন এক অভিযাত্রা। ৭ মার্চ নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধু বিক্ষোভে উত্তাল রেসকোর্সের লাখো জনতার সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। হৃদয়ে তাঁর বাঙালীর হাজার বছরের লালিত আকাক্সক্ষা স্বাধীনতা। এদিকে চলছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর দমনপীড়ন ও নির্যাতন। এমনি এক সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় তিনি ১৮ মিনিটের হৃদয়ছোঁয়া সংক্ষিপ্ত অথচ মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন। অসাধারণ এক বক্তব্য যেমনি সারগর্ভ, যুক্তি তেমনি তির্যক ও দিকনির্দেশনাপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালীদের অবস্থান ব্যাখা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালীদের বিরোধের স্বরূপ তুলে ধরা, শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচী ঘোষণা, সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ, প্রতিরোধ সংগ্রাম, শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যে কোন উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে ঘোষণা করেন ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। এ ভাষণ কেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণের মধ্যে অন্যতম? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি কেন হৃদয়ছোঁয়া মর্মস্পর্শী এবং কালজয়ী? তাঁর এ ভাষণ প্রচ- উদ্দীপনায় মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে নব চেতনায় জাগিয়ে তুলে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। এ ভাষণ বাঙালীর হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাষণে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো... আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশআল্লাহ!’ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন এবং কয়েক লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান, যা বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে সর্বোচ্চ দেশাত্মবোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানী শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালীর জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর কালজয়ী এ ভাষণ সময়ের পরিসীমায় গ-িবদ্ধ না থেকে তা হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ ও সকল সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ীÑ ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’। তাঁর এ ভাষণ কাব্যিক, শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে হয়ে উঠেছিল গীতিময় ও শ্রবণে শিহরণ জাগানিয়া, চতুর্দিকে অনুরণিত। তাঁর এ ভাষণ তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও হৃদয় উৎসারিত। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর্যন্ত ভাষণটি লাখো-কোটিবার বাংলার আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হচ্ছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ধ্বনিত হয়েছে এ ভাষণ। অথচ স্বাধীন জাতিসত্তা হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভাষণটির ঐতিহাসিক মর্মার্থ বের করে কোনরূপ গবেষণাকর্ম বা সাহিত্যভা-ার গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবীর সাড়া জাগানো ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। ১৮ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল যেমন ছন্দময় এবং কাব্যিক, তেমনি ছিল হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্লেষণ করে মার্কিন ম্যাগাজিন নিউজউইক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনৈতিক কবি’ উপাধি দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দলিল যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণোদনাময়ী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত এবং গৃহীত হলো। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লাখ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোনসহ আমাদের সকলের জন্য এটি এক মহাআনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলেই জানেন এবং বোঝেন আমরা জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ এরপর পাকিস্তানী শাসনামলের ২৩ বছরে বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস, বাংলার মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে। তাই তো এই ভাষণ হৃদয় ছুঁয়েছে, মর্মে মর্মে অনুরণিত হয়েছে তৎকালীন ৭ কোটি বাঙালির হৃদয়ে। এ ভাষণ বাঙালীর জাতীয় জীবনে যে জাগরণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ে। নয় মাসের সেই যুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে আত্মত্যাগের ইতিহাস, বীরত্বের ইতিহাস আর অর্জনের ইতিহাস। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×