ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

টাক নিয়ে ১৫০ কোটি ডলারের ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ মার্চ ২০১৮

টাক নিয়ে ১৫০ কোটি ডলারের ব্যবসা

টাক সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের মাথাব্যথার শেষ নেই। কিভাবে চুল পড়া বন্ধ করে টাক দূর করা যায়, মাথায় নতুন চুল গজানো যায়Ñ এই তাদের সর্বক্ষণের ভাবনা। একের পর এক নানা ধরনের তেল, শ্যাম্পু, হারবাল ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে করতে তারা হয়রান হয়ে যান। এমনকি সার্জারির পর্যন্ত দ্বারস্থ হন। তার মধ্যে কোনটি কাজ করে এই অর্থে যে চুল পড়া কমে যায়। সমাধান আবার কোনটি একজনের ক্ষেত্রে কাজ করছে তো অন্যজনের ক্ষেত্রে একেবারেই করছে না। কেননা টাক সমস্যার সর্বজনীন কোন অলৌকিক সমাধান নেই। ফলে বিভ্রান্তির এক ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। আর সেই ধূম্রজালের আড়ালে টাক নিয়ে চলতে থাকে এক রমরমা ব্যবসা। হিসাব করে দেখা গেছে সারা বিশ্বে এই ব্যবসায়ের পরিমাণ হলো দেড় শ’ কোটি ডলার। এ এক নিষ্ঠুর, গলাকাটা শিল্প। ঝুঁকিগ্রস্ত লোকদের শিকার করাই এই শিল্পের কাজ। রোগীদের সর্বোত্তম স্বার্থ হৃদয়ে পোষণ করে এমন প্রতিষ্ঠান আছে হাতেগোনা। সমীক্ষায় দেখা গেছে চুল পড়া সমস্যায় ভোগা ৪৩ শতাংশ পুরুষ ব্যক্তিগত আকর্ষণীয়তার ওপর এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে চিন্তিত থাকে। ২২ শতাংশ উদ্বিগ্ন থাকে সমাজ জীবনের ওপর এর প্রভাব নিয়ে। ২১ শতাংশ একে তাদের ডিপ্রেশন বা বিষণœœতাবোধের সঙ্গে যুক্ত করে। টাকের নানা ধরনের ওষুধের এরাই গ্রাহক। সমস্যার উৎপত্তির দিকে এরা তেমন নজর দেয় না। চুল পড়া বা টাক সৃষ্টির সমস্যার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রূপটিকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে এন্ড্রোজেনেটিক এলোপিসিয়া। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই এতে আক্রান্ত হলেও পুরুষদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে টার্গেট করেই ওষুধ কোম্পানিগুলো ব্যবসা ফেঁদে বসে। মেল-প্যাটার্ন এলোপিসিয়া এক অতি জটিল সমস্যা। ৩০ বছরের কম বয়সী ৩০ শতাংশ পুরুষ এতে আক্রান্ত হয়। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমান্বয়ে এই হার বাড়তে বাড়তে দেখা যায় সত্তরোর্ধ প্রায় ৮০ শতাংশ পুরুষ টাক সমস্যার শিকার। এর কারণগুলো সুপ্রিতিষ্ঠত। কিন্তু সমস্যাক্রান্তরা তেমন একটা বোঝে না। তারা ধরে নেয় যে মাথার যেসব সূক্ষ্ম রন্ধ্রপথ দিয়ে চুল গজায় সেগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করায়, অতিরিক্ত চুল আঁচরানোয়, টাকের ভুয়া ওষুধ ব্যবহারে কিংবা পানিতে সমস্যা থাকার কারণে টাক পড়ে। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা হলো এটা প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর খেলা তাদের নিয়ে যারা জিনেটিক দিক দিয়ে বিপন্ন। ডিহাইড্রোটেসটোসটেরন (ডিএইটি) নামে একটি হরমোন এ জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। ৫ আলফা-রিডাকটেস নামের একটি এনজাইম দ্বারা এটি টেসটোসটেরন থেকে সংশ্লেষিত। ডিহাইড্রোটেসটোসটেরন ডারমাল পেপিলায় দেখতে পাওয়া যায়। ডারমাল পেপিলা হলো চুলের ফলিকলের গোড়ায় থাকা ক্ষুদ্র এক প্রকোষ্ঠ। হরমোনের দিক দিয়ে স্পর্শকাতর এলাকাগুলো যেমন কপাল ও মাথার চাঁদিতে চুল কমিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করে। ডারমাল পেপিলা কোষগুলোর সংখ্যা কমে আসে, ফলিকলগুলো সঙ্কুুচিত হয় এবং সৌন্দর্যের দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য চুল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রথম পরিণতি হলো ধীরে ধীরে টাক পড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, আরও বড় ধরনের পরিণতি হলো মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া। টাক পড়া কোন রোগ নয়, এতে শরীরের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু তথাপি যাদের টাক পড়ে তারা মনের দিক থেকে এটা মেনে নিতে পারে না, তাদের মনে হয় অন্যদের কাছে তাদের আকর্ষণ কমছে, তারুণ্য কমছে, তাদের শক্তি বীর্য কমছে। বিশেষ করে আস্থাহীন মানুষদের কাছে এই অনুভূতিগুলো বেশি হয়। নিজেদের যে কোন ব্যর্থতার জন্য তখন এরা মাথার টাককে দায়ী করে। সেটাকে বলির পাঁঠা বানায়। তাদের ভাবনায় আসে ‘আমার মাথাভরা চুল থাকলে এমনটি হতো না।’ ভাবনাটা হাস্যকর রকমের ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু মাথার ভেতরে এই যে বীজ ঢুকে গেল সেটাকে দমন করতে না পারলে তা পরিপুষ্ট হয়। তা থেকে জন্ম দেয় অবদমিত ক্ষোভ, ক্রোধ, অশান্তি ও হতাশা। অথচ সমস্যার সবচেয়ে ভাল সমাধান বাস্তবতাকে মেনে নেয়া। সেটা না করে, টাক সমস্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না করে বেশিরভাগ পুরুষ টাক পড়া সমস্যার সমাধান খুঁজে কেউ পরে পরচুলা, কেউ ব্যবহার করে ওষুধ আবার কেউবা ট্রান্সপ্লান্টেশনের দ্বারস্থ হয়। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রথম উদ্ভাবিত হয় ১৯৫০ এর দশকে। উদ্ভাবন করেন নিউইয়র্কের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ নরম্যান ওয়েন্টরাইখ। এতে মাথার পেছনের ও দু’পাশের ফলিকলগুলো টাক পড়া জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপিত ফলিকল জানে না কোথায় তাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা এমনভাবে গজিয়ে চলতে থাকে যেন এটি যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে মাথার পেছন দিকের ও দু’পাশের ফলিকলগুলো নেয়া হয়। এসব এলাকা ডিএইচটি হরমোনের কারণে সৃষ্ট মিনিয়েচারাইজেশন প্রক্রিয়ার প্রতি স্পর্শকাতর নয়। ১৯৮০-এর দশকে এই গ্রাফটিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরেকটি পদ্ধতিতে উন্নীত হয়, যার নাম এফইউটি বা ফলিকুলার ইউনিট ট্রান্সপ্লানটেশন বা স্ট্রিপ সার্জারি। আগের পদ্ধতিটার নাম এফইউই বা ফলিকুলার ইউনিট এক্সট্রাকশন। আর এফইউটি বা স্ট্রিপ সার্জারিতে চুলসহ চামড়ার অংশ কেটে নিয়ে অতি ছোট ছোট অংশে টুকরো করা হয়। তারপর সেগুলো টাক পড়া জায়গার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। পদ্ধতিটা এফইউইর তুলনায় দ্রুততর। কারো কারো মতে এটা উন্নত মানের চুল গজানোর সর্বোত্তম উপায়। তবে অনভিজ্ঞ হাতে পড়ে এই কৌশলটির অনেক বদনাম ঘটে গেছে। অবশ্য এফইউই কৌশলেরও সীমাবদ্ধতা আছে। প্রক্রিয়াটি কঠিন। এর জন্য চিকিৎসকের দিক থেকে প্রচুর মনোসংযোগ এবং রোগীর দিক থেকে প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন। ডোনার জায়গাটি থেকে হাজার হাজার ফলিকল বেছে নেয়া হয়। তারপর বিশেষ যন্ত্র দিয়ে সেগুলো টেনে বের করে নিয়ে অত্যন্ত হিমে রাখা হয় এবং পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র করে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রক্রিয়াটি অতিমাত্রায় শ্রমনিবিড় এবং প্রচুর সময় লাগে। বিশেষজ্ঞতা অর্জনই এই প্রক্রিয়ার সাফল্যের চাবিকাঠি। সঠিক হাতে না পড়লে এতে প-শ্রম ও অর্থের অপচয় দুটোই হতে পারে। সঠিক ফলিকলটিকে সঠিক জায়গায় লাগাতে হবেÑ এটাই এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। দুর্ভাগ্যের বিষয় এ জাতীয় অপারেশন যারা করেন তাদের সবাই এসব খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে নিবিড় দৃষ্টি দেন না। অথচ এ ধরনের হাজার হাজার ক্লিনিক সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো অনেক ক্ষেত্রে নার্সদের দিয়েও এ জাতীয় কাজ করা হয়। মেল প্যাটার্ন এলোপিসিয়া চিকিৎসার অপেক্ষাকৃত সহজ একটা উপায় হলো ওষুধ। এ জাতীয় নানা ধরনের ফোম, স্প্রে, ক্রিম ও ট্যাবলেট আছে। মনে হতে পারে এগুলোর কোন না কোনটির মধ্যে হয়ত ম্যাজিকের মতো সমাধান মিলবে। টাক মাথায় অলৌকিকভাবে নতুন করে গজিয়ে উঠবে চুল। