ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২১ মার্চ ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

(গতকালের পর) বারো মাসে তেরো পূজা বাগানের অধিকাংশ চা শ্রমিক সনাতন ধর্মাবলম্বী। দুর্গাপূজা ও দোল পূর্ণিমায় চা বাগানগুলোতে উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। প্রতিটি চা বাগানে দুর্গাপূজার তিন দিনই রাতব্যাপী চলে যাত্রা গান, জুয়া খেলা ও নানা রঙের খেলাধুলা। চা শ্রমিকের সারা বছরের জমানো টাকা দিয়ে দুর্গা পূজার খরচ যোগান দেয়া হয়। যদিও তারা তাদের ছেলেমেয়েদের আদর-আবদার মেটাতে পারে না, তবুও সামান্য কিছুতে আনন্দের শেষ নেই, পূজার সময় সবার ঘরে যার যা পছন্দ সেরকম খাবারের আয়োজন করা হয়। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি নানা আয়োজন থাকে। চা বাগান কার্যক্রম পূজার দিনগুলোতে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। চা বাগানে এ সকল পূজা পালন করা হয়ে থাকে যা বাঙালী সুখী হিন্দু সমাজে একসময় পালন করা হতো। তবে সকল পূজা দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই করতে পারে না। জাত/গোত্রের বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ চা বাগান চা শ্রমিকদের মধ্যে অসংখ্য পদবীধারী মানুষ দেখা যায়। কেউ বা কায়স্থ, কেউবা ব্রাহ্মণ, কেউবা ক্ষত্রীয়, কেউ বা বৈশ্য, আবার কেউ বা শূদ্র। এই বৈচিত্রতার মধ্যেও এক অবিশ্বাস্য একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়। লছমিরা যখন দুটি পাতা ও একটি কুড়ি লাইন বেঁধে তুলে তখন মনে হবে ওরা যেন এক পরিবারের লোক, সারাদিন কাজ তাদেরকে এক লাইনে এনে দাঁড় করিয়েছে। একই ভাষা, একই অর্থনৈতিক অবস্থা, একই রং তাদের জীবনকে করে তুলেছে একাত্ম, ভিন্ন গোত্রের মানুষের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের আর কোন সম্প্রদায়ের মাঝে আছে কিনা জানা নেই। চা বাগানে যে সব পদবীধারী লোক বাস করেন তার উল্লেখযোগ্য হলো এ রকম : চৌবে, ত্রিবেদি, পান্ডা, শর্ম্মা, ছত্রি, মিশ্র, আচার্য, বোনার্জি, গোস্বামী, রয়, সিংহ, যাদব, গোয়ালা, অহির, কৈরি, সাহা, লোহার, কাহার, কুর্মি, নুনিয়া, চৌহান, গৌড়, তেলি, রাজভর, শীল, সেন, কর্মকার, বিন, ব্যানবংশী, ভুমিজ, মল্লিক, মানকি, নায়েক, কানু, কায়েস্থ, গুপ্ত, হাজরা, রিকিয়াশন, পিরিগো, ঘোষ, বার্মা, রবিদাস, শুক্লবৈদ্য, হরিজন, চাষা, তাঁতী, বাকতি, মাঝি, মুন্ডা, তংলা, পান তাঁতী, পাইনকা, মৃধা, উড়াং, বাওরী, রাজবংশী, দুসাধ, পাত্র, ভূইয়া, তুরিয়া, অলমিক, কালোয়ার, মালো, মাদ্রাজি ইত্যাদি। চা শিল্পকে ঘিরে ১৩টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা বোর্ড : চা বাগানের উন্নয়ন মনিটরিং এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড গঠিত, এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যা সরকারের পক্ষে চা নীতি প্রণয়ের জন্য দায়ী এবং সরকারের নীতির বাস্তবায়নকারী। চট্টগ্রামে এর হেড অফিস। ঢাকাতেও এর অফিস আছে। চা বোর্ড চা বাগানের উন্নয়ন মনিটরিং করে দুটি সংগঠনের মাধ্যমে। এর একটি হচ্ছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অন্যটি হচ্ছে প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ইউনিট। চায়ের মান নিয়ন্ত্রণ করা, উচ্চফলনশীল চায়ের উন্নয়ন ঘটানো এবং চা বাগানগুলো যাতে এই সকল উচ্চফলনশীল চা উৎপন্ন করে তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ চা বোর্ডের দায়িত্ব। চা উন্নয়নে চা বোর্ড সরকারকে নতুন প্রস্তাবনা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) চা বোর্ডের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। যা শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। এর প্রধান কাজ হচ্ছে গবেষণা করা, গবেষণার ফলাফল চা বাগানে সরবরাহ করা ও চা বাগানকে এটি বাস্তবায়ন করতে উৎসাহী করা। চা শিল্পের ওপর নতুন আবিষ্কৃত বিষয় নিয়ে সেমিনার ওয়াকশপ করা। ড্রট ম্যানেজমেন্ট, সার প্রয়োগ পদ্ধতি, পোকা মাকড় দমন, কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার, লাল পোকার আক্রমণ রোধ করা, ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা সভার ব্যবস্থা করা এই সংস্থার দায়িত্ব। এই সংস্থায় কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। দুঃখের বিষয়, বাগান সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ১ জন মহিলা কর্মকর্তা ছাড়া, চা সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সন্তানদের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ইউনিট পিডিইউটি বোর্ডের আর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এটি চা বাগানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, টিলা বাবু, চা শ্রমিকের ঘর পাকা করা, নলকূপ স্থাপন, রাস্তা মেরামত ও লেট্রিন বসানোর কাজগুলো করে থাকে। পিডিইউকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে চা বোর্ড। এই সংস্থার অফিস বিটিআরইএর খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন স্থরের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ অনেক উর্ধতন কর্মকর্তা কর্মরত আছেন কিন্তু কই কোথাও তো চা বাগানের কালো রঙের সন্তানদের ঐ অফিসে কাজ করতে দেখা যায় না। যাদের উন্নয়নের জন্য পিডিইউ প্রতিষ্ঠিত কোথায় তাদের অংশীদাারিত্ব। চা বাগান কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিস চা শ্রমিকের কল্যাণের জন্য ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিস স্থাপন করা হয়। এই অফিস পরিচালনা করেন ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটি। তার মধ্যে আছেন শ্রম পরিচালক, বাংলাদেশ চা সংসদ থেকে তিন জন সদস্য, চা শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দু’জন সদস্য, চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত নন এমন দু’জন সদস্য। প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসের কাজ হলো : একজন শ্রমিক যিনি ২৪০ দিন যাবৎ (বছরে) চা বাগানে কাজ করেছেন তাকে সদস্যপদ দেয়া, শ্রমিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি মাসিক বেতনের ৭% হিসেবে কেটে তাদের এ্যাকাউন্টে জমা করা এবং মালিকপক্ষ থেকে সমপরিমাণ টাকা এনে তার এ্যাকাউন্টে জমা রাখা। যখন কোন শ্রমিক অবসর নেন বা মৃত্যুবরণ করেন তখর তার টাকা তাকে অথবা তার নমিনিকে সুদসহ দিয়ে দেয়া। মোট ৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ৩/৪ জন চা বাগান সম্প্রদায়ের লোক বিভিন্ন পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। শ্রম-কল্যাণ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসের ভারপ্রাপ্ত কন্ট্রোলার হিসেবে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই পদটি ১৯৮২ সাল থেকে শূন্য রয়েছে যার জন্য এই অফিসের কাজকর্ম রীতিমতো পরিচালিত হচ্ছে না। চলবে...
×