ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মতি লাল দেব রায়

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ মার্চ ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

(১১ মার্চের পর) বিভিন্ন রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত... চা বাগানে শ্রমিকদের অধিকাংশ সদস্যই কোন না কোন রোগে আক্রান্ত। রোগ বালাই যেন ওদের নিত্যসঙ্গী। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, জ্বর, ডায়রিয়া, কৃমিতে আক্রান্ত গোটা চা শিল্পের মানুষ। কিছুদিন পূর্বে প্রত্যেক চা বাগানে কুষ্ঠ রোগী ছিল। যা হীড-বাংলাদেশ-এর সহায়তায় কমে গিয়েছে। তা না হলে এই রোগ জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়তো সমগ্র চা বাগানগুলোতে। চা বাগানের শ্রমিকরা প্রায়শই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে এত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী আর কোথাও একসঙ্গে দেখা যায় না। এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রতিরোধ ও সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। চা বাগানের ড্রেনেজ সিস্টেম, ঝোঁপ-ঝাড়, জঙ্গল, চা চারা গাছ, আগাছাযুক্ত খাল, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইত্যাদি ম্যালেরিয়ার প্রজনন কেন্দ্র। যেদিকে তাকাবেন সে দিকেই শুধু ময়লা আবর্জনা দেখা যায়। চা নারী শ্রমিকদের অনেকেই বিভিন্ন যৌন রোগে আক্রান্ত। সামাজিক ও লোকলজ্জার ভয়ে ডাক্তারের কাছে তা প্রকাশ করে না। চা বাগানের যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধক (এমডিআর) যক্ষ্মা রোগীই বেশি। কারণ হিসেবে বোঝা যায় যে, উক্ত রোগী অবহেলা করে নিয়মিত চিকিৎসা করাননি, নয়তো চিকিৎসক সঠিকভাবে চিকিৎসা দেননি। চা শ্রমিকরা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করে এবং অন্ধকার ঘরে বসবাস করে। যক্ষা হওয়ার মতো যত রকম ঝুঁকি আছে, তার সবগুলো চা বাগানে বিদ্যমান। অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা চা বাগানগুলোতে চিকিৎসা সেবার মান খুবই সীমিত। এখানে নেই কোন বড় হাসপাতাল। অধিকাংশ চা বাগানে এমবিবিএস ডাক্তার নেই। তাই কম্পাউন্ডার নামক অর্ধশিক্ষিত কিছু ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে চিকিৎসা কাজটি করিয়ে নেয়া হয়। শ্রমিকরা সবসময়ই বলে থাকে হাসপাতালে গেলে সবাইকে নাকি এক বোতল লাল ওষুধ ও প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেয়া হয়। তাই তারা আগের মতো চা বাগানের ডাক্তারের কাছে যায় না। মারাত্মক রোগ হলে কাছাকাছি শহরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়, যাদের আর্থিক ক্ষমতা নেই তারা শরণাপন্ন হন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তারের কাছে। যদিও উপজেলা হাসপাতালে যেতে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। কমলগঞ্জ উপজেলার একটি চা বাগানে বড় একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে সকল চা শ্রমিকের চিকিৎসা করার মতো সুযোগ নেই। সাধারণত প্রায় সকল চা বাগান হাসপাতালের দরজা প্রায় সময়ই বন্ধ দেখা যায়। কোন সময় যে কম্পাউন্ডার সাহেব হাসপাতালে আসেন এবং দরজা খোলেন তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। ফাঁড়ি বাগানের দৃশ্য অন্য রকম। প্রতিটি ফাঁড়ি বাগানে অফিসের পাশে একটি কক্ষ ডাক্তার বাবুর বসা ও চিকিৎসা দেয়ার জন্য বরাদ্দ থাকে, যেখানে জীবন বাঁচানোর জন্য ওষুধ পাওয়া যায় না, বড়জোর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছূ ওষুধপত্র থাকে। শ্রমিকরা যদি সঠিক চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অসুস্থ থাকে তবে কি করে চা বাগানের উৎপাদন বাড়বে? অতি নির্ভরশীলতা তাদের পঙ্গু করে রেখেছে অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এক ধরনের মারাত্মক মানসিক প্রতিবন্ধিতা। এ থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কষ্টকর। যুগ যুগ ধরে চা বাগানের ম্যানেজম্যান্টের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চা শ্রমিকরা একেবারে বন্দী হয়ে আছে। কাউকে নির্ভরশীল করে রাখতে পারলে তাকে আটকে রাখা যায়, পঙ্গু করা যায়, যথেচ্ছা ব্যবহার করা যায়, এক কথায় খাঁচায় বন্দী পাখির মতো করে রাখা যায়। তাদের যেহেতু নিজস্ব আবাসভূমি নেই, তাই তারা নির্ভরশীল, যেহেতু জমি নেই তাই তারা নির্ভরশীল। যেহেতু পুঁজি নেই তাই তারা নির্ভরশীল, যেহেতু শিক্ষা নেই তাই তারা নির্ভরশীল, যেহেতু অন্য কাজের দক্ষতা নেই তাই তারা নির্ভরশীল। এই অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা চা শ্রমিকদের উন্নয়নের রাস্তাকে বন্ধ করে রেখেছে। নিজেদেরকেই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ প্রয়েজনীয় আর্থিক ও খাদ্য সহয়তা দিতে হবে। নিরক্ষর লোকের হার ৯৮% দেশের ১৬৫টি চা বাগানেই একটি করে স্কুল ঘর আছে, যা বাগান কর্তৃপক্ষ চালানোর কথা। বাস্তবে দেখা যায় স্কুল শুরু হওয়ার সময় কিছু ছোট ছেলে মেয়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। দুপুর বারোটায় মধ্যে কোন শিক্ষকের দেখা পাওয়া যায় না। অপেক্ষা করে ছেলেমেয়েরা যার যার ঘরে চলে যায়। বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের মাস্টার নামের একজন এসএসসি পাস অথবা তার চেয়েও নিম্ন গ্রেডের পাস করা একজন ছেলে বা মেয়েকে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন। বাস্তবে বাগান অফিসে অন্য কাজে তাকে ব্যস্ত রাখা হয়। ইচ্ছা হলে কোনদিন তিনি ঐ স্কুলে আসেন, বেশিরভাগ দিনেই তিনি স্কুলে যান না। একটি স্কুল ঘর আছে, মাঝে মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে, মাস্টার সাহেব উপস্থিত হন না। এ কেমন স্কুল হতে পারে তা পাঠকগণ বুঝতেই পারছেন। এই হচ্ছে বাগানের শিক্ষা ব্যবস্থা। এখান থেকে কিভাবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বের হবে? শিক্ষার নামে এই উদাসীনতা ও তামাশা বন্ধ করে শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারের হাতে নেয়া না হলে কোন উন্নয়ন কর্মসূচীর সফলতা আসবে না। একটা জনগোষ্ঠীকে কিছু দিনের জন্য ঠকানো যায়, বেশি দিন ঐ জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখা যায় না। একদিন তার জবাব কাউকে না কাউকে দিতেই হয়। শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, এটা কারও জন্য সহানুভূতি নয়। প্রতিটি চা বাগানে অবিলম্বে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারকে আগে এগিয়ে আসতে হবে, এটা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। ইদানীং কিছু কিছু চা বাগানে স্থানীয় শিক্ষিত যুবক/যুবতীদের উদ্যোগে কয়েকটি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু হয়েছে, যা সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত হয়েছে। অন্যদিকে কিছু বেসরকারী সংস্থা বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই উপ-আনুষ্ঠানিক শিশুশিক্ষা কার্যক্রম ৫/৬ বছর যাবত চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ছেলেমেয়ে ৫ম শ্রেণী পাস করে স্থানীয় হাই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এ কার্যক্রম যাতে বন্ধ না হয় তা বাগান পঞ্চায়েত ও সরকারী কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া দরকার। অন্যথায় অক্ষরবিহীন চা শ্রমিকরা একদিন এ সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। চোলাই মদের প্রাবল্য সকল চা শ্রমিক মদ পানে আসক্ত। প্রতিটি চা বাগানে এক বা একাধিক মদের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪টি মদের দোকান বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক লাইসেন্স প্রাপ্ত। তাছাড়া ২০০টিরও অধিক ছোট ছোট সাইন। বোর্ডবিহীন মদের দোকান চা বাগানে সার্বক্ষণিক খোলা থাকে। বাংলাদেশের কোন শিল্প এলাকায় বৈধ/অবৈধ মদের দোকান নেই, চা বাগানেই এর ব্যতিক্রম। সন্ধ্যার পর সকল মদের দোকানে অসংখ্য শ্রমিকের আড্ডা জমে ওঠে। আশপাশের বাঙালী অধিবাসীরাও ওদের সঙ্গে সন্ধ্যের সময় মদ পান করে আসক্তি মেটায়। এই সকল মদের দোকান রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। তাছাড়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে ভেষজ ওষধি দিয়ে ‘ঘর চোহানী’ নামক এক ধরনের মদ স্থানীয়ভাবে অনেক পরিবার তৈরি করে এবং খদ্দেরের কাছে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। মদের বড় দোকানকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাট্টা’ বলা হয়। বিভিন্ন শিক্ষিত ও উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা দোষ দেয় ব্রিটিশ শাসকদের। তখনকার ব্রিটিশ ম্যানাজারগণ চা বাগানের মানুষ যাতে সঞ্চয় না করতে পারে এবং সারা দিন কাজ করে মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে সুস্থ চিন্তা না করতে পারে, এর জন্যই সুকৌশলে মদের অভ্যাস চা শ্রমিকদের মধ্যে গড়ে তোলেন তারা। রাতের বেলায় চা শ্রমিক এলাকায় এক অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। চতুর্দিকে শুধু মাতালদের আনাগোনা দেখা যায়। চলবে... লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×