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। বাজারে টাক চিকিৎসার দুটি অনুমোদিত ওষুধ আছে। একটি মিনোক্সিডিল অন্যটি ফিনাস্টেরাইড। মোটামুটিভাবে এটা স্বীকৃত সত্য যে, এ দুটো ওষুধের কোনটাই টাক পড়া বন্ধ করতে পারে না। যেটা পারে তা হলো এই অনিবার্য ব্যাপারটিকে বিলম্বিত করে দেয়া। মিনোক্সিডিলের সঙ্গে চুল গজানোর যে একটা যোগসূত্র আছে তা প্রথম লক্ষ্য করা হয় ১৯৬০ এর দশকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন ১৯৮৮ সালে এটিকে টাকের চিকিৎসার ওষুধ হিসেবে অনুমোদন দেয়। তবে সেই সঙ্গে এ কথাও বলে যে এই ওষুধ সবার ক্ষেত্রে কাজ করবে না। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা যায় যে ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে নতুন করে চুল গজিয়েছে। তবে ২০১৫ সালে মিনোক্সিডিলের কার্যকারিতা নিয়ে পরিচালিত এক সুপরিকল্পিত সমীক্ষায় দেখা যায়, শুধু নির্দিষ্ট শ্রেণীর লোকের ক্ষেত্রে চুল গজানোর গ্রহণযোগ্য ফল পাওয়া গেছে। মাথায় লোশন হিসেবে ব্যবহারযোগ্য মিনোক্সিডিল আশা জাগানো বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে পাওয়া যায় যেমন ‘হেয়ার গ্রো,’ ‘হেয়ার-এ- গেইন’, ‘হেয়ারওয়ে’ স্পেলনডোরা ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় এটি সাধারণত ‘রোগেইন’ বা ‘রিগেইন’ নামে পিরিচিত। এদিকে চুল গজানোর ওষুধ হিসেবে ফিনাস্টেরাইড ১৯৯৭ সাল থেকে প্রোপেসিয়া নামে পাওয়া যাচ্ছে। এর কাজ মিনোক্সিডিলের চেয়ে অধিকতর ভালভাবে বোধগম্য। ধারণা করা হয় যে, এটি ডারমাল পেপিলায় ৫-আলফা-রিডাকটেস এনজাইমকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে ওষুধটির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে যেমন, লিঙ্গ উত্থানে সমস্যা, যৌন কামনা হ্রাস, বীর্যপাত ও চরম পুলক লাভে সমস্যা। এ কারণে পুরুষরা এই ওষুধ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হতে পারে। কিন্তু তার পরও অনেকেই তা ব্যবহার করছেন। এফডিএ কিংবা ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় এর অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত অন্য আর কোন টাকের ওষুধ নেই। তার পরও বহু রকমের ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট বাজারে আছে যেগুলো মজবুত চুল গজাতে সাহায্যে করে বলে দাবি করা হয়। এগুলোর বাস্তব কার্যকারিতায় কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকলেও এগুলোর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে অনলাইনে জোর বিতর্ক চলে। এদিক বাজার থেকে আর্থিক মুনাফা তুলে নেয়ার চেষ্টায় আরও কয়েক ডজন কোম্পানি টাকের ওষুধ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। এমন একটি কোম্পানি হলো এলারগান। এরা দুটো সম্ভাবনাময় ওষুধ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। একটি টাকে লাগানোর ওষুধ বিমাটোপ্রোস্ট। গোড়াতে ওষুধটি গ্লুকোমা চিকিৎসার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল। আরেকটি হলো খাওয়ার ওষুধ সেটিপিপ্রান্ট। টাকের জায়গায় প্রোস্টাগ্লান্ডিন নামে যে উপাদানটি উচ্চমাত্রায় থাকে সেটিকে এই ওষুধটি অবদমিত করে। স্যামুমেড নামে আরেক কোম্পানি সম্প্রতি অন্য এক সম্ভাবনাময় ওষুধ এসএম ০৪৫৫৪ এর কথা প্রচার করে বেশ সাড়া ফেলেছে। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ এর ক্লিনিক্যাল ডাটা দেখে তেমন উৎসাহিত বোধ করেননি। তবে ভবিষ্যতে টাকের উন্নততর চিকিৎসার সুবিশাল সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনার একটি হলো ক্লোনিং। চুলের ফলিকলের সফল ক্লোনিং ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের চুলের অফুরন্ত উৎস যোগাতে পারে, যে উৎসটি বর্তমানে অতি মূল্যবান অথচ অতি সীমিত ডোনার এরিয়ায় সীমাবদ্ধ। সূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট
×